অঘোর মন্ডল: আপাদমস্তক এক রিপোর্টার

  • আপন তারিক
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ক্রীড়াঙ্গন ও গণমাধ্যমের পরিচিত মুখ ক্রীড়া সাংবাদিক অঘোর মন্ডল

ক্রীড়াঙ্গন ও গণমাধ্যমের পরিচিত মুখ ক্রীড়া সাংবাদিক অঘোর মন্ডল

খবরটা শোনার পর থেকেই মাথাটা ঝিম ধরে আছে!

দমবন্ধ লাগছে, মনে হচ্ছে ভীষণ মন খারাপের কান্না একদম দলা পাকিয়ে গলার মধ্যে আটকে আছে। গত কিছুদিন ধরেই অঘোর দা অসুস্থ; দাদার জন্য প্রার্থনা হচ্ছিল। দাদার সঙ্গে একদিন মাঝে কথাও হলো। কিন্তু তিনি এভাবে ৫৮-তেই আউট হয়ে যাবেন কল্পনাও করিনি!

বিজ্ঞাপন

অন্তর্জালের পাতায় আজ শোকস্তব্দ সহকর্মীদের স্ট্যাটাস পড়তে পড়তেই মনে হলো-অঘোর (মন্ডল) দাকে চিনতে হলে রিপোর্টার অঘোর দা-কে আগে জানতে হবে! উনার ভেতরে সব সময়ই একজন রিপোর্টার বাস করতো। মনপ্রাণে তিনি একজন রিপোর্টার!

ভোরের কাগজের একটা অংশ থেকেই তখন প্রথম আলোর জন্ম। তারপর আমরা এক সময় প্রদায়ক থেকে ভোরের কাগজ স্পোর্টসের অংশ। ময়মনসিংহ রোড, বাংলামটরে আমাদের স্পোর্টস রুমটা দোতালায়; একদম রাস্তার পাশে। আমাদের রুমটাই ছিল আড্ডার বড় একটা জায়গা। ঢাকার মাঠ থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঘরের খবর- যেখানে মাঝে মধ্যেই অমিত দা, পুলক দা, খোকন ভাই এসে যোগ হয়ে যেতেন।

২০০১ সালের দিকে অঘোর দা তখন রীতিমতো সুপার স্টার রিপোর্টার! বিসিবি রেডিও-তে খেলার আয়োজনে ল্যান্ডফোনের এ প্রান্ত থেকে প্রতি সপ্তাহে তিনি থাকবেনই। টেলিফোন অপারেটর মিন্টু ভাইকে আগেই বলে রাখতেন- আজ লন্ডন থেকে কল আসবে। তারপর কাংখিত সময়ে কল আসতেই দাদা একটানে বলে যেতেন দেশের ক্রীড়াঙ্গনের খবর। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম সেসব।

আবার যখন পায়চারি করতে করতে আমাদের একের পর এক আইডিয়া দিয়ে যেতেন। একটানা যা বলতেন তা যদি ঠিকঠাক লিখে দেওয়া যেতো তবে দারুণ একটা রিপোর্ট হয়ে উঠতো। কিন্তু আমরা সেসব ঠিকঠাক তুলতে পারতাম না বলে কতো কথা শুনেছি দাদার। লেখা মনের মতো না হওয়ায় কতোবার যে বাস্কেটে ফেলে দিতেন। কড়া ভাষায় বিরক্তি প্রকাশও করতেন। আমার কাছে সেসব এক আর্শিবাদ মনে হয়! কারণ তিনি আমার সাংবাদিকতার শিক্ষক!

অঘোর মন্ডল কখনো ডেস্কে বসে থাকাটা পছন্দ করতেন না। এ কারণেই আমাদের প্রত্যেকেই মাসুদ (আলম) ভাই, মনি ভাই (তারেক মাহমুদ), (মাসুদ পারভেজ ) বাবু, রাকিবুল হাসান, শেষে যোগ দেওয়া জাহিদ চৌধুরী আমাদের প্রত্যেকেই মাঠ মুখো করতেন! আর শুধু ক্রিকেট-ফুটবল নয় সব খেলাতেই ফোকাস রাখতে বলতেন। নিজেও দুই হাতে লিখে যেতেন। কখনো বা আবার শামসুল হক টেংকু ভাইয়ের দুর্দান্ত একেকটা ছবি ধরেই লিখে ফেলতেন লম্বা গল্প!

দেশের বাইরে কোন সিরিজ হলে দাদা যাবেন এটা আমরা প্রায় ধরেই নিতাম। কিন্তু বিমানে ওঠার আগ অব্দি সেটা ক্লিয়ার করতেন না বলে আমরা প্রায়ই হাসাহাসি করতাম। দাদাও সম্ভবত এসবে বেশ মজা পেতেন। তখনকার সময়ে দেশের বাইরে থেকে নিউজ পাঠানোর একটাই মাধ্যম ছিল সাংবাদিকদের। এমনও হয়েছে আমাদের ভোরের কাগজের ফ্যাক্স নষ্ঠ, টিকাটুলিতে ইত্তেফাক কিংবা ইনকিলাব অফিসে দাদা ফ্যাক্স পাঠাতেন। সেখান থেকে সংগ্রহ করে সেসব সামলে নিতো আমাদের কাউকে। আমরা তারপর মন দিয়ে পড়তাম সেসব ট্যুর ডাইরি, ম্যাচ রিপোর্ট, ইন্টারভিউ কিংবা এক্সক্লুসিভ কিছু। ভোরের কাগজের সেইসব দিনই ক্যারিয়ারের সেরা দিন মনে হয় এখনো!

তারপর একদিন ভোরের কাগজের মিলন মেলা ভাঙল। আমরাও একেকজন একেক জায়গায়! কিন্তু আমার কাছে তিনি আজন্ম আমার গুরু হয়েই থেকেছেন। তিনিও সেই দিনও আমাদের সেই ছোট্টটি মনে করেই একেকটা কথায় পুরোনো দিন ফিরিয়ে এনেছিলেন। ২০২২ অস্ট্রেলিয়া বিশ্বকাপে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের সামনে বৃষ্টি ভেজা দুপুরে সেদিন হঠাৎ ভুত দেখার মতো করেই দাদাকে দেখে চমকে গিয়েছিলাম। বরাবরের মতোই কাউকে কিছু না জানিয়ে বিশ্বকাপে হাজির দাদা। ততোদিনে অবশ্য ভোরের কাগজ, চ্যানেল আই, দীপ্ত টিভি ছাড়িয়ে এটিএন নিউজের বার্তা সম্পাদক তিনি।

তবে খেলার জগতের মায়া কখনোই ছাড়িয়ে যেতে পারেননি তিনি। মেলবোর্নে আমিনুল ইসলাম বুলবুল ভাইয়ের বাসায় উঠেছিলেন দাদা। সেদিন শহর থেকে ফেরার পথে বেরউইকের পাশে ফেডারেল ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে ফেরার পথে দাদার সঙ্গে দারুণ কিছু মুহুর্ত এখনো মনে আছে। বুলবুল ভাই আর দাদার কথায় ওঠে আসছিল পুরোনো সেই ক্রীড়াঙ্গন আর এখনকার সময়ও। অঘোর দা খেলা ছাড়া ওইভাবে কিছু ধারণও করতে চাইতেন না বলে আড্ডার একটাই অনুসঙ্গ স্পোর্টস!

নিউজ খোঁজের অদ্ভুত একটা বাতিক ছিল তার। দারুণ সব শব্দের খেলায় পাঠককে আটকে রাখতেন। বাক্যের বিন্যাসে গল্পের আদলে রিপোর্ট তৈরির ওস্তাদ কারিগর ছিলেন আমাদের অঘোর দা। ক্যাপশন-শিরোনাম তৈরিতেও সিদ্ধহস্ত।

এই জীবন পরিক্রমা কী অদ্ভুত! আজ নিজেই তিনি শিরোনাম; পত্রিকা, অনলাইন, ফেইসবুক সর্বত্র!