করোনা প্রকৃতির প্রতিশোধ নয়, মানুষের স্বেচ্ছাচারিতাই দায়ী

  করোনা ভাইরাস
  • মানসুরা চামেলী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

বিশ্বব্যাপী মহামারি করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বন্যপ্রাণী, প্রকৃতি ও পরিবেশের বিষয়গুলো সামনে আসে। প্রকৃতিতে মানুষের অবাধ স্বেচ্ছাচারিতা বিশ্বকে মহামারি করোনাভাইরাসের দিকে ঠেলে দিয়েছে বলে মার্কিন গবেষকরা দাবি করেছেন।

করোনাভাইরাস মহামারির জন্য মানুষকেই দায়ী করে গবেষকরা বলছেন, প্রকৃতির প্রতিশোধ নয়, এটা মানুষই করেছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞানীরা প্রতিবছর দুই থেকে চারটি ভাইরাস শনাক্ত করেন, যা প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘনের ফলাফল। যার কোন একটি মহামারি আকার ধারণ করে থাকে বলে জানিয়েছেন থমাস লাভজয়। ১৯৮০ সালে যিনি প্রথম ‘জীববৈচিত্র্য’ শব্দটি ব্যবহার করেন। লাভজয়কে জীববৈচিত্র্যৈর গডফাদারও বলা হয়ে থাকে।

জাতিসংঘ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো লাভজয় জানান, এই মহামারি মানুষের প্রকৃতির ওপর স্বেচ্ছাচারী আচরণ ও বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্যের ফল। বিশেষ করে এশিয়ার বন্যপ্রাণীর বাজার, ওয়েট মার্কেট এবং আফ্রিকার বন্যপ্রাণীর মাংসের বাজার— এই মহামারিগুলোর জন্য দায়ী। এটা সুস্পষ্ট যে, এসব কারণে এ ধরনের মহামারি সময়ের ব্যাপার ছিল মাত্র।

বিজ্ঞাপন

তার মন্তব্যের ওপর ভিত্তি করে সেন্টার ফর আমেরিকান প্রোগ্রেসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, এ ধরনের মহামারি ঠেকাতে যুক্তরাষ্টকে বন্যপ্রাণীর অবাধ বাণিজ্য বন্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে।

ওয়েট মার্কেট এমন ঐতিহ্যবাহী বাজার যেখানে গৃহপালিত ও বন্য জীবন্ত প্রাণীর সঙ্গে সবজি, ফল ও মাছ অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় বিক্রি হয়। এশিয়া ও আফ্রিকার লাখো মানুষের জীবিকা এই ওয়েট মার্কেটের ওপর নির্ভরশীল। এমন একটি ওয়েট মার্কেট চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে রয়েছে, যেখান থেকে কোভিড-১৯ সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা হয়। এই মার্কেটে শিয়াল, ইঁদুর, কাঁঠবিড়ালী, নেকড়ের বাচ্চা এবং সালামান্ডারসহ বেশ কয়েকটি বন্যপ্রাণী বিক্রি হয়।

নতুন নতুন ভাইরাসের জাত উদ্ভূত হচ্ছে। এজন্য লাভজয় বাজারে বন্যপ্রাণী ও ফার্মের প্রাণীকে সবসময় আলাদা রাখতে বলেন, এতে ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার কম সম্ভাবনা থাকে। গৃহপালিত প্রাণীকে বাজারে নেওয়ার ফলে বন্যপ্রাণী থেকে ভাইরাস সংক্রমিত হচ্ছে, এতে সহজেই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে।

গার্ডিয়ানকে তিনি জানান, অবৈধ প্রাণীর বাণিজ্য একটি খেলার মতো। এটা যদি হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে কালোবাজারে ছড়িয়ে পড়বে। তখন বন্যপ্রাণীর অবাধ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে যাবে।

ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম জানিয়েছে, এ বছর ইতোমধ্যে মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বব্যাপী ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে। বিশেষ করে আফ্রিকার অর্ধেকের বেশি মানুষ কর্মসংস্থান হারাতে বসেছে।

এসব কারণে করোনাভাইরাসকে প্রকৃতির প্রতিশোধ বলা যাবে না, এরজন্য দায়ী আমরাই। এজন্য বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ করতে পরিকল্পিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে, বলেন লাভজয়।

যদিও বন্যপ্রাণীর বাজার বন্ধে বিশেষজ্ঞরাও দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছেন। তারা মনে করেন, হঠাৎ করে বন্যপ্রাণীর বাণিজ্য বন্ধ করে দিলে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবেন দরিদ্র জনগোষ্ঠী।

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিস্ট ড. এমি ডিকম্যান সতর্ক করে বলেন, বন্যপ্রাণীর বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য জরুরি পদক্ষেপ দরকার তবে বৈষম্যের মাধ্যমে এ বাণিজ্য বন্ধ করা যাবে না।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক এক প্রোগ্রামে ২৫০ জন বিজ্ঞানী একটি খোলা চিঠিতে স্বাক্ষর করেছিলেন তার মধ্যে এমি ডিকম্যান অন্যতম। চিঠিতে বলা হয়, বন্যপ্রাণীর অবৈধ বাণিজ্য বন্ধে কোনো বৈষম্য করা যাবে না, কারণ অনেক অসহায় জনগোষ্ঠী জীবিকা এর ওপর নির্ভরশীল।

এই চিঠিতে আরও বলা হয়, কোভিড-১৯ সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও গরিব মানুষের ওপর। ধারণা করা হয়, এই ভাইরাসের উৎস চীনের ওয়েট মার্কেট। এ কারণে ওয়েট মার্কেটে বন্যপ্রাণী নিষিদ্ধ এবং ওষুধ তৈরিতে বন্যপ্রাণীর ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। তবে বৈষম্যমূলকভাবে এ বাণিজ্য বন্ধ করলে তা কার্যকর হবে না।

এছাড়া অরনোকিয়া ও আমাজনে কিছু আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর বন্যপ্রাণী নিষেধাজ্ঞা জারি করায় ‘তাদের জীবিকায় আঘাত’ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

ক্যামেরুন ভিত্তিক এনজিও মামা মওফোন জানায়, যাদের জীবিকা বন্যপ্রাণীকে কেন্দ্র করে, তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে এদের জীবন ব্যবস্থা ধ্বংস হবে। এদের মতো দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ভালো মাংস ও প্রোটিনের ব্যবস্থা করা সম্ভব না। তবে সবকিছু পর মানুষকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে প্রকৃতির ওপর কতটুকু খরবদারি করবে তারা।

সূত্র: গার্ডিয়ান