বেনাপোলে ১৫ বছরে ৪১ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ
সীমান্ত হত্যা বন্ধে দফায় দফায় দু’দেশের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে প্রতিশ্রুতি দিলেও কথা রাখেনি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে গত ১৫ বছরে কেবল যশোরের শার্শা-বেনাপোল সীমান্তেই বিএসএফের হাতে নির্মমভাবে ৪১ বাংলাদেশি হত্যার শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন আরও শতাধিক মানুষ। শুধু সাধারণ অনুপ্রবেশকারীরা নন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যও রক্ষা পায়নি বাহিনীটির নির্মমতার হাত থেকে।
গত বছরের ২২ জানুয়ারি বেনাপোল সীমান্তের আলোচিত হত্যার ঘটনা ছিল বিজিবি সৈনিক রহিসউদ্দীন হত্যাকাণ্ড। সবশেষ গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর বেনাপোলের পুটখালী সীমান্তে একই দিনে তিন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীকে নির্যাতনের পর হাত,পায়ের শিরা কেটে হত্যা করে বিএসএফ। মানবাধিকার লঙ্ঘন করে এসব হত্যাকাণ্ডের আজ পর্যন্ত একটিরও বিচার হয়নি৷ নিহতের পরিবারের সদস্যরা অনেকেই উপার্জনক্ষম মানুষদের হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ‘মাথা উঁচু করে সীমান্ত হত্যার কড়া জবাব দিতে না পারলে এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
গত ১৫ বছরে সীমান্তে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড সহ বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় বেনাপোল সীমান্ত পথে গবাদিপশু পাচার, আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা বা কাজের খোঁজে দুই দেশের মানুষ সীমান্ত পারাপার করে থাকে। এছাড়াও সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে কৃষিকাজ কিংবা মৎস্য আহরণের জন্যও অনেক মানুষকে সীমান্তের নিকট দিয়ে পথ অতিক্রম করে থাকেন। সীমান্তে চোরাচালান ও বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধের কারণ দেখিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিতর্কিত শ্যূট-অন-সাইট (দেখামাত্র গুলি) নীতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বহাল রেখেছে। এতে বিএসএফ কারণে অকারণে গুলি করে আসছে। তবে এখন গুলির পরিমাণ কমলেও নির্যাতন চালিয়ে হাত পায়ের শিরা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনা বেশি ঘটছে৷ তবে তাদের এ আক্রোশের শিকার কেবল বাংলাদেশি নাগরিকরাই । এসব হতাহতদের একটি বড় অংশ হল গবাদি পশু ব্যবসায়ী। গত ১৫ বছরে শার্শা-বেনাপোল সীমান্তেই ৪১ বাংলাদেশি হত্যার শিকার হয়েছেন। নিহত গরু ব্যবসায়ীদের পরিচয় পাওয়া গেলেও দূরদূরান্ত থেকে আসা সীমান্ত পারাপারকারী অনেক নিহত মানুষের পরিচয় মেলেনা। পরে স্থানীয়রা খোঁজখবর পেলেও মামলার ভয়ে তথ্য গোপন রাখে।
গত ১৫ বছরে শার্শা-বেনাপোল সীমান্তে হত্যার শিকার বাংলাদেশিরা হলেন, শরীফ,রাজা,শওকত, আলমঙ্গীর,জয় শিকদার,রাশেদুল ইসলাম,আব্দুল জলিল,ঈসরাফিল,মাখন মজনু,বাতেন আহম্মেদ,তরিকুল ইসলাম,মনির হোসেন,আশানুর রহমান,সফিয়ার,আমির, গফ্ফার,মজনু,
হাবিব,লিটন,সবুজ,আহম্মেদ,সাদ্দাম, সমীর,আলাউদ্দীন,হজরত,মনির,হানেফ আলী,শাহিনুর রহমান,রিয়াজুল মোড়ল,শরিফুল ইসলাম,বিজিবি সদস্য রইচউদ্দীন,শাবু হোসেন,জাঙ্গীর আলম,শাকিবুর রহমান এবং অজ্ঞাত ৬ বাংলাদেশি।
বিএসএফের গুলিতে নিহত বেনাপোলের দিঘিরপাড় গ্রামের শাহাবুরের বোন রাবেয়া খাতুন জানান, ভাইকে মেরে হাত-পায়ের শিরা কেটে ফেলে দেয় নদীতে। গুলি করে ভাইকে না মেরে জেলে দিলে একদিন ফিরে আসতো। এভাবে যে কত লোকদের মেরে ফেলতেছে তার হিসেব নাই।
নিহত বিজিবি সদস্য রইচউদ্দীনের শ্বশুর আবুল কালাম জানান, বিএসএফের গুলিতে তার জামাইয়ের নির্মম মৃত্যু আশা করেননি। এক বছর পেরিয়ে গেলেও হত্যার বিচার হয়নি। নতুন সরকারের কাছে সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।
মানবাধিকার সংস্থা, রাইটস যশোরের নির্বাহী পরিচালক বিনয় কৃষ্ণ মল্লিক জানান, মানবাধিকার লঙ্ঘন করে এসব অমানবিক হত্যার কড়া জবাব না দিলে এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যশোর শাখার আহ্বায়ক রাশেদ খান জানান, ভারতকে প্রতিবেশী দেশ হিসাবে আমরা বন্ধু দেশ মনে করি। তবে তারা তারা আমাদেরকে সে সম্মান দেয় না। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্য মতে গত ১৫ বছরে সারাদেশে বিএসএফের নির্যাতনে ৫৮৮ বাংলাদেশি হত্যার শিকার হয়েছেন। এসময় আহত হয়েছে আরো কয়েক শতাধিক। কঠোর ভাবে প্রতিবাদ না জানানোয় এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ ধারার পরিবর্তন আনবেন আশা রাখছি।
যশোর ৪৯ ব্যাটালিয়ন বিজিবির অধিনায়ক লে,কর্নেল সাইফুল্লাহ ছিদ্দিকী জানান, বিজিবি সৈনিক রইচউদ্দীন নিহতের ঘটনায় বিচার চলমান রয়েছে। সে সময় এ ঘটনায় বিজিবির পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। সীমান্ত হত্যা বা সাধারণ মানুষের অনুপ্রবেশ রোধে নিয়মিত সীমান্তে সচেতন মুলক প্রচার-প্রচারণা সব সময় চালানো হচ্ছে। বিজিবির পক্ষ থেকে টহল জোরদার করা হয়েছে। একমাত্র সবার সচেতনতাই আগামীতে সীমান্ত হত্যা বা যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পারে।