করোনা: ডাক্তার আসিবার পূর্বে যেন রোগী মারা না যায়!

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

করোনা আতঙ্কে জনশূন্য ইউরোপের হোটেল, মার্কেট, এভিনিউ/ছবি: সংগৃহীত

করোনা আতঙ্কে জনশূন্য ইউরোপের হোটেল, মার্কেট, এভিনিউ/ছবি: সংগৃহীত

বাল্যকালে বিদ্যালয়ে টেন্স বা কাল সম্পর্কে ছাত্রদের পরীক্ষা করার জন্য প্রশ্নপত্রে একটি প্রশ্ন ঘুরে-ফিরে দেওয়া হতো। তখন ছিল সাধুভাষার যুগ। প্রশ্নের ধরনও ছিল সেই ধাঁচের। প্রশ্নটিতে যে লাইনটির ইংরেজি করতে বলা হতো, তা ছিল, ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেলো’। কখনো প্রশ্নটি একটু ঘুরিয়ে বলা হতো, ‘স্টেশনে আসিবার পূর্বে ট্রেন ছাড়িয়া গেলো’।

বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে যাওয়া করোনাভাইরাসের আতঙ্কজনক পরিস্থিতিতে এই প্রশ্নটি মনে পড়লো। কারণ, বিশ্বের কয়েক’শ দেশ এই ভাইরাসে আক্রান্ত। করোনার প্রাদুর্ভাবে লাখ লাখ মানুষ রোগাক্রান্ত হওয়ার পাশাপাশি হাজার হাজার মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে সর্বত্র চলছে চরম প্রস্তুতি। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে বহু দেশে। সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে। ভ্রমণ বন্ধ রয়েছে। স্কুল, কলেজ, সিনেমা হল, স্টেডিয়াম, মার্কেট বন্ধ করে ভিড় ও জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বলতে গেলে, প্রায়-প্রতিটি দেশই বাস্তব ক্ষেত্রে স্বেচ্ছা-আরোপিত অবরোধের মধ্যে রয়েছে। আর্থিক ক্ষতির কথা বাদ দিলে বলা যায়, করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য পুরো পৃথিবী এখন স্থবির ও বিচ্ছিন্ন।

সঙ্গরোধে থাকা করোনার কবল থেকে বাঁচার একটি প্রধান পন্থা। ভাইরাস মহামারি আকারে ছড়াবে না যদি মানুষের ভিড় ও মেলামেশা বন্ধ হয়। বাংলাদেশেও এমন পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটা মানছে কে? কিংবা তা মানার পরিস্থিতি আদৌ রয়েছে?

আরও পড়ুন: ‘বাড়িতে সঙ্গরোধে না থাকলে কঠোর ব্যবস্থা’

শুধু তাই নয়, করোনার ভয়ে স্কুলে না এসে সঙ্গরোধ নেওয়ার কারণে মার খেয়েছে শিক্ষার্থীরা। নিজের নিরাপত্তার জন্য বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে ভিড় এড়িয়ে চলাও এদেশে সম্ভব হচ্ছে না। শিক্ষার্থীদের পেটানোর মর্মন্তুদ খবরটি বার্তা২৪.কম এ প্রকাশ পেয়েছে।

আরও পড়ুন: করোনা আতঙ্কে স্কুলে না যাওয়ায় ১৫ ছাত্রীকে মারধর

মানুষ তাহলে কোন পথে যাবে? সতর্কতা স্বরূপ সঙ্গরোধ মেনে চলবে? কিংবা তা মানতে গিয়ে মার খাবে? নাকি ভিড়ে ভারাক্রান্ত স্কুলে শিক্ষার্থীদের পাঠাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে?

লক্ষ্য করলেই বাংলাদেশের বাস্তবতায় সর্বত্র গিজগিজ মানুষ দেখতে পাওয়া যায়। একটা তামাশা দেখার জন্যও পথেঘাটে হাজার লোক জমায়েত হয়। বাসে, ট্রেনে গাদাগাদি করে চলতে হয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ঠাঁই নাই। শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলগুলোতে ডাবলিং, ট্রিপলিং চলছে। শত শত মাদরাসা, স্কুল ভাড়া বাড়িতে ঠাসাঠাসি ছাত্রছাত্রীদের বসানো হয়। এরা এমনই ছোঁয়াছুঁয়ির মধ্যে অকাতরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকির ভেতর দিয়ে দিন কাটাচ্ছে।

বাংলাদেশে আসলেই সঙ্গরোধ কতটুকু সম্ভব? এটা একটি বিরাট প্রশ্ন। তবু যদি স্কুল, কলেজ, সমাবেশ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে করোনা ছড়ানোর আশঙ্কা কিছুটা হলেও হ্রাস পায়। অপ্রয়োজনীয় ও অহেতুক জনচলাচল বন্ধ করলেও কফ, থুতু, মেলামেশা কমে ভাইরাস ছড়ানোর ভীতি কমতে পারে।

রোগ মহামারি হলে এসব করে লাভ নেই। বরং এখনই পূর্বপ্রস্তুতিতে স্কুল, কলেজ, সমাবেশ, জনচলাচল বন্ধ ও সীমিত করা দরকার। পরে, স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ক্লাস করে বন্ধের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়াও সম্ভব। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো অফিসে না এসে বাসায় বসে কাজ করার পরিবেশও তৈরি রাখা ভালো। এতে করোনাভাইরাস মহামারি আকারে ছড়ানোর বিষয়টিকে আগাম সামাল দেওয়া সম্ভব হবে।

এসব কাজ আগেভাগে করার বিষয়। রোগ হলে কঠিন লড়াই চালানোর চেয়ে পূর্বপ্রস্তুতি শ্রেয়। আর আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত দেশের মতো সুদক্ষ, চৌকস ও শক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। ফলে রোগ ব্যাপক আকারে ছড়ালে আমরা তা কতটুকু মোকাবিলা করতে পারবো, সে বিষয়েও ঘোরতর সন্দেহ আছে। ফলে আমাদের জন্য রোগ প্রতিরোধে যত বেশি পূর্বপ্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়, ততই মঙ্গল।

আমাদের প্রত্যাশা হওয়া উচিত, রোগ না ছড়াক। ডাক্তার আসার দরকার না হোক। পরিস্থিতি যেন ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেলো, এমন না হয়। অর্থাৎ, আমাদের উদ্যোগ ও প্রস্ততি নেওয়ার আগেই যেন চরম বিপদজনক পরিস্থিতি নেমে আসতে না পারে। তাই, এখনি সর্বাত্মক তৎপরতায় রোগটিকে প্রতিরোধ করাই হবে সর্বোত্তম কাজ।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, বাংলাদেশের নানা স্থানে একাধিক সন্দেহভাজন রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এদেরকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তথাপি, ইতালি ও জার্মান ফেরত দুজনের ভেতর করোনা শনাক্ত হয়েছে । এই দুজন প্লেনে বা গাড়িতে যে সিটে বসেছেন বা যা যা স্পর্শ করেছেন, সেটা অন্য কেউ ব্যবহার করলে তারা অবশ্যই সংক্রমিত হবেন এবং সেটা বোঝা যাবে আরও ১৪ দিন পর।

বিদেশ থেকে আরও যারা আসছেন, তাদের শারীরিক অবস্থাও স্পষ্ট হবে ১৪ দিন পর। অতএব সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এখনই। এই রোগ এতই দ্রুত ছড়ায়, যা এড়িয়ে গেলে সামাল দেওয়া প্রায়-অসম্ভব। ইতালিতে তেমন ভয়াবহ পরিসংখ্যান দেখা গেছে।

সুতরাং করোনা নিয়ে হালকা পদক্ষেপ বা দীর্ঘসূত্রিতা না করে সাবধানতা ও সচেতনতা অবলম্বন করাই বাঞ্ছনীয়। ঘন বসতিপূর্ণ দেশে এই রোগ ছড়ালে কী ভয়ঙ্কর অবস্থা হবে, তা ভাবলেও শিউরে উঠতে হয়। উন্নত দেশগুলো যেখানে করোনাভাইরাসে কাবু, সেখানে আমাদের কী অবস্থা হবে, ভাবতেও ভয় হয়। ফলে এই ভীতি অক্টোপাসের মতো জাপটে ধরার আগেই কত দ্রুত কমিয়ে আনা যায়, সে ব্যাপারেই প্রয়োজনীয় পূর্বপ্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণই কাম্য।