হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে ফসলি জমিতে পুকুর খনন!
রাজশাহীতে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তিন ফসলি জমিতে চলছে পুকুর খনন। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের সঙ্গে সখ্যতা করে খনন করছে পুকুর। খনন করা পুকুরের পাড়ে উঁচু বাধ দেয়ায় আশেপাশের কৃষিজমিতে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। ফলে অনাবাদি হয়ে পড়ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের হাজার হাজার বিঘা জমি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশ প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে পুকুরখনন কাজে ব্যবহৃত মাটি বোঝাই অবৈধ ট্রাক্টর গ্রামীণ পাকা রাস্তার বারোটা বাজাচ্ছে। আবার উপজেলা প্রশাসন থেকে দিনে অভিযান চালিয়ে যে পুকুর খনন বন্ধ করা হচ্ছে, রাতেই আবার সেই পুকুর খনন করা হচ্ছে। প্রশাসনের অভিযানের আগেই খবর পৌঁছে যাচ্ছে পুকুর খননের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কাছে। ফলে কৃষকরা উপজেলা প্রশাসনের ও থানা পুলিশের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।
কৃষক ও সচেতনমহল বলছেন, প্রশাসন পুকুর খনন সিন্ডিকেটের সঙ্গে আঁতাত করে চলছে বলেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে সাফল্য আসছে না। আবার কোনো উপজেলায় ভুক্তভোগীরা প্রশাসনের সহযোগিতাই পাচ্ছেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের দ্বারস্থ হয়েও কোনো প্রতিকার না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী হাইকোর্টের শরণাপন্ন হন। উচ্চ আদালতে শুনানি শেষে রাজশাহীর বাগমারা, পবা, গোদাগাড়ী, দুর্গাপুর ও পুঠিয়া উপজেলায় পুকুর খননের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তারপরেও থামছে না এই পুকুর খনন।
সোমবার (১৩ জানুয়ারি) সন্ধ্যার দিকে জেলার পবা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার বাগধানির পর থেকে তানোর এলাকার রাস্তার দু’ধারে লাইটের আলোর ছড়াছড়ি। এস্কেভেটর মেশিন দিয়ে চলছে পুকুর খননের মহোৎসব।
তবে পবা উপজেলায় প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দাবি- তারা নিয়মিতই পুকুর খনন ঠেকাতে অভিযান চালাচ্ছেন। তারপরও উপজেলার বড়গাছি, দারুশা, দর্শনপাড়া এলাকায় দিনের আলোতেই পুকুর খনন চলছে।
বিশেষ করে পবা উপজেলার দারুশা হাওয়ার মোড়ে ১০০ বিঘা তিন ফসলি কৃষি জমিতে অবাধে চলছে পুকুর খনন। এই একটি পুকুরেই তিনটি এস্কেভেটরে (মাটি খননকারি মেশিন) প্রায় ৫০টি ট্রাক্টর দিয়ে বিভিন্ন স্থানে পুকুর খননের মাটি বহন হচ্ছে। এতে ওই এলাকার গ্রামীণ রাস্তাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে, সেখানে পুকুর খননের ছবি তুলতেই সাত-আটজন ব্যক্তি বাধা দেন। সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পরও ছবি তুলতে দেয়নি তারা। কিছুক্ষণ পর সেখানে আসেন পুকুর খননের সঙ্গে সম্পৃক্ত মিনারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমি মাত্র একটি পুকুর খনন করছি। এখানে চারবার প্রশাসন অভিযান চালিয়েছে। তাদের ম্যানেজ করতে আমার বেশ খরচও হয়েছে। স্থানীয় সাংবাদিকসহ অনেকেই আমার কাছে থেকে সুবিধা নিয়েছে। আপনি বোঝেন না, অভিযান চলার পরেও কিভাবে পুকুর খনন চলছে।
উপজেলার দর্শনপাড়া ইউনিয়নের কোপাকান্দি মোড়েও চলছে অবাধে পুকুর খনন। পুকুর খনন সিন্ডিকেটের সদস্য কোপাকান্দির আলম ও বাবু। কয়েকদিন আগে পবা সহকারি কমিশনার (ভূমি) আবুল হায়াত অভিযান চালিয়ে পুকুর খনন বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে এখন আবারো অবাধে চলছে খনন কাজ।
ওই এলাকায় পুকুর খনন বিষয়ে কর্ণহার থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) আনোয়ার আলী তুহিন বলেন, ‘পুকুর খনন বন্ধের উদ্যোগ পুলিশ প্রশাসনের এখতিয়ার বহির্ভূত। উপজেলা প্রশাসন আমাদের সহযোগিতা চাইলে সেটা করে থাকি।’
পবা সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবুল হায়াত বলেন, পুকুর খনন কেউ করছে- এমন অভিযোগ পাওয়া গেলে অবশ্যই অভিযান চালানো হচ্ছে। ২০১৯ সালে উপজেলায় অন্তত ৩০-৩২টি অভিযান চালানো হয়েছে। ২৫টি ড্রেজার মেশিন জব্দ করা হয়েছে। কিন্তু দু-এক দিন পর তারা আবার খনন শুরু করে। এতে সামাজিক সচেতনতা জরুরি।
এদিকে, একই অবস্থা চলছে জেলার অন্য উপজেলাগুলোয়। তানোরের চান্দুড়িয়া এলাকার বিলের প্রায় সিংহভাগ জমি এখন পুকুরে পরিণত করা হয়েছে।
জেলা কৃষি অধিদফতর সূত্র জানায়, কয়েক বছর ধরেই গোদাগাড়ী, পবা, তানোর, বাগমারা, দুর্গাপুর, পুঠিয়া, মোহনপুর, বাঘা ও চারঘাট এলাকায় ফসলি জমিতে পুকুর খননের মহোৎসব চলছে। গত আট বছরে নতুন ৫ হাজার পুকুর কাটা হয়েছে। ফলে কয়েক বছরে পুকুরসহ অন্যান্য কারণে শুধুমাত্র জেলায় কৃষিজমি কমেছে ১৫ হাজার হেক্টর।