করোনায় থমকে গেছে পদ্মা সেতুসহ সরকারের মেগা প্রকল্প
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে চীনের সঙ্গে বিশ্বের সকল দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। আর এ থেকে বাদ পড়েনি বাংলাদেশও। কারণ বাংলাদেশের মেগাপ্রকল্পের সরঞ্জামসমূহ সবই আসে চীন থেকে। করোনার প্রভাবে দেশের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আর তাতে সব থেকে বেশি প্রভাব পড়েছে পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেলসহ সরকারের মেগা প্রকল্পের কার্যক্রমে। ১ লাখ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা করছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।
মেগা প্রকল্পের পাশাপাশি তৈরি পোশাক, চামড়া খাত, নিত্যপণ্য এবং ফলের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে করোনাভাইরাসের কারণে বন্ধ থাকা আমদানি-রফতানি। আর তাতে কিছু কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে দ্বিগুণ। চলমান এই অবস্থা নিয়ে গত ২০ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পাঠিয়েছে এফবিসিসিআই। সারাদেশের ২৫টি সংগঠনের প্রতিনিধিদের মতামতের প্রেক্ষিতে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
প্রায় ২ মাস ধরে করোনাভাইরাসের কারণে আমদানি বন্ধ থাকায় চীন থেকে যেসব পণ্য আমদানি করা হয় তার বিকল্প উৎস জরুরি ভিত্তিতে খুঁজে বের করার সুপারিশ জানিয়েছে। সংগঠনটি বলছে, বিকল্প সূত্র থেকে এলসি খোলার মাধ্যমে পণ্য আমদানিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে সমন্বয় বাণিজ্য ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা প্রয়োজন। আমাদের দেশের বাইরের মিশনগুলোতে আউট সোর্সিং সেল খুলে স্বল্প ও দীর্ঘকালীন যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের বিকল্প উৎস খুঁজে বের করতে আগামী দিনে যাতে আর কখনো ভোগান্তিতে পড়তে না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারিভাবে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য আমদানির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
চিঠিতে বলা হয়, চীনের সঙ্গে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় বর্তমান সরকার কর্তৃক চলমান ১ লাখ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যার ফলে এসব প্রকল্পের সময় ও ব্যয় দু’টোই বৃদ্ধি পাবার কারণে দেশের অর্থনীতির উপর বাড়তি চাপ পড়বে বলে আশঙ্কা করছে। চীন থেকে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও ইকুইপমেন্ট আসতে না থাকলে অবকাঠামো উন্নয়নের এসব প্রকল্পের কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। তাই কর্ণফুলী টানেলসহ অনেক মেগা প্রকল্প সম্পন্ন করতে দেরি হওয়ার কারণে প্রকল্প ব্যয় ও সময় বৃদ্ধি পাবে।
সংগঠনটি বলছে, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। দেশের ব্যবসায় ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান অংশীদার হলো চীন।২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের মোট বাণিজ্য প্রায় ১৪.৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে আমদানি বাণিজ্যের পরিমাণ ১৩ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং রফতানি বাণিজ্যের পরিমাণ ৮৩১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের মত। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে চীনের সঙ্গে আমদানি বাণিজ্য ছিল ১১ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং রফতানি বাণিজ্য ছিল ৬৯৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশ প্রতিবছর যে আমদানি করে তার প্রায় ৩৫ শতাংশ চীনের সঙ্গে। শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, রাসায়নিক দ্রব্য, ইলেকট্রিক্যাল ইকুইপমেন্ট, ইলেকট্রনিক্সসহ সকল ধরনের তৈরি পণ্যই চীন থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। দেশের প্রধান রফতানি পণ্য পোশাক খাতের ফেব্রিক্স ও সিনথেটিক ইয়ার্নের প্রধানতম উৎস্য হচ্ছে চীন। পোশাক খাতে বিশেষ করে ওভেন খাতের কাঁচামাল যোগানের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ এবং নীট খাতে ১৫-২০ শতাংশের উৎস হচ্ছে চীন। এছাড়া অন্যান্য অনেক শিল্প খাতের প্রধান কাঁচামালের উৎস হচ্ছে চীন।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতু, পায়রা সমুদ্রবন্দর, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (উড়ালসড়ক), চট্টগ্রামের দোহাজারী-রামু-গুমদুম পর্যন্ত দ্বৈতগেজ রেলপথ, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের জন্য কর্ডলাইন, পদ্মা সেতু থেকে যশোর পর্যন্ত রেলপথ, কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল সুড়ং পথ, চট্টগ্রামে চীনা অর্থনৈতিক ও শিল্পাঞ্চল নির্মাণ, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন, ঢাকা পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানির (ডিপিডিসি) আওতাধীন এলাকায় বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ এবং ইস্টার্ন রিফাইনারি দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপন।
এফবিসিসিআইয়ের প্রতিবেদনে করোনাভাইরাসের কারণে দেশের শিল্প উৎপাদন, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য, সরবরাহ ব্যবস্থায় ও সেবাখাতে প্রভাব পড়ছে বলে উল্লেখ করা হয়। এর ব্যাখ্যায় বলা হয় সরবরাহ ব্যবস্থায় কাঁচামালের সংকটের কারণে শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হবে। এর ফলে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও প্রভাব দেখা দিবে। কাঁচামালের সংকটের কারণে রফতানি খাতেও বিরাট প্রভাব পড়বে। উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতার অর্থই হচ্ছে সেবা খাতেও সংকট দেখা দিবে। দেশের আর্থিক খাত বিশেষ করে ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ ব্যবস্থাপনা ক্ষেত্রেও সংকট দেখা দিবে। বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থায় এবং সরকারের রাজস্ব আহরণে প্রভাব পড়বে।