মুক্তিযোদ্ধার মৃতদেহ বাঁশে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখে পাকসেনারা

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আজ সোমবার (১০ ডিসেম্বর) নড়াইল মুক্ত দিবস।  ছবি: বার্তা২৪.কম

আজ সোমবার (১০ ডিসেম্বর) নড়াইল মুক্ত দিবস। ছবি: বার্তা২৪.কম

আজ সোমবার (১০ ডিসেম্বর) নড়াইল মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে নড়াইলের মুক্তিপাগল দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে তাদের হাত থেকে নড়াইলকে মুক্ত করে।

সোমবার সকালে নড়াইল মুক্ত দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল, নড়াইল প্রেসক্লাব, চিত্রা থিয়েটারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিনটিকে উদযাপন করছে।

বিজ্ঞাপন

কর্মসূচির মধ্যে সকাল ৭টায় বঙ্গবন্ধুর মুর‌্যাল, স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ভ, জজকোর্ট সংলগ্ন বধ্যভূমি স্মৃতিস্তম্ভ ও রূপগঞ্জ ওয়াপদায় গণকবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন, বিশেষ মোনাজাত, র‌্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

এ সময় জেলা প্রশাসক আনজুমান আরা, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. ইয়ারুল ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) কাজী মাহাবুবুর রশিদ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবাস চন্দ্র বোস, সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান জিন্নাহ, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট গোলাম কবীরসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।

জানা যায়, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক মানুষের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে স্বাধীনতার যে আহ্বান ছিল নড়াইলের মুক্তিপাগল জনতা তা থেকে পিছপা হয়নি। ওই সময় নড়াইলের এসডিও’র বাসভবনকে স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের হাই কমান্ডের সদর দপ্তর করা হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন নড়াইলের এসডিও কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, এমএনএ খন্দকার আব্দুল হাফিজ, এমপিএ শহীদ আলী খান, আওয়ামী লীগ নেতা এখলাছ উদ্দিন, বিএম মতিয়ার রহমান লোহাগড়া হাইস্কুলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও নড়াইলের সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের এক করে বিশাল বাহিনী যশোর অভিমুখে পাঠিয়ে দেন।

৬ এপ্রিল সকালে পাক হানাদার বাহিনী দুটি জেট বিমান হতে নড়াইল শহরের ওপর ব্যাপক ভাবে মেশিনগানের গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে প্রচুর ক্ষতি করে। এরপর নড়াইল শহর জন শূন্য হয়ে পড়ে। ১৩ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর একটি দল নড়াইল শহরের চৌরাস্তায় রেস্টুরেন্ট মালিক মন্টুকে গুলি করে আহত করে এবং হরিপদ সরদার, ভাটিয়া গ্রামের কালু বোস, সরসপুর গ্রামের প্রফুল্য মিত্রকে ধরে নিয়ে দাইতলা পুলের কাছে গুলি করে ফেলে রেখে চলে যায়।

এদিকে ক্যাপ্টেন দোহারের উদ্যোগে লোহাগড়ার ইতনা ও আড়িয়ারায় প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। এ কারণে মধুমতি-নবগঙ্গা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের ভাটিয়াপাড়াস্থ হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প হতে তাদের দোসরদের সহযোগিতায় গানবোট যোগে ইতনা গ্রামে নৃশংস অভিযান চালিয়ে ওই গ্রামের ৫৮ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করা হয়। ওই সময় নড়াইলের জামায়াত নেতা মাওলানা সোলায়মানের নেতৃত্বে ‘শান্তিবাহিনী গঠিত হয়’।

এ বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে দেশপ্রেমিক শত শত মানুষকে ধরে এনে নড়াইল ডাকবাংলোয় আটকে রাখা হত। এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগ এনে মাওলানা সোলায়মান রেজিস্ট্রারে যাদের নামের পাশে লালকালি দিয়ে ‘রিলিজ ফর ইভার’ লিখে দিত, তাদের গভীর রাতে নড়াইল শহরের লঞ্চঘাটের প্লাটুনের ওপর নিয়ে গিয়ে গলা কেটে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়া হত। এভাবে মাওলানা সোলায়মান চেনা অচেনা সহস্রাধিক মানুষকে গলা কেটে হত্যা করে বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়।

ব্যক্তিগত আক্রোশে মাওলানা সোলায়মান নিজগ্রাম তুলারামপুরের আওয়ামী লীগের সদস্য, নড়াইল ভিসি স্কুলের মাস্টার আতিয়ার রহমান তরফদার, আ. সালাম তরফদার, রফিউদ্দিন তরফদার, মাহতাব তরফদার, মোকাম মোল্যা, কাইজার মোল্যা, মকবুল হোসেন সিকদার ও চাচড়া গ্রামের ফয়জুর রহমানসহ অনেককে ধরে এনে শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকায় নিয়ে হত্যা করে কবর খুঁড়ে সেখানে পুতে রাখে।

এছাড়া নকসালরা পেড়লী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আ. হামিদ মোল্যা, আবুয়াল হোসেন, নায়েব নজির হোসেনসহ অনেককে হত্যা করে।

এভাবে শত কষ্টের মাঝেও দেশ হানাদার মুক্ত করার এক দুর্জয় আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে সদর থানায় উজির আলী, লোহাগড়া থানায় মোক্তার আলী, কালিয়া থানায় ওমর আলী এবং মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে সদর থানায় শরীফ হুমায়ুন কবীর, লোহাগড়া থানায় শরীফ খসরুজ্জামান, কালিয়া থানায় আব্দুল মজিদ সরদারকে নিযুক্ত করা হয়। পরে তারা নড়াইলে প্রবেশ করে।

অক্টোবর মাস হতে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুক্তিপাগল মানুষের মনে এক বিশ্বাস জন্মাতে থাকে যে হানাদার বাহিনী বা তাদের দোসররা আর বেশিদিন টিকতে পারবে না। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকেই নবগঙ্গা নদীর উত্তর ও পূর্বাঞ্চল হানাদার মুক্ত হয়ে যায়। লোহাগড়া থানা পাক হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিকে ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার গণ আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়।

তবে তারা আত্মসমর্পণ না করায় ৮ ডিসেম্বর শরীফ খসরুজ্জামান, দবির উদ্দিন, ইউনুস আহমেদ, লুৎফর মাস্টার, আলী মিয়া, লুৎফর বিশ্বাসসহ আরও অনেক গ্রুপ এক হয়ে সম্মিলিত ভাবে তিন দিক থেকে লোহাগড়া থানা আক্রমণ করে। প্রচন্ড যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৮ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী এস এম ফজলুর রহমান জিন্নাহের নেতৃত্বে নড়াইল কলেজের দক্ষিণে মাছিমদিয়া গ্রামে সমবেত হয়ে পুলিশ-রাজাকারদের ওপর অতর্কিত হামলা চালালে এই যুদ্ধে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা জয়পুরের মিজানুর রহমান হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন।

মিজানুর রহমানের মৃতদেহ হানাদার বাহিনীর দোসররা হাত-পা বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে রাখে। পরে নড়াইল শহর প্রদক্ষিণ করে কৃতিত্ব দেখায় এবং ছবি তোলে। এ ঘটনার পর ৯ ডিসেম্বর রাতে বিজয়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কমান্ডার ফজলুর রহমান জিন্নাহ, আমির হোসেন, উজির আলী, শরীফ হুমায়ুন কবীর, আ. হাই বিশ্বাসের নেতৃত্বে বর্তমান নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ চালায়। তবে পাল্টা আক্রমণে বাগডাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান শহীদ হন। এ সময় শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোতে অবস্থানরত ৪০ জন পাক মিলিটারিকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে তারা অস্বীকার করেন। এ সময় মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা চারদিক থেকে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করলে পাক মিলিটারিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এখানে কয়েকজন পাক মিলিটারি নিহত হয় এবং অন্যদের জেলহাজতে পাঠানো হয়।

প্রবল ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা সারা রাত শহরে বিজয় উল্লাস করতে থাকে ও জয় বাংলা স্লোগানে শহর মাতিয়ে তোলে এবং ১০ ডিসেম্বর সকালের দিকে নড়াইলকে পাক হানাদার মুক্ত ঘোষণা করা হয়। পরে মুক্তি পাগল হাজারো জনতার উপস্থিতিতে ডাকবাংলো প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তলন করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধে নড়াইলের ৫ জন খেতাবপ্রাপ্ত হলেন- ল্যান্স নায়েক বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ, বীর উত্তম মুজিবুর রহমান, বীর বিক্রম আফজাল হোসেন, বীর প্রতীক খোরশেদ আলম ও বীর প্রতীক মতিয়ার রহমান।