ঘটনাবহুল এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে বিদায় নিয়েছে ২০২৪ সাল। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়ার আগে বছরের শেষ দিনটিতে রাজধানী ঢাকার শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে, যাতে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করে জাতির সামনে পাঠ করার দাবি জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
বছরের শেষপ্রান্তে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র যখন ছাত্ররা প্রস্তুত করছিল তখন অন্তর্বর্তী সরকার থেকে জানানো হয়েছে সব রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে কথা বলে তারা জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করবেন, যা বিলম্বিত হলেও যার মধ্যে নিহিত রয়েছে সমন্বয় ও জাতীয় ঐকমত্যের বার্তা।
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের প্রশ্নে সরব হয়েছে বছরের শেষ দিনগুলো থেকেই। সরকার প্রণীত বিভিন্ন কমিশনও জোরেশোরে কাজ করছে, যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের দিকনির্দেশক হয়ে দিশা জাগাবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।
এমতাবস্থায়, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবাত্মক পরিস্থিতি পেরিয়ে বাংলাদেশ তিনটি চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে মুখোমুখি হয়েছে নতুন বছরের। একদিকে রয়েছে বিপ্লব সম্পৃক্ত ছাত্রজনতার সংস্কার ও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। অন্যদিকে রয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনের দাবি। এই দুই জনপ্রত্যাশার সমন্বয় ও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বাস্তবতা রয়েছে ত্রিভুজের তৃতীয় বাহুর মতো প্রসারিত। এই তিন সক্রিয় ইস্যুকে সঙ্গী করে বাংলাদেশে এসেছে নতুন বছর: ২০২৫ সাল।
প্রকৃতির চিরাচরিত নিয়মে সারা বিশ্ববাসীর মতোই নতুন বছরের আগমনী বার্তায় বাংলাদেশও উদ্বেলিত। যাবতীয় চ্যালেঞ্জের মধ্যেও সঞ্চারিত রয়েছে নবতর আশাবাদ। নব উদ্যমে সুন্দর আগামীর পথচলার জন্য অনুপ্রেরণার দোলা দিচ্ছে নতুন বছরের নতুন প্রতীতি ও প্রত্যয়। নতুন বছরের এই মাহেন্দ্রক্ষণে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে উন্নতির নতুন শিখরে আরোহণে অঙ্গীকারবদ্ধ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি, সিভিল সোসাইটি তথা নাগরিক সমাজের প্রতিটি সদস্য।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বাংলাদেশে ক্ষমতার নাটকীয় পরিবর্তনের পর জোর দাবি ওঠে জবাবদিহিতা ও সংস্কারের। বিশেষত, বাংলাদেশের গণতন্ত্র যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে এবং নির্বাচন ও শাসনের ক্ষেত্রে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে, সেগুলো দূরীকরণের দাবি এজন্য জানানো হয়, যাতে কুশাসন ও স্বৈরতন্ত্রের উত্থানের পথ চিরতরে বন্ধ হয়। একই সঙ্গে, এই জনপ্রত্যাশা জাগ্রত হয়েছে যে, সমাজ ও রাজনীতিতে বিভাজন দূর হয়ে মানুষে-মানুষে সম্প্রীতি, সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন যেন আরও জোরদার হয় এবং বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে মৌলিক রাজনৈতিক বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
নববর্ষের প্রাক্কালে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, "ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার লাখো শহিদের রক্ত ও গত জুলাই-আগস্ট মাসে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতাকে সর্বদা সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করছে। আমরা দেশকে ভালোবাসবো, দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করবো এবং যেকোনো সন্ত্রাসবাদকে প্রতিহত করবো।'' তিনি নতুন বছরে দেশের সামগ্রিক রূপান্তরের একটি পর্বে উপনীত হওয়ার আশা পোষণ করেন এবং অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।
নতুন বছরে অমিত সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ, এমন আশা কেবল শাসনের সঙ্গে জড়িতরাই নন, সকল মানুষের কামনা। সাধারণ মানুষ চায়, বাংলাদেশ থেকে চিরদিনের জন্য দূর হয়ে যাক সব অন্যায়-উৎপীড়ন, নির্যাতন, দুর্নীতি ও কুশাসন। সকলেই এমন একটি জাতি নির্মাণের প্রত্যাশা করেন, যেখানে প্রত্যেকটি নাগরিকই গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রত্যেকের কণ্ঠ স্বাধীন থাকবে।
এদিকে, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও এ প্ল্যাটফরমের নেতাদের নিয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই এই দলের আত্মপ্রকাশ হতে পারে। নতুন বছরে রাজনীতির মাঠে নতুন এই দলের আবির্ভাব বদলে দিতে পারে পরিস্থিতি। তবে, অতীতের মতো কিংস পার্টির রূপে নতুন দল এলে তা রাজনীতির মাঠে কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে কিনা, সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনাযোগ্য বিষয়।
সামগ্রিকভাবে, ২০২৫ সালে একদিকে বিপ্লবী ছাত্রতরুণদের পক্ষে সংস্কার ও পরিবর্তনের দাবি আর অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর তরফে নির্বাচনের দাবির মাঝখানে একটি সমন্বয়রেখা টানার বিষয়টিই সবচেয়ে জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রূপে প্রতিভাত হতে পারে। যে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করার দিকেই সরকারকে সর্বাধিক মনোযোগী হওয়ার আবশ্যকতা বছরে সূচনালগ্নেই অনুভূত হচ্ছে।
আশাবাদী বাংলাদেশের কাছে ঘটনাবহুল ২০২৪ সাল কঠিন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, ছাত্র-জনতার আত্মদান এবং অধিকার হারানোর যন্ত্রণা নতুন বছরে যেমন বেদনার্ত করবে সবাইকে, অন্যদিকে তেমনিভাবে নতুন উদ্যোমে শান্তি, সম্প্রীতি ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের অধিকার তথা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পুনঃপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ঐকমত্য নিয়ে কাজ করার তাগিদ বহুলভাবে উদ্বুদ্ধ করবে সবাইকে। জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন ও ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সমূহ শক্তিশালী করা ও অর্থনীতির পুনরুদ্ধারসহ বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনে আশাও পুনরুজ্জীবিত হবে সংস্কারের পথে ধাবমান ২০২৫ সালের বাংলাদেশে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে বৈষম্যের পতনের স্মৃতিমাখা বছরের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে আগামী দিনগুলোকে শুধরে নেওয়ার প্রস্তুতি নতুন বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সবাইকে উদ্বেলিত করছে। ফলে অতীত অবক্ষয়ের চিহ্নগুলো সংস্কার ও পরিবর্তনের সমান্তরালে উত্থাপিত গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে চিরতরে মুছে দিয়ে বৈষম্য, দুর্নীতি ও কুশাসনমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পুনরুজ্জীবনে জাতীয় ঐকমত্যভিত্তিক সমন্বিত প্রচেষ্টাই ২০২৫ সালের অন্তর্নিহিত বার্তা।
ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।