প্রথম ইনিংসের মতো দ্বিতীয় ইনিংসেও বাংলাদেশ দল পড়ে গিয়েছিল ঘোর বিপদে। ইনিংস হারের শঙ্কা চোখ রাঙানি দিচ্ছে তখন। ঠিক সে সময় মেহেদি হাসান মিরাজ চলে এলেন দলের ত্রাতার ভূমিকায়।
শুরুতে জাকের আলীর সঙ্গে, পরে একা হাতেই দলকে টেনে নিয়ে গেছেন চতুর্থ দিনের সকালে। তিনি নিজেও এগোচ্ছিলেন সেঞ্চুরির দিকে। তবে শেষমেশ সেঞ্চুরি আর হয়নি। তিন অঙ্ক থেকে তিন রান দূরে থাকতে থামে তার ইনিংস।
তার এমন ইনিংস প্রশংসা কুড়িয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়কেরও। এইডেন মার্করাম জানালেন, তার মতে মিরাজের সেঞ্চুরিটা প্রাপ্যই ছিল।
প্রোটিয়া দলনেতা বলেন, ‘নতুন বল খেলাটা বেশ কঠিন ছিল ব্যাটার হিসেবে। গতকাল বা তার আগের দিনও তারা (বাংলাদেশ) ভালো জুটি গড়েছে। বল নরম ছিল কিছুটা। উইকেট তুলতে আমাদের অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অনেক কৃতিত্ব দিতে হবে তাদের। মেহেদী দারুণ খেলেছে। সেঞ্চুরিটা তার প্রাপ্য ছিল। চ্যালেঞ্জ ছিল অনেক। তবে আমরা তা মানিয়ে নিয়েছি অনেক পরিশ্রম করে। অবশ্যই বাংলাদেশকে এখানে কৃতিত্ব দিতে হবে।’
মিরাজের সেঞ্চুরি প্রাপ্য বললেও বাংলাদেশকে হারাতে পেরে খুশি মার্করাম। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই দারুণ খুশি। সব ক্রিকেটাররাই প্রতিদ্বন্দ্বীতা চায়। সবাই চায় যত বেশি সম্ভব ম্যাচ জিততে। ভালো দল গড়ার শর্ত হল, নিয়মিত এটা করতে পারা। এটাই সামনে আমাদের রোমাঞ্চিত করছে। এখন এটি দল হিসেবে আমাদের জন্য গর্বের ব্যাপার। আমরা বেশ খুশি।’
সিরিজ শুরুর আগে দুই অধিনায়কই বাংলাদেশকে এগিয়ে রেখেছিলেন। প্রথম টেস্টে সেখানে বাজিমাত করল দক্ষিণ আফ্রিকা। যা আবার ২০১৪ সালের পর উপমহাদেশে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম জয়।
তারপর দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক এইডেন মার্করাম এসেছিলেন সংবাদ সম্মেলনে। কথা বলেছেন এই জয়ের মাহাত্ম্য, নিজেদের পারফর্ম্যান্স নিয়ে। এখানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও।
এই সংবাদ সম্মেলনের চুম্বকাংশ বার্তা২৪.কম-এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো–
উপমহাদেশে ১০ বছরে প্রথম টেস্ট জয়
আমার মনে হয় এটা বিশেষ কিছু। এত অল্পবয়সী এবং অনভিজ্ঞ দলের জন্য এখানে এসে জয় পাওয়া আমাদের ড্রেসিং রুমে যে পরিবেশ সৃষ্টি করে, তা দারুণ। এটা আমাদের কিছুটা আত্মবিশ্বাস দেবে যে আমরা আপাতদৃষ্টিতে পরিস্থিতিতেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারি। আমাদের ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্য বেশ একটা আত্মবিশ্বাস দেবে এই জয়।
দশ বছর পর জয়
আমি মনে করি এই জয়টাকে হেলায় দেখার মতো কিছু নেই। আমি নিজেও কয়েক বছর ধরে খেলছি, আমিও উপমহাদেশে কখনও জিতিনি। তাই এটা আমাদের জন্য বিশেষ একটা মুহূর্ত। সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো দল হিসেবে আমাদের আত্মবিশ্বাস অর্জন। এটা আমাদের দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে, যেন আমরা ধারাবাহিকভাবে ভালো পারফরম্যান্স করতে পারি, যা একটা সত্যিকারের ভালো দল গড়ে তোলে। আমরা ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হওয়ার অপেক্ষা করছি এখন।
বিশেষ পারফরম্যান্স
এটা দারুণ। কাগিসো দীর্ঘদিন ধরে আমাদের জন্য একজন সুপারস্টার। তার ৩০০ উইকেট পাওয়ার মতো পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে সে একজন বিরল প্রতিভা। আমরা সত্যিই ভাগ্যবান যে সে আমাদের দলে আছে এবং ভালো করছে।
কাইলের ক্ষেত্রে আমি মনে করি এটা তার জন্য একটা বিশেষ মুহূর্ত। সে কিছু সময়ের জন্য দলের বাইরে ছিল। ম্যানেজমেন্ট তার প্রতি আস্থা দেখিয়েছে। এখন সে স্বস্তিবোধ করছে। সে স্পিন ভালো খেলে। সাবকন্টিনেন্টে তার প্রথম টেস্টেই সেঞ্চুরি, এটা একটা অসাধারণ অর্জন।
অনুভূতি–
এটা আমাদের জন্য একটা সুন্দর অনুভূতি। তবে একটা ভালো দল তৈরি করার জন্য নিয়মিত এমন পারফরম্যান্স করতে হবে এবং তা বজায় রাখতে হবে। এটা আমাদের পরবর্তী টেস্টের জন্য উজ্জীবিত করবে। তবে এই মুহূর্তে, এটা আমাদের জন্য গর্বের মুহূর্ত।
আইপিএলের অবদান
নিঃসন্দেহে এটা আমাদের সাহায্য করেছে। কারণ আপনাকে দীর্ঘ সময় ধরে সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে শিখতে। এবং আইপিএল একটা দীর্ঘ টুর্নামেন্ট, প্রায় ২ মাসের। আমি ভাগ্যক্রমে তিনবার আইপিএল খেলেছি। মোট ৬ মাসের ব্যাটিং অভিজ্ঞতা আছে এই পরিস্থিতিতে। এটা আমাকে স্পিন খেলায় উন্নতি করতে সাহায্য করেছে।
স্পিন ও পেসারদের বিরুদ্ধে পরিকল্পনা
ব্যাটিংয়ের দিক থেকে স্পিন মোকাবেলা করতে হলে, আমি মনে করি ব্যাটারদের স্বাধীনতা দিতে হবে, যাতে তারা নিজস্ব ঢঙে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারে। এটাই মূল আলোচনা ছিল। নিজেদের শক্তির উপর ভরসা করে নিজেদের সেরাটা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া। এবং দেখা যাক তা কেমন ফল নিয়ে আসে।
আপনি কাইলের দিকে তাকান, সে ভালোভাবে সুইপ করেছে। এটা দেখতে ভালো লাগে যে ছেলেরা তাদের শক্তির উপর বিশ্বাস রেখেছে।
আর পিছনে তাকালে, এখানে মাঝেমধ্যে যে পরিমাণ সিম মুভমেন্ট এবং অপ্রত্যাশিত বাউন্স ছিল, হয়তো একটা অতিরিক্ত পেসার থাকা ভালো হতো। আমি মনে করি দুই দলই এতে একমত হবে।
প্রতিপক্ষ প্রসঙ্গে–
মেহেদী অসাধারণ ইনিংস খেলেছে। শতকের যোগ্য ছিল। তারা আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছিল; আমাদের সত্যিই অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে।
বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে প্রথম টেস্টে হেরেছে ৭ উইকেটে। তবে পরিষ্কার করে বললে দলের হাত থেকে ম্যাচটা বেরিয়ে গিয়েছিল প্রথম দিনেই। ১০৬ রানে অলআউট হওয়ার পরই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ।
এরপর দ্বিতীয় ইনিংসেও টপ অর্ডার মুখ থুবড়ে পড়ে। প্রথম পাঁচ উইকেট চলে যায় ১০৬ রান তুলতে। এমন পরিস্থিতি থেকে আর যাই হোক, ম্যাচ জেতা যায় না। বাংলাদেশ জিততে পারেওনি।
ব্যাটিংয়ে দলের ব্যর্থতার বিষয়টা মেনে নিলেন মেহেদি হাসান মিরাজ। তবে দলের এই ব্যাটিং ব্যর্থতার কারণ কী? সে বিষয়ে মিরাজও আছেন অন্ধকারেই। সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না টপ অর্ডারের এমন মুখ থুবড়ে পড়ার। তার ভাষ্য, ‘ডিসিশন মেকিংটা গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো আমাদের কিছু জায়গায় অভাব আছে, এ কারণে হয়তো ব্যাটিংয়ে ফল্ট করছি।’
তবে টপ অর্ডারের রান যে গুরুত্বপূর্ণ, সে জানা কথাটাই আরও একবার শোনালেন তিনি। বললেন, ‘আমার কাছে যা মনে হয় যে, উপরের দিকে জুটি গুরুত্বপূর্ণ, টপ অর্ডার থেকে ভালো শুরু পাওয়া যেতে পারত, তাহলে পরের ব্যাটারদের জন্য সহজ হতো। পাকিস্তানে প্রথম টেস্টে টপ অর্ডার, মানে তিন চার নম্বর থেকে শুরু করে ভালো একটা স্টার্ট দিয়েছিল। ওপেনাররাও একটা ভালো শুরু দিয়েছে, তারাও ভালো খেলেছে। পরে যারা ছিল তাদের কাজটা সহজ হয়ে যায়।’
টেস্টে নতুন বল সামলানোর কাজটা বেশ ঝক্কির। এই দায়িত্বটা বর্তায় টপ অর্ডারের ওপর। তবে বেশিরভাগ সময়ই সে দায়িত্ব পূরণে ব্যর্থ হচ্ছেন টপ অর্ডার ব্যাটাররা। তাতে খানিকটা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে যান পরের ব্যাটাররাও, জানালেন মিরাজ।
তিনি বলেন, ‘টেস্ট ক্রিকেটে আপনি দেখেন যে পাঁচ ছয়ের ব্যাটার যদি নতুন বল খেলতে হয়, তাহলে একটু কঠিন হয়ে যায়। অবশ্যই সেটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। যে টপ অর্ডাররা কীভাবে সফল হতে পারে, বেশিরভাগ টেস্ট ক্রিকেটে যেন সফল হতে পারি, সেজন্য আমরা কথা বলছি। আশা করছি সামনে যে টেস্টগুলো আছে, আমরা বুঝতে পারব যে আমাদের কোন জায়গায় অভাবগুলো আছে।’
শেষ কয়েক ম্যাচে মেহেদি হাসান মিরাজ হয়ে গেছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভরসার নাম। দ্বিতীয় ইনিংসে সেঞ্চুরির খুব কাছে চলে গিয়েছিলেন তিনি। যদিও শেষমেশ তাকে থামতে হয়েছে সেঞ্চুরি থেকে ৩ রান দূরে থাকতে।
সেঞ্চুরি মিস হয়ে গেলে তা পোড়ায় সবাইকেই। তবে মিরাজকে তার চেয়ে বেশি পোড়াচ্ছে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে না পারার হতাশা।
গতকাল সন্ধ্যায় স্পিন কোচ মুশতাক আহমেদ এসে জানিয়ে গিয়েছিলেন, তার বিশ্বাস ২০০ রানের লিড দেওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ তখন ৮১ রানের লিড নিয়ে দাঁড়িয়ে।
আজ সকালে শেষ তিন উইকেট নিয়ে বাংলাদেশ যোগ করতে পারল আর মাত্র ২৪ রান। কাগিসো রাবাদা আর ভিয়ান মুলডারের সামনে নতুন বল সামলাতেই পারেনি স্বাগতিকরা। মিরাজ নিজে শেষ ব্যাটার হিসেবে আউট হয়েছেন ৯৭ রানে। দলের লিডটা গিয়ে ঠেকে মাত্র ১০৫ রানে।
মিরাজ হতাশ মূলত এ কারণেই। তিনি বলেন, ‘সেঞ্চুরি মিস হয়ে গেলে একটা ব্যাটারের খারাপ লাগে, অবশ্যই খারাপ লাগছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সেঞ্চুরি করার চেয়ে যে প্ল্যান নিয়ে খেলছিলাম, সেটা এক্সিকিউট করতে পারলে ভালো লাগত। সেঞ্চুরি নিয়ে চিন্তা করিনি। চিন্তা করছিলাম দলকে কোন অবস্থানে নিয়ে যাওয়া যায়।’
তিনি গতকাল যখন ক্রিজে এসেছেন, তখন দল কাঁপছে ১০৬ রানে ৫ উইকেট খুইয়ে। সেখান থেকে দলকে মিরাজ নিয়ে গেছেন ৩০৭ রানে। এর আগেও ২৬ রানে ৬ উইকেট খুইয়ে বসেছিল দল, এমন আরও অনেক পরিস্থিতি থেকে দলকে ভদ্রস্থ অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার কাজ করেছিলেন মিরাজ।
তিনি জানান, এমন পরিস্থিতিতে তিনি উপভোগ করেন বেশ। তার ভাষ্য, ‘আমি সব সময় কঠিন পরিস্থিতি উপভোগ করার চেষ্টা করি। বেশি কিছু চিন্তা করি না। চিন্তা করার চেষ্টা করি, আমার জন্য এটা সুযোগ। ভালো করলে তো হিরো হওয়ার সুযোগ থাকে।’
চলতি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রান তার দখলে। এই সব রানই এসেছে ৬ থেকে ৮ নম্বরে ব্যাট করে। আরও ওপরে ব্যাট করার ইচ্ছে আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে মিরাজ তা ছেড়ে দেন টিম ম্যানেজমেন্টের ইচ্ছের ওপর।
তিনি বলেন, ‘ওপরের দিকে ব্যাট করতে পারি কি না, এটা আসলে ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত। যারা দল নির্বাচন করবে, তারা দলের ভালোর কন্য সিদ্ধান্ত নেবে।’