পাশের বাড়ির মমতাময়ী বড় বোন

  • প্রভাষ আমিন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

প্রভাষ আমিন

প্রভাষ আমিন

শেখ হাসিনা আমার প্রিয় চরিত্র। তাঁকে নিয়ে কিছু লিখতে আমার একই সঙ্গে প্রচণ্ড আগ্রহ এবং তীব্র অনীহা রয়েছে। শেখ হাসিনা একজন মানবিক মানুষ, ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ। তাই তাঁকে ভালো যেমন বাসি, তেমনি কিছু সমালোচনাও আছে। আমি জানি, খোলা মনে সমালোচনা গ্রহণ করার ঔদার্য্য শেখ হাসিনার আছে। সমালোচনা গ্রহণ করার ব্যাপারে তার সহনশীলতায় আমার আস্থা আছে।

পরিবারের প্রায় সবাইকে হারিয়ে, ১৯ বার হত্যা চেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা আসলে সর্বংসহা। আমাদের এসব সমালোচনা আর কথার বাণ তাঁর অসীম সহ্যক্ষমতার দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। তবে তাঁর দলের লোকজনের সহনশীলতা নেই বললেই চলে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললেই তারা মামলা ঢুকে দেন, হামলা করেন। যেমন 'শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কটুক্তি' করার অভিযোগে ছাত্রলীগ নেতার দায়ের করা মামলায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম এখন কারাগারে আছেন। এমন উদাহরণ আরো আছে। অথচ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌক্তিক সমালোচনা, এমনকি অযৌক্তিক সমালোচনাও অপরাধ নয়।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু আমলে জাসদ নেতারা যে ভাষায় তাঁর সমালোচনা করেছে, এখন তা কল্পনা করতেও ভয় লাগে। শেখ হাসিনা একজন মানুষ। তাঁর ভালো যেমন আছে, মন্দও তেমনি আছে। কারো দৃষ্টিতে ভালো বেশি, কারো দৃষ্টিতে মন্দ। সহনশীলতা শেখ হাসিনার একটি মহৎ গুণ। সেই ভরসায়  তীব্র অনীহা কাটিয়ে প্রচণ্ড আগ্রহেরই জয় হয়েছে।

শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের পছন্দ করেন, আবার তাদের নানা কাজের, লেখার, বলার হুল ফোটানো সমালোচনাও করেন। এটাকে আমি সবসময় ইতিবাচকভাবেই নেই। তাঁকে সমালোচনা করা যদি আমার মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হয়, সেটার জবাব দেয়াও তো তাঁর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। তবুও এই সময়ে তাঁকে নিয়ে লিখতে গিয়ে তীব্র অনীহা এসেছে অন্য কারণে। শেখ হাসিনা সুযোগ পেলেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে ভালোবাসেন। দেশের বাইরে গেলে ফিরে এসেই সংবাদ সম্মেলন করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে তাঁর যে মজার খুনসুটি হয়, তা দারুণ উপভোগ্য। এখন তো সব টেলিভিশন শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচার করে। তবে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচার করতেই হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তারপরও টেলিভিশনগুলো প্রতিযোগিতা করে সরাসরি সম্প্রচারে যায়, কারণ শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন একটি খুব দর্শকপ্রিয় অনুষ্ঠান। তখন সব চ্যানেলের টিআরপি থাকে হাই।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127113929.jpg

আমি যখন মাঠের রিপোর্টার ছিলাম, তখন টেলিভিশনের এমন দৌরাত্ম্য ছিল না। তখন উপস্থিত থেকে এবং এখন টেলিভিশনে দেখে যতটা বুঝি, শেখ হাসিনা প্রশ্ন নিতে ভালোবাসেন। তাঁকে কী প্রশ্ন করা যাবে, কী করা যাবে না; তার কোনো পূর্ব নির্ধারিত ফরম্যাট নেই। প্রশ্ন যেমনই হোক তিনি উত্তর দেন দারুণ সপ্রতিভতায়। কখনো কখনো পাল্টা প্রশ্ন করে চমকে দেন প্রশ্নকর্তাকেই।

আগে তাঁর সংবাদ সম্মেলন কাভার করার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, ভিন্নমতের সাংবাদিকরাও তাঁর সংবাদ সম্মেলনে যেতে পারেন, প্রশ্ন করতে পারেন। আমাদের সময় সংবাদ সম্মেলনে প্রথম প্রশ্নটি করতেন নিউ নেশনের রিপোর্টার মোজাফফর হোসেন মানিক। প্রয়াত এই সাংবাদিক প্রথম প্রশ্নটিই একটু খোঁচা মেরে করতেন। শেখ হাসিনাও পাল্টা খোঁচা দিতেন। একবার এক সাংবাদিক বললেন, আপা, মানিক ভাইয়ের বাড়ি তো গোপালগঞ্জে। জবাবে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘গোপালগঞ্জে কি রাজাকার নাই?’ তখন দৈনিক দিনকালের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন কাভার করতে যেতেন মোখলেসুর রহমান চৌধুরী, যিনি পরে রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদের প্রেস সচিব হিসেবে আলোচিত হয়েছিলেন। মোখলেস ভাই সবসময় শ্রীলঙ্কার পত্রিকা দ্যা আইল্যান্ড-এর বাংলাদেশ সংবাদদাতা হিসেবে পরিচয় দিতেন। আর শেখ হাসিনা বলতেন, ‘আরে আগে বাংলাদেশেরটা বলেন।’ মোখলেস ভাই কাচুমাচু করে দিনকালের পরিচয় দিলেই শেখ হাসিনা জিজ্ঞেস করতেন, দিনকাল কেমন চলছে?

প্রস্তুতি না নিয়ে শেখ হসিনার সংবাদ সম্মেলনে গেলে খবর আছে। কদিন আগে এক সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নিয়ে জানতে চাইলেন। জবাবে শেখ হাসিনা পাল্টা প্রশ্ন করলেন, মাতারবাড়িটা কোথায়? দেখা গেল উপস্থিত সাংবাদিকদের কেউই মাতারবাড়ি চেনেন না। কিন্তু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে তাদের অনেক উদ্বেগ! সব মিলিয়ে শেখ হাসিনার সংবাদ সম্মেলন সবসময়ই দারুণ উপভোগ্য অভিজ্ঞতা হতো সাংবাদিকদের জন্য। এই সংবাদ সম্মেলনকে ঘিরেই ছিল আমার অনীহা। সাম্প্রতিক কয়েকটি সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা পেশাগত পরিচয় ভুলে এমনভাবে প্রশ্ন করেছেন, যা আসলে প্রশ্ন নয়, অন্ধ দলীয় আনুগত্যের প্রকাশ। দলীয় নেতাকর্মীদের উপস্থিতি আর করতালির শব্দ শুনে মনে হয় না, এটি সংবাদ সম্মেলন।  

সাম্প্রতিক সংবাদ সম্মেলনের কারণে সাধারণ সাংবাদিকদের সম্পর্কে ধারণাটাই হয়েছে নেতিবাচক। তাই আমার শঙ্কা, শেখ হাসিনা সম্পর্কে লিখলেই সেই পারসেপশনের কবলে পড়তে হবে। কারণ সত্যি কথা লিখলেও তা তাঁর প্রশংসাসূচকই হবে। আমি দলনিরপেক্ষ, তবে আদর্শ নিরপেক্ষ নই। আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদার, গণতান্ত্রিক, উন্নত, সমৃদ্ধশালী, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ চাই। আর এটাও জানি, এই লক্ষ্য অর্জনে এখনও শেষ আশ্রয় শেখ হাসিনাই। শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের অনেক কাজের সমালোচনা করলেও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, আমি ব্যক্তিগতভাবে শেখ হাসিনার অনুরাগী। অনেক ভেবে দেখলাম, আমি কখনো রাজনীতি করবো না, সাংবাদিক নেতাও হবো না, কোনো পোস্টিংএ আগ্রহ নেই, কোনো পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, টেলিভিশনের মালিক হতে চাইবো না; তাই আশা করি যাই লিখি, তা ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে লিখতে পারবো। প্রশংসাসূচক লিখলেও, তা কোনো প্রাপ্তির প্রত্যাশায় নয়, সেটা নিশ্চিত। নিজের কাছে এটা নিশ্চিত হওয়ার পর শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখার ঝূঁকিটা আমি নিয়েছি।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127204460.jpg

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দু’জন মানুষের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১০ মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার প্রতীক্ষায় তখন গোটা জাতি। তিনি এসে শুরু করেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজ। কিন্তু ৭৫এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে দেশে শুরু হয় পাকিস্তানীকরণ। স্বাধীনতা বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত হয়ে যান। রাজনীতি ঢুকে পড়ে ক্যান্টনমেন্টে। এই সময় ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৪ বছর। আওয়ামী লীগের মত বড়, কোন্দল কবলিত এবং বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সরকারি নিষ্পেষণে ধ্বংসপ্রায় একটি দলের সভাপতির দায়িত্ব নেয়াটা ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। শেখ হাসিনা সেই দায়িত্ব কতটা পালন করতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় ছিল অনেকেরই। দলের ঐক্যের প্রতীক হিসেবেই শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। যারা তাঁকে ফিরিয়ে এনেছেন, তাদেরও ধারণা ছিল, শেখ হাসিনাকে সামনে রেখে তারাই দল চালাবেন। কিন্তু শেখ হাসিনা সবাইকে চমকে দিয়েছেন। টানা ৩৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব শুধু পালনই করেননি; আওয়ামী লীগকে তুলে এনেছেন অন্যরকম উচ্চতায়।

এখন শুধু দল নয়, দেশ, এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও অনেকের আগ্রহের কেন্দ্রে শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা যখন দেশে ফেরেন, তখন আমি স্কুলের ছাত্র। তখন থেকেই রাজনীতির ব্যাপারে আমার আগ্রহ। তাই শেখ হাসিনাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি, আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর প্রতি মুগ্ধতা বেড়েছে।

শেখ হাসিনা যে এখনও বেঁচে আছেন, এটা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দেশে থাকলে, সেদিনই পরিবারের আর সবার সঙ্গে নিহত হতে পারতেন। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় বেঁচে যাওয়াটা তো অলৌকিক।

১৯৭৫ সালে যখন বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন, তখন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন জার্মানিতে। রাষ্ট্রপতির কন্যা থেকে হঠাৎ বনে যান অসহায়, এতিম। আগের দিন যারা মাথায় তুলে রেখেছিল, পরদিন তারাই মুখ ঘুরিয়ে নেন। দুই সন্তান আর ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে যাপন করেন উদ্বাস্তু জীবন। সেই উদ্বাস্তু জীবন থেকে কীভাবে শেখ হাসিনা বিশ্বের অন্যতম সেরা নেতায় পরিণত হলেন, তা নিয়ে একটি অসাধারণ সিনেমা হতে পারে। সেই চিত্রনাট্যে পদে পদে ষড়যন্ত্র, পদে পদে ঝুঁকি, অসম সাহসিকতা, দেশপ্রেম সবকিছুর অনবদ্য সব গল্প থাকবে।

সবকিছু ঠিক থাকলে হয়তো শেখ কামালই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্তরসূরী হতেন। ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনাই শেখ হাসিনাকে রাজনীতিতে টেনে এনেছে। সাদা চোখে দেখলে শেখ হাসিনা উত্তরাধিকার সূত্রেই রাজনীতিতে এসেছেন। তবে ভুলে গেলে চলবে না তিনি ছাত্রজীবনেই ছাত্রলীগের মাঠের কর্মী ছিলেন। বড় সন্তান হিসেবে কাছ থেকে দেখেছেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, দেখেছেন তাঁর মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের দৃঢ়তা। বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন রাজনীতির দীক্ষা আর মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন শত কষ্ট সয়েও আদর্শে অবিচল থাকার শিক্ষা।

শেখ হাসিনা যখন দেশে ফেরেন, তখন চলছে জিয়াউর রহমানের শাসন, যিনি ক্যান্টনমেন্টে বসে গণতন্ত্র চর্চা করছিলেন। কিন্তু একবছরের মাথায় জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর নানা নাটকীয়তা পেরিয়ে ক্ষমতায় আসেন আরেক সেনা প্রধান এইচ এম এরশাদ। তিনিও তার পুর্বসূরীকে অনুসরণ করে গণতন্ত্র চর্চা করেন ক্যান্টনমেন্টে বসেই। এরশাদের টানা নয় বছরের স্বৈরশাসনের সময়ে শেখ হাসিনা গণতন্ত্র মুক্তির আন্দোলন করে গেছেন রাজপথে। একই সময়ে বেগম খালেদা জিয়াও হাল ধরেন বিএনপির। রাজপথেই বিকশিত হন দুই নেত্রী। তবে শেখ হাসিনা এই ৩৭ বছরে নিজেকে এবং বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসবেন, ৮১ সালে এটা কেউ ভাবেননি, আমার ধারণা শেখ হাসিনা নিজেও না।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127269863.jpg

শেখ হাসিনার চরিত্রের অনেকগুলো দিক আছে। তিনি আদর্শে অবিচল, প্রয়োজনে ইস্পাতের মত কঠিন। আবার নিমেষেই কুসুমের মত কোমল। ভুতের মত পরিশ্রম করা এবং দ্রুত ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দল এবং দেশ পরিচালনায় তাঁকে অপ্রতিদ্বন্দী করে তুলেছে। সিনেমায় যেমন এক অভিনেতা একাধিক চরিত্রে অভিনয় করে, তেমনি এক শেখ হাসিনায় যেন বাস করে অনেক শেখ হাসিনা। রাজনীতির মাঠের পাকা খেলোয়াড়কেই দেখা যায় ছেলের জন্মদিনে পোলাও রান্না করছেন। নাতির আবদার মেটাতে রীতিমত শঙ্কা নিয়ে মাছ রাধতে বসে যান। গণভবনের পেছনে ব্যাডমিন্টন খেলতে নেমে পড়া শেখ হাসিনার ছবিও ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। নাতি-নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটানোর ছবিও হুটহাট প্রকাশ হয়ে যায়। সাগরের পাড়ে গিয়ে খালি পায়ে নেমে পড়েন সমুদ্রে। ছোট বোনের সাথে তুষার নিয়ে খেলা করেন।

রাজনীতি করতে গেলে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কিছু করতে হয়। ভোটের মাঠে জড়িয়ে ধরতে হয় বস্তির মানুষকেও। কিন্তু শেখ হাসিনা যখন কাউকে জড়িয়ে ধরেন, দেখলেই বোঝা যায়, নিছক রাজনীতি নয়, তাতে মিশে আছে মমতা। নিমতলীর আগুনে সর্বস্ব হারা দুই মেয়েকে বুকে টেনে নেন মায়ের মমতায়। এমনকি জামালপুর থেকে আসা হিজড়াদের জড়িয়ে ধরেন পরম আদরে। হিজড়াদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আসার গল্পটাও মজার। গত কোরবানীর ঈদের আগে এক হিজড়া প্রধানমন্ত্রীকে এসএমএস করে বলেছিলেন, তাদের কোরবানী দেয়ার সামর্থ্য নেই। শেখ হাসিনা জামালপুরের জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের জন্য গরু পাঠিয়েছিলেন। সেই কৃতজ্ঞতা জানাতেই তারা ছুটে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। রাজনৈতিক প্রচারের বাইরে কত মেধাবীর পড়ার খরচ জোগান শেখ হাসিনা, তা আড়ালেই রয়ে যায়। রয়ে যায়, কারণ শেখ হাসিনা সেই প্রচারণা চান না। সবাইকে কাছে টেনে নেয়ার, আপন করে নেয়ার এক বিরল ক্ষমতা রয়েছে তার। যারা দুজনকেই দেখেছেন, তারা বলেন, এই গুণটা তিনি বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন। এমন আটপৌড়ে ভঙ্গিতে কথা বলেন, বোঝাই যায় সেখানে আন্তরিকতার ছোঁয়া রয়েছে। নেতাকর্মী, শিক্ষক, সাংবাদিক, সংস্কৃতি কর্মী- সবার সঙ্গে তার শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-স্নেহের সম্পর্ক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যেমন ভোলেন না, তেমনি ভোলেন না তৃণমূলের কর্মীদেরও। সবকিছুর ওপরে তাঁর চরিত্রের যে মানবিক আবেদন, তাই অন্য সবার চেয়ে আলাদা করেছে শেখ হাসিনাকে। সাংবাদিকদের মধ্যে যারা তাঁর সঙ্গে সফর করেছেন, তারা পেয়েছেন, তাঁর এই স্নেহের পরশ। এখন হয়তো আর সম্ভব হয় না। তবে আশি ও নব্বইয়ের দশকে নিজে খোঁজ নিয়ে ডেকে সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের থাকা-খাওয়ার তদারকি করতেন। সুযোগ পেলে পাতে তুলে খাইয়েছেন। যারা একবার এই স্নেহের সন্ধান পেয়েছেন, তারা আর তাঁকে ছেড়ে যেতে পারেন না। তবে শেখ হাসিনার চরিত্রের সবচেয়ে উজ্জ্বল অংশ তাঁর অসাধারণ হিউমার আর উইট। বুকে এমন বেদনার মহাসাগর ধারণ করে, জীবন থেকে এতটা রস নিংড়ে নেয়ার ক্ষমতা বুঝি শেখ হাসিনার একার।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127289240.jpg

শেখ হাসিনার জীবনের অনেকগুলো অধ্যায় আছে। কিন্তু জাতির জনকের কন্যা, নিজেও দীর্ঘসময় ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার পরও তিনি যে এতটাই মাটির কাছাকাছি, আমার ধারণা এর কারণ, তাঁর ছেলেবেলো কেটেছে তখনকার অজপাড়াগা টুঙ্গীপাড়ায়। উদার প্রকৃতি আর মধুমতি থেকে উড়ে আসা কোমল বাতাস তার হৃদয়ে এই বাংলার জন্য যে ভালোবাসার জন্ম দিয়েছে, তা ক্রমশ বেড়েছে, পরিণত হয়েছে এই দেশকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্বে। সেই থেকেই প্রকৃতির প্রতি তাঁর অপার ভালোবাসা, মানুষের জন্য অগাধ দরদ তাঁর মনে। সংসারের বড় সন্তান হিসেবে মায়ের পাশে থেকে দেখেছেন দেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ, আর সংসারের জন্য মায়ের কষ্ট। একাত্তরে অবরুদ্ধ বাংলায় মা হয়েছেন। তারপর বছর তিনেকের ‘ভিআইপি’ জীবন। সে ভিআইপি জীবন কেমন, তা এখনও দেখা যায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে গেলে। রাষ্ট্রপতির বাসার ড্রইরুম, বেডরুম, ডাইনিং রুমের সঙ্গে আর দশটা মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের কোনো তফাত নেই। ৭৫এর পর ৬ বছর উদ্বাস্তু জীবন। ৮১ থেকে রাজনৈতিক জীবন। তাঁর ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনেও রয়েছে নানা বাঁক।

শেখ হাসিনা যখন দায়িত্ব নেন, তখন আওয়ামী লীগ এক কোন্দলকবলিত, ধ্বংসপ্রায় দল। তাঁকে দলের সভানেত্রী করা হয়েছিল ঐক্যের সূত্র হিসেবে। ৭৫এর পর থেকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হয়ে যান বঙ্গবন্ধু। নয়মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করে উল্টোপথে। স্বাধীনতাবিরোধীরা হয়ে যান দেশের প্রধানমন্ত্রী। এমন অন্ধকার সময়ে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা শুরু করেন দ্বিমুখী সংগ্রাম। প্রথম কাজ হলো, ধ্বংসস্তুপ থেকে আওয়ামী লীগকে দাড় করানো। দ্বিতীয়ত দেশকে সামরিক ও স্বাধীনতাবিরোধীদের কবল থেকে মুক্ত করা। সমানতালে চলে তার কর্মযজ্ঞ। ৯০এ স্বৈরাচারের পতনের পর ৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে, এমন ধারণাই প্রচলিত ছিল। কিন্তু সব ধারণা পাল্টে দিয়ে জন রায় পায় বিএনপি। পরাজয়ের দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু দলীয় নেতাকর্মীদের ভালোবাসার তোড়ে ভেসে যায় সব অভিমান। আওয়ামী লীগের জন্য অনেক করেছেন, তাই আওয়ামী লীগের সামান্য বিচ্যুতিও তাঁকে কষ্ট দেয়। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে একবার তিনি ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রীর পদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের ২০তম সম্মেলনকে সামনে রেখে একাধিকবার তিনি অবসর নেয়ার আকাঙ্খার কথা বলেছেন। কিন্তু যতই বলুন, এখনও আওয়ামী লীগ তো বটেই, দেশের জন্যও তাঁর বিকল্প নেই। তিনি অনায়াসে স্বীকার করেন, ‘আওয়ামী লীগের সবাইকে কেনা যায়, আমাকে ছাড়া।’ আরেকটা উপলব্ধি তাঁর অসাধারণ, ‘আওয়ামী লীগের নেতারা ওলটপালট করলেও কর্মীরা সবসময় ঠিক থাকে।’ ওয়ান-ইলাভেনের বিপদে বাঘা বাঘা নেতারা নানা মাইনাস তত্ত্বে মেতে উঠলেও কর্মীরাই তাঁকে রক্ষা করেছে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127317935.jpg

২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এসেই কাঁধে তুলে নেন ২১ বছরের জঞ্জাল পরিস্কারের দায়িত্ব। প্রথম কাজ জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার বিচারের প্রতিবন্ধকতা দূর করা এবং বিচার শুরু। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনতে করেন শান্তিচুক্তি। ভারতের সঙ্গে করেন গঙ্গার পানিবন্টন চুক্তি। ২০০৯ সালে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে শুরু শেখ হাসিনার নেতৃত্বের উৎকর্ষের চরম প্রকাশ। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায় কার্যকর করেন। এরপর শুরু হয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এই দুটি বিচার করে তিনি গোটা জাতিকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতির গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়েছেন আমাদের। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না হয় জাতির অপেক্ষার পাশাপাশি কন্যা হিসেবে তার দায়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলো আদর্শের প্রতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি তার অবিচল আস্থার প্রকাশ।

এই দফায় ভারতের সঙ্গে ৬৮ বছরের সীমান্ত সমস্যা সমাধান করে ছিটমহলবাসীকে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছেন শেখ হাসিনা। এই দফায় শেখ হাসিনার মূল লক্ষ্য উন্নয়ন। মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের চেতনা উন্নত ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। সেই লক্ষ্যেই অবিরাম ছুটে চলা তার। এবং এই ছুটে চলা গোয়ারের মত। পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টানাপোড়েনের পর শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত দেন, নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানাবেন। তখন তাঁর মন্ত্রিসভার অনেকেও বিশ্বাস করেননি এটা সম্ভব। কিন্তু পদ্মা সেতু এখন আর কম্পিউটার গ্রাফিক্স নয়, স্বপ্ন নয়; বাস্তবতা। পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকে ফিরে আমি লিখেছিলাম ‘পদ্মা সেতু: শেখ হাসিনার গোয়ার্তুমির প্রতীক’। আসলেই গোয়ার্তুমি। এই গোয়ার্তুমি করেই তিনি বিদ্যুৎ উৎপাদনকে নিয়ে গেছেন অবিশ্বাস্য জায়গায়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন উপেক্ষা করে কার্যকর করেন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি। তাঁর বক্তৃতায়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর অবয়ব থেকে যে আত্মবিশ্বাস ঠিকরে পড়ে সেটাই এখন বাংলাদেশের চিত্র। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল। যে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে গিয়েছিল, সেই বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসে দারিদ্র্য বিমোচনে বিশ্বকে বাংলাদেশ থেকে শিখতে বলে। বাংলাদেশ এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ, এগিয়ে যাচ্ছে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার দিকে। দেশের ভালোর জন্য শেখ হাসিনা গোয়ার কিন্তু সবসময় অনঢ় নন। জনগণের দাবির মুখে সরে আসেন আড়িয়ল বিলে বিমানবন্দর স্থাপনের সিদ্ধান্ত থেকে। তবে রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে অনঢ় অবস্থান, পরিবেশের প্রতি তাঁর ভালোবাসার সমান্তরাল নয়। আধুনিক প্রযুক্তির কারণে হয়তো কম হবে, তবে রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দরবনের দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হবে, এটা প্রায় নিশ্চিত। তবুও আমি ধরে নিচ্ছি, সরকারের দাবিই সত্য, ক্ষতি হবে না। তবুও জনগণের আবেগ বিবেচনায় নিয়ে রামপাল প্রকল্প থেকে সরে আসলে তিনি সবার ধন্যবাদ পেতেন।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/28/1538127334995.jpg

শেখ হাসিনা বারবার নিজেকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের সৃষ্ট। কিন্তু সেই সমস্যার দায় এখন বাংলাদেশের কাঁধে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পোড়ামাটি নীতিতে রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে আসছে। আর শেখ হাসিনা তাদের আগলে রাখছেন মায়ের মমতায়। ১৬ কোটি মানুষের চাপে পিষ্ট বাংলাদেশের ওপর এখন ১০ লাখ রোহিঙ্গার দায়। শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চি গলায় যখন গণহত্যা আর জাতি নিধনের কলঙ্ক, তখন শেখ হাসিনাকে মানুষ বলছে ’মাদার অব হিউম্যানিটি’। শুধু আশ্রয় দিয়েই শেখ হাসিনা বসে থাকেননি। রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কূটনৈতিক লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। জন্মদিনেও তিনি ব্যস্ত জাতিসংঘে। শেখ হাসিনার এই মানবিক নেতৃত্ব প্রশংসিত হয়েছে বিশ্ব পরিমন্ডলে। আর চাপ বাড়ছে অং সান সু চির ওপর। এর আগে পার্বত্য শান্তি চুক্তি, ছিটমহল সমস্যার সমাধান করেও সবার প্রশংসা পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এবার রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে তাঁর আন্তরিক ও মানবিক উদ্যোগ তাঁকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।

নেতৃত্বের, ব্যক্তিত্বের এই চরম উৎকর্ষের সময়েই শেখ হাসিনার ইমেজে লেগেছে সবচেয়ে কলঙ্কের কালি। ৬৯ বছরজুড়েই গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করা আওয়ামী লীগের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কলঙ্ক ৫ জানুয়ারি নির্বাচন। এ যেন বিএনপির সমান হওয়ার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। বিএনপির ঝুলিতে একটা ১৫ ফেব্রুয়ারি আছে, আমাদের কেন ৫ জানুয়ারি থাকবে না? সাম্প্রতিক বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচন, আমাদের মনে করিয়ে দেয় জিয়া-এরশাদ আমলের ‘হোন্ডা-গুন্ডা-ডান্ডা, নির্বাচন ঠান্ডা’ তত্ত্ব। এটা দুর্ভাগ্যজনক। ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’র সময়েই দেশে গণতান্ত্রিক স্পেসের সবচেয়ে বড় সঙ্কটের অভিযোগ। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মতপ্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়ার শঙ্কা।

তার আমলে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে এখন বাংলাদেশে মানবাধিকার-গণতন্ত্রকে আড়াল করা হচ্ছে। এসবই সত্যি অভিযোগ। তাই মানতে বড় কষ্ট হয়। উন্নয়ন প্রশ্নে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, চীনকে উদাহরণ টেনে এসব অভিযোগকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক পন্থায় উন্নয়নই টেকসই উন্নয়ন। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্রে আমার আস্থা নেই পুরোপুরি। আমি বিশ্বাস করি ন্যায্যতার গণতন্ত্রে। আমি গণতন্ত্রের শেষ কথা মানি বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের একটি লাইনকে, ‘আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো, এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি হয় সে, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো।’ গণতন্ত্রের এই চেতনায় বিশ্বাস করেন শেখ হাসিনাও। ২০০৮ সালে নির্বাচনে ভূমিধ্বস জয় পাওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘বিরোধী দলকে আমি সংখ্যা দিয়ে গুণবো না।’ কিন্তু সেই চেতনা থেকে কি শেখ হাসিনা সরে গেছেন? তবে আরেকটি নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ হাসিনা বারবার অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আকাঙ্খার কথা বলছেন। বলছেন, 'জনগণ ভোট দিলে ক্ষমতায় আসবো, নইলে নাই'। আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু হলেই ৫ জানুয়ারির কলঙ্কের দাগ কিছুটা মুছবে।

দেশ অনেক এগিয়েছে, এগুচ্ছে। উন্নয়ন কাজ হচ্ছে অনেক। এখন শেখ হাসিনাকে নিশ্চিত করতে হবে দুর্নীতিমুক্ত টেকসই উন্নয়ন। নিশ্চিত করতে হবে সুশাসন। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের অনেকেই জনবিচ্ছিন্ন, কর্মীবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। অনেক এমপি নিজ নিজ এলাকায় একচ্ছত্র্য আধিপত্য কায়েম করেছেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও অনেক অভিযোগ। আওয়ামী লীগের অনেকেই বঙ্গবন্ধু বা শেখ হাসিনার সত্যিকারের চেতনা ধারণ করে না। দলের দরজা খুলে দেয়ায় বিভিন্ন দল থেকে ক্ষমতালোভী ধান্দাবাজ হাইব্রিডদের ভিড় এখন আওয়ামী লীগে। এখানে শেখ হাসিনাকে শক্ত হতে হবে, নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। এমপি-মন্ত্রীদের পাঠাতে হবে মাটির কাছে, মানুষের কাছে।

ইতিবাচকভাবে নেন, আর নেতিবাচক; শেখ হাসিনা এখন দারুণ পলিটিশিয়ান। নিজের দল তো সামলানই, সামলাতে হয় মহাজোটে থাকা জাতীয় পার্টি, জাসদের অন্তর্দ্বন্দ্বও। আমার তো কেন জানি সন্দেহ হয়, বিএনপির অনেক কলকাঠিও কি শেখ হাসিনা নাড়েন? যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার পেছনেও শেখ হাসিনার কোনো হাত থাকলেও আমি অবাক হবো না। আমরা প্রায়ই শেখ হাসিনাকে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দেই, চাপ দেই। কিন্তু যখন দেখি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর দিনে বেগম খালেদা জিয়া ঘটা করে জন্মদিন পালন করেন, যখন জানি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের হাত আছে; তখন নিজেদের পরামর্শকেই অন্যায় মনে হয়। তবু শেখ হাসিনা খালেদা জিয়াকে ফোন করেন, সন্তানের মৃত্যুতে খালেদা জিয়াকে সান্তনা জানাতে ছুটে যান। শেখ হাসিনার দৃষ্টিতে নিশ্চয়ই বিএনপি খারাপ। কিন্তু এটা তো মানতেই হবে দেশের জনগণের একটা বড় অংশ বিএনপিকে ভোট দেয়। সব দলের আদর্শ এক হবে না। তাই বলে তো বিরোধী মতকে ধ্বংস করে দেয়া যাবে না। ভিন্নমতেই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য। বিএনপি অংশ না নিলে আগামী নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কি নেবে না, সেটা তাদের ব্যাপার। তাদের জোর করে আনা যাবে না, এটাও সত্যি। কিন্তু শেখ হাসিনার আন্তরিক ইচ্ছা এবং নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে উদারতা বিএনপির নির্বাচনে আসার পথ সুগম হবে। বিএনপির নির্বাচনে আসাটা তাদের জন্য যেমন ভালো, আওয়ামী লীগের জন্যও ভালো; সবচেয়ে ভালো গণতন্ত্রের জন্য।

আগেই বলেছি, শেখ হাসিনা একসঙ্গে অনেক চরিত্রে অভিনয় করেন। শেখ হাসিনা হলেন বাঙালি মুসলমানের চিরন্তণ চরিত্র। যার দিন শুরু হয় ফজর নামাজ আর কোরান তেলাওয়াত দিয়ে, তাকেই কিনা শুনতে হয় নাস্তিকদের নেত্রীর অভিযোগ। আমি জানি তিনি ধর্মনিরপেক্ষ, সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক; তবুও ভোটের রাজনীতির বিবেচনায় তাকে সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি রাষ্ট্রধর্ম বহাল রাখতে হয়। শত্রু জেনেও হেফাজতে ইসলামকে আস্থায় রাখতে হয়। ’নাস্তিকদের নেত্রী’ এই বদনাম ঘোচাতে মেনে নেন হেফাজতের অনেক অন্যায় আবদারও।

আমি জানি, ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁকে প্রতিদিন এমন অনেক কিছু করতে হয়। দুঃখিনী রাজকন্যা শেখ হাসিনার হয়তো ইচ্ছা করে কবিতার বই পড়তে পড়তে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে; রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে পাখির মত উড়ে বেড়াতে; সেই তাকেই কিনা সারাক্ষণ থাকতে হয় এসএসএফ’এর নিরাপত্তার ঘেরাটোপে!

এত ব্যস্ততার মধ্যেও বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী শেখ হাসিনা বই পড়েন, সাহিত্যের খোঁজ খবর রাখেন। নিজে লেখালেখি করেন। কোনো অনুষ্ঠানে সুযোগ পেলেই প্রিয় গানে গলা মেলান। প্রিয় শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার জন্মদিনে টেলিভিশনের সরাসরি অনুষ্ঠানে ফোন করে চমকে দেন সবাইকে। চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্রের চিঠির জবাব দেন। ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে আসা মুক্তামনির জন্য চকলেট পাঠান। গণজাগরণ মঞ্চে যেতে চাওয়ার আকুতির কথা বলেন প্রকাশ্যে। সৈয়দ শামসুল হককে দেখতে ছুটে যান হাসপাতালে। কবির শয্যাপার্শ্বে বসেন থাকেন গভীর মমতায়। সৈয়দ হকের মৃত্যুতে স্থগিত করে দেন নিজের জন্মদিনের সব আয়োজন। শহীদ কাদরির মৃত্যুর পর তার শেষ ইচ্ছা পূরণে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কবির মরদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা করেন। কবি নির্মলেন্দু গুণ বা কবি হেলাল হাফিজের অসুস্থতার খবর শুনে তাদের ডেকে এনে পাশে দাড়ান। কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকদের বিপদে এমন মমতা নিয়ে পাশে দাড়ান; কৃতজ্ঞ হয়ে যায় সবাই। শেখ হাসিনার যেন একশোটা হাত, হাজারটা চোখ। কোনো কিছুই তার দৃষ্টি এড়ায় না।

তাঁর বক্তব্যে জীবন সম্পর্কে, চারপাশের মানুষ সম্পর্কে তাঁর পর্যবেক্ষণ দেখে আমি চমকে যাই। ছেলেরা শেভ করার সময় কল ছেড়ে রেখে পানির অপচয় করে; এ পর্যবেক্ষণ তো সাহিত্যিকের। শিশুদের শিক্ষা নিয়ে, স্কুলে শিশুদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান চমকে দেয়। ৭০ বছর বয়সেও তিনি এতটা প্রযুক্তিবান্ধব, ভাবলে অবাক হই। মাঝে মাঝে ভাবি, শেখ হাসিনা যদি প্রযুক্তিবান্ধব না হতেন, তাহলে আমরা আরো অনেক পিছিয়ে থাকতাম। আমি বারবার মুগ্ধ হই, অবাক হই; এতটা কষ্ট বুকে চেপেও এমন দৃঢ়তায় একটি দেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে যাওয়া কীভাবে সম্ভব, কীভাবেই বা সম্ভব সবকিছুর এত খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করা?

শত্রুমিত্র খুব ভালো চেনেন শেখ হাসিনা। এটা চিনেছেন তিনি পরিবারের সবাইকে হারিয়ে। তবুও তিনি বিশ্বাস করেন, ক্ষমা করেছি, কিন্তু ভুলবো না। তাই তো মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্যরা তার দলের এমপি হন; ১৫ আগস্ট যিনি বঙ্গবন্ধুকে পালানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন, সেই কাপুরুষ সেনাপ্রধানও বরিত হন আওয়ামী লীগে। যাদের জন্মই হয়েছিল আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করার জন্য, সেই জাসদ নেতারা তার মন্ত্রিসভায় থাকেন দাপটের সঙ্গে। ১৫ আগস্টের পর যিনি স্বনামে সম্পাদকীয় লিখেছিলেন, সেই তিনিও শেখ হাসিনার ক্যাবিনেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ওয়ান ইলাভেনের মাইনাসপন্থিরাও তার চারপাশে ভিড়ে যায় অনায়াসে। শত্রুকে ক্ষমা করে দেয়ার এই মহৎ গুণটিও তিনি পেয়েছেন, তাঁর পিতার কাছ থেকে। শেখ হাসিনা জেনেশুনেই করেন এসব। তিনি জানেন, সুযোগ পেলে তার চারপাশের অনেকেই ছোবল মারার জন্য বিষ সঞ্চয় করছেন, তবুও শত্রুকে অনুগত রাখতে, চোখে চোখে রাখতেই বুঝি ভালো লাগে তার।

আমার এতকিছু ভালো লাগে না। আমার ভালো লাগে শেখ হাসিনাকে। প্রধানমন্ত্রী নয়, বিশ্বনেত্রী নয়, জননেত্রী নয়, গণতন্ত্রের মানসকন্যা নয়; সবসময়ই শেখ হাসিনাকে আমার মনে হয় পাশের বাড়ির মমতাময়ী বড় বোন।

৭২তম জন্মদিনে শেখ হাসিনার জন্য শুভেচ্ছা। দেশের স্বার্থেই তাঁর শতায়ু চাই।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ।