ওলি পোপ যেন ধু ধু মরুভূমিতে পানির কুয়োর দেখা পেয়েছেন। ইংল্যান্ডের অন্য ব্যাটাররা যখন রান না পেয়ে হাপিত্যেশ করছেন, পোপের ব্যাটে ছুটেছে রানের ফোয়ারা। রানের সে বারিধারায় ভেসে এখন বড় লিডের খোঁজে ইংল্যান্ড। তার ১৪৮* রানের ইনিংসে চড়ে দিন শেষে অস্ট্রেলিয়ার লিড গিয়ে ঠেকেছে ১২৬-এ।
তৃতীয় দিনের শুরুটা স্বাগতিক ভারতের মনমতো হয়নি। ৭ উইকেটে ৪২১ রান নিয়ে দিন শুরু করে তারা। অথচ ১৫ রান যোগ করতেই শেষ তিন উইকেট খোয়া যায় তাদের। ৪৩৬ রানে অলআউট হওয়া ভারত লিড পায় ১৯০ রানের।
ইংলিশদের পক্ষে বোলিংয়ে চমক দেখান দলের ’চতুর্থ স্পিনার’ জো রুট। ৭৯ রানে ৪ উইকেট নেন এই অফব্রেক বোলার।
প্রথম ইনিংসে অতি আক্রমণাত্মক বাজবল খেলতে গিয়ে হাড়গোড় বেরিয়ে পড়ে ইংলিশ ব্যাটিং লাইনআপের। তবু দ্বিতীয় ইনিংসেও নিজেদের সে আদর্শ ছেড়ে দেয়নি ইংল্যান্ড। তাতে ইংল্যান্ডের দুই ওপেনার জ্যাক ক্রলি (৩১) এবং বেন ডাকেট (৪৭) সেট হয়েও উইকেট ছুঁড়ে দিয়ে এসেছেন।
তবে তিনে নামা ওলি পোপ সে ধারায় কিছুটা ছেদ টানেন। বাজবলের উন্মত্ততার চেয়ে দেখেশুনে খেলাকে প্রাধান্য দেন এই ২৬ বছর বয়সী এই ব্যাটার। তাতে দিন শেষে দলের সবচেয়ে বড় ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন পোপ। ২০৮ বলে ১৪৮ রানের ইনিংস খেলে এখনো ব্যাটিংয়ে আছেন তিনি।
ইংল্যান্ডের লিডকে বড় করতে আপাতত একাই সংগ্রাম করতে হচ্ছে পোপকে। পরের ব্যাটারদের মধ্যে শুধু উইকেটকিপার-ব্যাটার বেন ফোকস কিছুটা সঙ্গ দিয়েছিলেন তাকে। ষষ্ঠ উইকেটে এই দুজনের জুটি থেকে আসে ১১২ রান।
তবে অক্ষর প্যাটেলের নিচু হয়ে আসা বলে ফোকস (৩৪) বোল্ড হয়ে ফিরলে আবারও সঙ্গীহীন হয়ে পড়েন পোপ।
এদিকে ব্রিসবেন টেস্টে জয় দেখছে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া। দ্বিতীয় ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ১৯৩ রানে বেঁধে ফেলে তারা। যার ফলে ২১৫ রানের লিড নিয়েইও সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। তিনটি করে উইকেট নিয়ে ক্যারিবিয়ানদের বড় লিডের স্বপ্ন ধূলিসাৎ করেন জশ হ্যাজেলউড এবং নাথান লায়ন।
২১৬ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে তৃতীয় দিন শেষে অস্ট্রেলিয়ার সংগ্রহ ২ উইকেটে ৬০ রান। জয়ের জন্য আর ১৫৬ রান। ৩৩ রানে ব্যাট করছেন ওপেনার স্টিভেন স্মিথ, ৯ রান নিয়ে তাকে সঙ্গ দিচ্ছেন ক্যামেরন গ্রিন।
পুনের উইকেট বেশ ভালোভাবেই ‘পড়তে’ পেরেছিল নিউজিল্যান্ড। স্পিনাররাই এখানে রাজত্ব করবেন তা অনুমান করে টস জিতে আগেভাগে এই উইকেটে তারা ব্যাটিং বেছে নেয়। তবে একটা গোটা দিনও ঠিক পারেনি নিউজিল্যান্ডের ইনিংস। গুটিয়ে যায় তারা ২৫৯ রানে। পুনের এই উইকেট যে স্পিনস্বর্গ সেই প্রমান তো স্কোরবোর্ডই দিচ্ছে।
নিউজিল্যান্ডের ১০ উইকেটের সবগুলো শিকার করলেন ভারতের দুই স্পিনার। ওয়াশিংটন সুন্দর ক্যারিয়ার সেরা ৫৯ রানে ৭ উইকেট পেলেন। বাকি ৩ উইকেট রবিচন্দ্র অশ্বিনের নামের পাশে যোগ হলো। প্রথমদিনে ৭৯.১ ওভারের মধ্যে ভারতের দুই পেসার জাসপ্রিত বুমরা ও আকাশ দ্বীপ দুজনে মিলে করলেন মাত্র ১৪ ওভার।
শেষ বিকেলের আলোয় ব্যাটিং করতে নেমে ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা শূন্য রানে বিদায় নিলেন। দিনটা শেষ করল ভারত ১ উইকেটে ১৬ রান তুলে।
পুনের স্পিন সহায়ক উইকেটে শুধুমাত্র ডিফেন্স করলে টিকে থাকা যাবে না। এটা জেনেই নিউজিল্যান্ড রক্ষনের সঙ্গে আক্রমণের মিশেল-এই কৌশলে ব্যাটিং করলো। টপঅর্ডারে ডেভন কনওয়ে ও রাচিন রাবিন্দ্র দুজনেই হাফসেঞ্চুরি পান। শেষের দিকে স্পিনার মিচেল স্যান্টার ৫১ বলে ৩৩ রান করেন।
২০২১ সালের পর ভারতীয় টেস্ট দলে সুযোগ পেয়ে এই ম্যাচে নেমেই বল হাতে চমক দেখান অফস্পিনার ওয়াশিংটন সুন্দর। ক্যারিয়ারে এর আগের ৪ ম্যাচে তার অর্জনে ছিল মাত্র ৬ উইকেট। আর পুনের এই ম্যাচে এক ইনিংসেই ৫৯ রান খরচায় শিকার করলেন ৭ উইকেট। অন্যপ্রান্ত থেকে তার সঙ্গে উইকেট শিকারে নামেন অশি^ন। ২৪ ওভারে ৬৪ রান খরচায় তার শিকার ৩ উইকেট। সুন্দর ৭ ও অশ্বিন ৩, এতেই শেষ নিউজিল্যান্ডের প্রথম ইনিংস।
পুনের উইকেটে স্পিনের বাঁক দেখে নিউজিল্যান্ডের মিচেল স্যান্টার ও আয়াজ প্যাটেলের চোখও চকচক করছে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর: নিউজিল্যান্ড প্রথম ইনিংস: ২৫৯/১০ (৭৯.১ ওভারে, কনওয়ে ৭৬, রাবিন্দ্র ৬৫, স্যান্টার ৩৩, সুন্দর ৭/৫৯, অশ্বিন ৩/৬৪)।
বাংলাদেশের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে সাকিব আল হাসানের শেষ ম্যাচটা হতে পারত এই মিরপুর টেস্ট। তবে নানা জটিলতায় তা আর হয়নি। সাকিবকে ছাড়াই বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হয়েছে।
তবে সাকিবকে নিয়ে পরিস্থিতিটা আরও জটিল হয়েছে, সহজ নয়। তিনি বিপিএলে খেলতে পারবেন কি না, আর কখনো বাংলাদেশের মাটিতে খেলতে পারবেন কি না, তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
সাকিবের জন্যও এসব সামলানো বেশ কঠিন। এমন পরিস্থিতিতে সবারই সাকিবের পাশে দাঁড়ানো উচিত বলে জানালেন জাতীয় দলের অলরাউন্ডার মেহেদি হাসান মিরাজ।
তিনি আজ সাকিব প্রসঙ্গে মিরাজ উত্তর দিয়েছেন একাধিক প্রশ্নের। সাকিবের দেশে আসতে না পারা, এই সিরিজে না থাকার বিষয়ে মিরাজ বলেন, ‘সাকিব ভাইয়ের ইস্যুটা আমরা সবাই জানি। সে কীসের জন্য আসেনি, খেলতে পারেনি, এটা আমার মনে হয় না যে কারো অজানা। অবশ্যই সে লিজেন্ড, সে বাংলাদেশের জন্য অনেক অর্জন করেছে। এই পরিস্থিতিতে তার পাশে দাঁড়ানো উচিত।’
দেশের মাটিতে সাকিবের বিদায়ী টেস্ট খেলতে না পারা নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তও। টেস্ট শুরুর আগে তিনি বলেছিলেন, ‘আসলে দুর্ভাগ্যজনক। হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা সবাই জানি কেন হয়নি। এটা নিয়ে আসলে টেস্টের আগের দিন কথা বেশি বাড়াতে চাই না। আমি চাই প্রতিটা খেলোয়াড় খেলায় ফোকাস করুক।’
সাকিব আল হাসান খেলা মানে একাদশে একজন বাড়তি খেলোয়াড় নিয়ে নামা, এমন কথা শেষ অনেক দিন ধরেই শোনা যেত। তবে এবার থেকে সে বিলাসিতাটা আর করতে পারবে না দল। সাকিব যে বিদায়ের ঘোষণাই দিয়ে দিয়েছেন।
সাকিবের শূন্যস্থান কে পূরণ করবেন, সে প্রশ্নের জবাবে ম্যাচ শুরুর আগে অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত বলেছিলেন মেহেদি হাসান মিরাজের নাম। বলেছিলেন, ‘মিরাজ খুব ভালো বিকল্প হতে পারে। আমার মনে হয় টেস্ট ক্রিকেটে খুবই ভালো করছে ও, বোলিং ব্যাটিং দুইটাতেই। তবে আমার মনে হয় আরও উন্নতির জায়গা আছে। ও দায়িত্বটা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত। শেষ কয়েকটা টেস্ট যদি দেখেন, মিরাজ খুব ভালো ব্যাট করছে, দলকে খুব ভালো অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে। আমার বিশ্বাস আগামী কয়েক বছরে মিরাজ ওই জায়গাটা ভালোভাবে নিতে পারবে।’
মিরাজ তা অনেকাংশে করেছেনও। বল হাতে সাকিব হতে পারেননি, তবে ব্যাট হাতে ঠিকই ত্রাতা হয়েছেন। ৯৭ রানের ইনিংস খেলে তিনি দলকে বাঁচিয়েছেন ইনিংস হারের মুখ থেকে।
যেমন পারফর্ম্যান্সই করুন না কেন, সাকিবের বিকল্প হওয়ার ভাবনা মিরাজের মগজে খেলে না। মিরাজ জানালেন, তিনি মিরাজই হতে চান। তিনি বলেন, ‘আপনারা সবসময় বলেন সাকিব ভাইয়ের জায়গায় আমি আসব। সাকিব সাকিবের জায়গায় আমি আমার জায়গায়। একটা খেলোয়াড়ের সঙ্গে আরেক খেলোয়াড়ের তুলনা না করাটাই বেস্ট আমার মনে হয়।’
কেন, সেটাও জানিয়ে দিলেন তিনি। তার কথা, ‘সাকিব ভাই কিন্তু অনেক বড় অ্যাচিভমেন্ট করেছে বাংলাদেশ দলের জন্য। ১৭ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছে। সে একজন লিজেন্ড। আমি রান করা শুরু করেছি ২-১ বছর। সাকিব ভাই শুরু থেকে রান করেছে। আমরা জানি সাকিব ভাইয়ের অর্জন কত। আমি যেখানে ব্যাট করি ৭-৮ নম্বরে। সাকিব ভাই ওপরে খেলেছে। এটা কঠিন, তবে আমার যখন সুযোগ এলে চেষ্টা করব দলের প্রয়োজনে ভালো ক্রিকেট খেলার।’
নতুন বলের জন্য অপেক্ষায় ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। আর সেই সঙ্গে অপেক্ষায় ছিল দু’প্রান্ত থেকে সেই বলে পেসারদের বোলিংয়ের। সেই কারণে আগের দিন বিকেলে নতুন বল নেওয়ার সুযোগ থাকলেও তারা সেই সুবিধা নেয়নি। কারণ তখন আলোর স্বল্পতার জন্য শর্ত হিসেবে পেস বোলারদের বোলিংয়ের সুযোগ ছিল না। চতুর্থদিন সকালে নতুন বল এবং পেস বোলিং, যথেষ্ট আলো- সবকিছুই পেল দক্ষিণ আফ্রিকা। আর তাতেই তাদের মনোবাসনা পূর্ণ।
আগেরদিনের ৭ উইকেটে ২৮৩ রান নিয়ে খেলতে নামা বাংলাদেশের ইনিংস গুটিয়ে দিতে তাদের সময় লাগলো মাত্র ২৯ বল। এই সামান্য সময়ে বাংলাদেশ যোগ করলো মাত্র ২৪ রান। ব্যক্তিগত ক্ষতি আরেকটা হলো মেহেদি হাসান মিরাজের। সেঞ্চুরি বঞ্চিত হলেন তিনি। সঙ্গীহারা হয়ে পড়ার চিন্তায় দ্রুতগতিতে সেঞ্চুরির জন্য ঝুঁকি নিয়ে ব্যাট চালিয়ে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে আউট হলেন মেহেদি। তখন তার রান ৯৭, দলের ৩০৮।
বিয়োগফল জানাল এই ম্যাচ জিততে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন মাত্র ১০৬ রান। মামুলি এই রান তুলতে দক্ষিণ আফ্রিকা তিন উইকেট হারালেও ম্যাচ জিতলে ৭ উইকেটের দাপটেই। মিরপুরের উইকেটে চতুর্থ ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য টার্গেটের স্বাস্থ্য আরো বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। চতুর্থদিনের সকালে সেটাই করতে পারেনি বাংলাদেশ।
সকালের খেলা শুরুর আগে সতীর্থ ধারাভাষ্যকার আতহার আলীকে প্রশ্ন করছিলেন, এই ম্যাচে এখন বাংলাদেশের ব্যাটিং কৌশল কি হওয়া উচিত? আতহারের চটজলদি উত্তর-‘ প্রথম শর্ত হলো উইকেট হারানো যাবে না।’ কিন্তু বাংলাদেশ দল সকালে ব্যাটিংয়ে নেমেই যে আতহারের দেওয়া সেই শর্ত ভাঙল সবার আগে।
নতুন বলে একপ্রান্তে কাগিসো রাবাদা অন্যপ্রান্তে মুল্ডার এই দুই ডানহাতি পেসারের সামনে ব্যাটসম্যানরা পুরোদুস্তর অসহায়। রাবাদা দিনের তৃতীয় বলেই সাফল্য পান। অন্যপ্রান্ত থেকে তাইজুলকে ফেরান মুল্ডার। শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে উইকেটে আসেন হাসান মাহমুদ। মেহেদি হাসান মিরাজ তখন নব্বইয়ের ঘরে। সঙ্গী হারা হয়ে সেঞ্চুরি যেন মিস না হয় সেজন্য খানিকটা অস্থিও হয়ে পড়েন মেহেদি। সেই দুঃশ্চিন্তা ঝাড়তে শট খেলার জন্য যে ভঙ্গিতে ব্যাট চালান তাতে রান হয় না, উইকেট যায়। হলোও তাই!
১০৬ রানের সামান্য টার্গেটের পথে ব্যাট করতে নেমে দক্ষিণ আফ্রিকা সকালের বাকিটা সময় যা করলো তার নাম ব্যাটিং আনুষ্ঠানিকতা।
এই ম্যাচ চতুর্থদিনের সকালে এসে হারলেও বাংলাদেশ মুলত হেরেছে আরো অনেক আগেই; সেই প্রথমদিনের ব্যাটিং ব্যর্থতায়। দল যেদিন মাত্র ১০৬ রানে গুটিয়ে যায়, সেদিন!
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ ১০৬ ও ৩০৭
দক্ষিণ আফ্রিকা ৩০৮ ও ১০৬/৩
ফল: দক্ষিণ আফ্রিকা ৭ উইকেটে জয়ী