বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ক্রমেই বাড়ছে জাতীয় পার্টির দূরত্ব। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, বিবৃতি শুরু হলেও এখন মাঠে শক্তি প্রদর্শনের পথে হাঁটা দিয়েছে উভয় পক্ষই।
জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের দোসর ঘোষণা দিয়ে প্রতিহত করার ঘোষণা দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় রংপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে জাতীয় পার্টি।
জাতীয় পার্টির ঘোষণার পর সারজিস আলম রংপুরে গেলে লাঠি ও ঝাড়ু মিছিল করে প্রতিবাদ জানায়। এরপর থেকে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন ৫ আগস্ট সেনাপ্রধানের বৈঠক ও রাষ্ট্রপতির বৈঠকে ডাক পাওয়ায় বেশ উৎফুল্ল ছিল জাতীয় পার্টি। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিনেই তাদের দুই প্রধান কার্যালয় আক্রান্ত হলেও তারা বিষয়টি চেপে গিয়েছিলেন। সবই ঠিকঠাক চলছিল, নাম ঘোষণা হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অভিনন্দনও জানান জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের।
বিরোধের সূত্রপাত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘনিষ্ঠ গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি মো. নুরুল হকের (ভিপি নুর) বক্তৃতার মাধ্যমে। ভিপি নূর বলেন, জাতীয় পার্টির মতো একটি পরগাছা, পা চাটা দালালকে জায়গা দেওয়া হবে না। জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতির ভাইরাস এই ভাইরাস কিভাবে বঙ্গভবনে আসে! জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।
ভিপি নূরের ঘোষণার পর থেকেই দৃশ্যপট বদলে যেতে শুরু করে। ১২ আগস্ট বিএনপি-জামায়াত এবং ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করলেও ডাক পায়নি জাপা। দ্বিতীয় দফার বৈঠকেও ডাক পায়নি জাতীয় পার্টি। জনশ্রুতি রয়েছে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে অনেক দেন দরবারও করা হয় বৈঠকের জন্য।
এরইমধ্যে জিএম কাদের ও শীর্ষ নেতাদের নামে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। প্রতিক্রিয়ায় জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, জাতীয় পার্টি নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে অন্যায় করা হচ্ছে, এই অন্যায় আমরা মেনে নেবো না। আমরা রাজপথে মিথ্যা মামলার প্রতিবাদ করবো।
১৭ অক্টোবর জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়ামের সভায় জিএম কাদের বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জাতীয় পার্টির নেতা-কর্মীরা রক্ত দিয়েছে, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানির বিরুদ্ধে প্রয়োজনে রক্ত দিয়ে এর প্রতিবাদ করা হবে। আমরা রাজপথে মিথ্যা মামলার প্রতিবাদ করবো। জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে আমাদের সাথে অবিচার হচ্ছে। ওই সভাতেই ২ নভেম্বর প্রতিবাদ সমাবেশ করার ঘোষণা দেওয়া হয়।
জাতীয় পার্টি যখন ২ নভেম্বর প্রতিবাদ সমাবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন ২৮ অক্টোবর রাত ৯টার দিকে কাকরাইল পাইওনিয়ার রোডে অবস্থিত জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে আট-দশজনের একটি টিম এসে হুমকি-ধামকি দিয়ে যায়। তারা জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে থাকা কয়েকটি ব্যানারে আগুন নিয়ে চলে যায়। পরে জাতীয় পার্টি প্রতিবাদ মিছিল করে জবাব দেয়।
জাতীয় পার্টির যুগ্ম দফতর সম্পাদক মাহমুদ আলম বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, বৃহস্পতিবার (৩১ অক্টোবর) সন্ধ্যায় জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের প্রস্তুতি কমিটির সভা চলাকালে একদল যুবক হামলা চালানোর চেষ্টা করে। পরে নেতাকর্মীরা তাদের ধাওয়া দেয়।
ওই ঘটনার পর পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে মশাল মিছিল করে ছাত্র-জনতা। মিছিলটি পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দিকে রওয়ানা দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পল্টনের দিক থেকে এসে কিছু যুবক অফিসের নীচতলায় আগুন দেয়।
দলটির কয়েক বছর ধরেই মাঠে দৃশ্যমান কোন কর্মসূচি দেখা যায়নি। সাধারণ জনগণের ইস্যুতে সংসদে বক্তৃতা আর বিবৃতির সীমাবদ্ধ ছিল দলীয় কার্যক্রম। একদিকে এক তরফা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যাওয়ার রোষ, অন্যদিকে জনদুর্ভোগ নিয়ে তাদের নিরবতা দিনদিন সাধারণ জনগণ থেকে দূরে সরে দেয়। পাশাপাশি নেতৃত্বের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।
সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের হাতে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভাঙনের রেকর্ড গড়েছে। জাতীয় পার্টি নামে ৬টি রাজনৈতিক দল মাঠে বিচরণ করছে। প্রত্যেক দফায় অনেক প্রভাবশালী নেতাদের হারিয়েছে দলটি। আবার অনেক সময় এরশাদের এক তরফা সিদ্ধান্তের কারণে অনেক নেতা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। সর্বশেষ এরশাদের সহধর্মিণী রওশনের নেতৃত্বে নতুন জাতীয় পার্টি গঠিত হয়েছে। রাজধানীতে কোন কর্মসূচি পালন করতে হলে যারা বিপুল সংখ্যক লোকজন নিয়ে হাজির হতেন তারা এখন রওশনের গ্রুপে ভিড়েছেন।
২০০৮ সাল থেকে নানাভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে নির্বাচন করে সংসদে থেকেছে জাতীয় পার্টি। কখনও সরকারের অংশীদার (২০০৮ ও ২০১৪) এমনকি ২০১৪ সালে একইসঙ্গে সরকার ও বিরোধীদলে থাকার বিরল নজির গড়ে জাপা। তখন পার্টির মধ্যেই তুমুল সমালোচনার মধ্যেই পুরো ৫ বছর একইসঙ্গে সরকারের মন্ত্রিসভায় ও বিরোধীদলের আসনে ছিল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি। পার্টির প্রধান হুসেইন মুহুম্মদ এরশাদ ছিলেন মন্ত্রী মর্যাদায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। আর বিরোধীদলীয় নেতার আসনে ছিলেন সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ।
২০২৪ সালের নির্বাচনে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করলেও জিএম কাদেরের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নেন জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ২৬টি আসন ছেড়ে দেওয়া হয়।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ মনে করেন, জাতীয় পার্টির কারণেই ২০১৪, ২০২৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন কিছুটা হলেও সুবিধা পেয়েছে আওয়ামী লীগ। আর ক্ষমতার ভাগ নিয়ে জাপা সাধারণ জনগণের কথা ভুলে গেছে। যদিও জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বরাবরই বলা হয়েছে, তারা চাপের মুখে নির্বাচনে গেছে। কখনও কখনও হুমকির মুখে আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকেছেন বলে দাবি করা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো থেকে সাধারণ মানুষ তাদের এই বক্তৃতা সেভাবে গ্রহণ করছে না। আর সেই ক্ষোভ থেকেই ছাত্ররা জাতীয় পার্টিকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে। জাপাও মাঠেই জবাব দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।