‘সিনহাসন’

  • এরশাদুল আলম প্রিন্স, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ছবি: বার্তা২৪

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ছবি: বার্তা২৪

গত বছরের ১৪ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে দেশত্যাগ করেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। এর আগে ২ অক্টোবর ছুটির আবেদন করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা। এর পর ১০ নভেম্বর অস্ট্রেলিয়া থেকেই প্রধান বিচারপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন বাংলাদেশের ২১তম প্রধান বিচারপতি। এরপর আর দেশে আসা হয়নি। মাঝে মাঝে বিদেশের সভা-সমিতিতে যোগ দিয়েছেন। টুকটাক আলোচনায়ও ছিলেন।

এসকে সিনহা প্রধান বিচারপতির দায়িত্বভার নেয়ার পর থেকেই ছিলেন আলোচনায়। প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর থেকেই বিচার বিভাগের সঙ্গে আইন ও শাসন বিভাগের বিদ্যমান টানাপোড়েন দৃশ্যমান হতে থাকে। এই টানাপোড়েনের এক পর্যায়ে তিনি পদত্যাগ করেন বা মতান্তরে পদত্যাগে বাধ্য হন। দায়িত্ব নেন বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবেই তাকে পদত্যাগ করতে হয়।

বিজ্ঞাপন

বিচারপতি হিসেবে তিনি কী চেয়েছিলেন আর কী করতে সক্ষম হয়েছিলেন সেটি একটি ঘটনার প্রশ্ন। বিচার বিভাগ মানুষের শেষ ভরসাস্থল। আর প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানীত (ওয়ারেন্ট অব প্রেসিডেন্সি অনুযায়ী নয়) ও দায়িত্বশীল পদ। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় স্পিকারের পরেই তার স্থান। কিন্তু মর্যাদায় তিনি অনন্য। রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ করলেও মানুষ তার কাছেই করে। সে নালিশ শোনার ও বিচারা করা এখতিয়ার তার আছে।

প্রধান বিচারপতি সিনহা চেয়েছিলেন রাষ্ট্রে আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাক। এই আশা করতে প্রধান বিচারপতি হওয়া লাগে না। রাষ্ট্রের একজন সাধারণ মানুষও এ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখতেতো বিনিয়োগ করতে হয় না। দায়িত্ব পাওয়ার আগে অনেক স্বপ্ন দেখা যায়। কিন্তু গদিতে বসার পর সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারে কয়জন? বিচারপতি সিনহাও স্বপ্ন দেখেছেন। পদত্যাগান্তে দেশত্যাগের এক বছর পর মনে হয়েছে তার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। একটি বই রচনা করে জাতিকে সেই স্বপ্ন ভঙ্গের বিস্তারিত বয়ান করেছেন বিচারপতি সিনহা। খুবই স্বাভাবিক। এতো আর আমাদের মতো অধম আম-জনতার স্বপ্ন না। প্রধান বিচারপতির স্বপ্ন বলে কথা। কাজীর স্বপ্নভঙ্গ হলে রাজ্যের প্রজাকুলেরও ঘুম হারাম হয়। কাজীর স্বপ্ন সহিহ হলে সমস্যা নেই, কিন্তু দু:স্বপ্ন বা অপস্বপ্ন হলেই রাজ্যে যতো গণ্ডগোল। বিচারপতি সিনহা দেশের আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন। এটিই স্বাভাবিক। কিন্তু এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি ভূমিকা রেখেছেন সেটিই বড় কথা। তার আমলে বিচার বিভাগের ওপর মানুষের আস্থা কি বেড়েছে? বিচার বিভাগের দুর্নীতি কি কমেছে। মামলার জট কি কমেছে। বিচারাঙ্গনে সুশাসনের সূচক কি বেড়েছে? কাজেই তার স্বপ্ন ভঙ্গ হওয়াই স্বাভাবিক। জানি ও মানি-একদিনে এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব না। কিন্তু রাজনীতির দোষ না দিয়ে নিজের সাধ্যমতো চেষ্টা করাই আন্তরিকতার বহি:প্রকাশ। এসব সমস্যা সমাধানকল্পে তিনি কি কি ব্যবস্থা নিয়েছেন সেসবই দেখার বিষয়।

বিচারপতি সিনহা তার বইটির নাম দিয়েছেন ‘আ ব্রোকেন ড্রিম: রুল অব ল, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড ডেমোক্রেসি’৷ ৬১০ পৃষ্ঠার এই আত্মজবানীমূলক বইটিতে বিচারপতি সিনহা তার জীবনের সংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি একজন আইনজীবী ও পরিশেষে আইনের রক্ষক। তার বইয়ে তার আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইতিবৃত্তও তুলে ধরেছেন। সে্ সাথে তিনি দেশের বিচার ব্যবস্থার বাস্তব চিত্রও তুলে ধরেছেন।

আগেই বলেছি, রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি হয়নি। কাগজে-কলমে সবাই স্বাধীন, কিন্তু বাস্তবতা অস্বীকার করা যায় না। সব সরকারের আমলেই এটি একটি বাস্তবতা। ফলে, বিচারপতি সিনহার বইয়ে সব আমলের কথাই এসেছে। যেমন, বইটির ‘ইমারজেন্সি’ অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর কীভাবে আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও ছাত্রলীগের ছেলেদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা করা হয়েছে। ছাত্রলীগের ছেলেদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা পর্যন্ত দায়ের করা হয়েছে। তাদেরকে গ্রেফতার করে জেল-হাজতে পাঠানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘I also released most of the Awami League leaders on bail “. সে জন্য তাকে সরকারের রোষানলেও পড়তে হয়েছে। তিনি বলেন, This enraged the government in power. Moudud Ahmed, then Law Minister openly criticized me on the floor of Parliament castigating me as a diehard Awami League supporting judge and for showing undue favor to Awami League leaders “.

এটাই বাস্তবতা। রায় পক্ষে গেলে ন্যায়বিচার পেয়েছি, আর বিপক্ষে গেলে দেশে ন্যায়বিচার নাই। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রশ্নের মামলায় বিচার বিভাগকে আমরা চরমভাবে বিতর্কিত করে ফেলেছি। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের পর হয়তো মওদুদ আহমদরাই মিষ্টি বিতরণ করেছেন (বইয়ের এক জায়গায় আছে)। কিন্ত সেদিন এই মওদুদ আহমদরাই আওয়ামী লীগ নেতাদের জামিন দেয়ার জন্য বিচারপতি সিনহার সমালোচনা করেছেন। ফলে, বিচার বিভাগের বিদ্যমান সমস্যার পাশাপাশি শাসন বিভাগের সাথে এ টানাপোড়েনের জন্য বিচার বিভাগের অবস্থা আরো সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। এর স্বাভাবিক ফল হিসেবে দেশের মানুষ ন্যায়বিচারের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।

দেশে জরুরি অবস্থাকালীন প্রেক্ষাপটের একটি বর্ণনা দিয়েছেন বিচারপতি সিনহা। সেই সঙ্গে কী পরিস্থিতিতে তিনি দেশ ত্যাগ করেছেন তাও লিখেছেন। বইটির মাধ্যমে দেশের বিচার বিভাগ তথা রাজনীতির অন্দরমহলের অনেক কথাই সামনে এসেছে যা রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনায় রসদ যোগাবে।

দেশত্যাগের সময় গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে একটি চিরকূট ধরিয়ে দিয়েছিলেন বিচারপতি সিনহা। এবার ধরিয়ে দিয়েছেন আরেকটি বই। বোঝাই যাচ্ছে, আলোচনায় থাকবেন তিনি আরো অনেক দিন। সামনে নির্বাচন। অনেকে একে ষড়যন্ত্রের অংশই বলে ফেলেছেন। না পড়ে অনেক রাজনীতিক ইতিমধ্যেই মন্তব্য করে ফেলেছেন। অনেকে আবার সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। কোনো দলেরই সমালোচনা ভালো লাগে না। আমার সমালোচক আমার শত্রু এটাই সবার বিশ্বাস। তবে, সে যাই হোক, তার এ আত্মজবানী দেশের রাজনীতি, আইনাঙ্গন ও বিচারাঙ্গনের পর্দার অন্তরালের অনেক অজানা ঘটনাই উঠে এসেছে।

বিচারপতি সিনহা গদিচ্যূত হয়েছেন। সিংহাসন হারিয়েছেন। তার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। কিন্তু এ স্বপ্ন ভঙ্গের দায় কার? তিনিও কি পুরোপুরি দায়মুক্ত?