শরীরে ব্যান্ডেজ আর স্প্লিন্টার নিয়ে হাসপাতালে তরুণযোদ্ধাদের করুণ চাহনি
চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি সরকারি কলেজের মানবিক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ইয়াসিন (২৪)। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার থেকে সরকার পতনে গড়ানো আন্দোলনে গণহত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে ছাত্রলীগের হামলার শিকার হন। গত জুলাইয়ের ২০ তারিখ চট্টগ্রাম ২ নম্বর গেটে ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী নেতা-কর্মীদের হামলায় ডান হাত গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার। চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা না পেয়ে ঢাকায় আসেন ইয়াসিন। আড়াই মাস আগে ভর্তি হন রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন (পঙ্গু) হাসপাতালে।
হাতের কার্যক্ষমতা ফেরাতে গুরুত্বপূর্ণ একটি অপারেশন করেছেন চিকিৎসকরা। হামলার পরে চট্টগ্রামে চিকিৎসা পেতে অন্তত তিনটি হাসপাতাল ঘুরতে হয়েছে তাকে। তবে পঙ্গু হাসপাতালে এসে রক্ষা পেয়েছে তার হাতটি। আশ্বাস ছাড়া পাননি কোনো আর্থিক সহযোগিতা। আর এই আশ্বাসেই কেটে গেছে দীর্ঘ তিন মাস।
ইয়াসিন বলেন, চট্টগ্রাম ২ নম্বর গেটে আমিসহ দুজনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়েছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আমার হাতের নার্ভ কেটে গেছে। পরবর্তীতে পঙ্গু হাসপাতালের চিকিৎসকরা আমার পা থেকে নার্ভ নিয়ে লাগিয়ে দিয়েছেন। জানি না কতটা ভালো হতে পারবো।
আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আশ্বাস ছাড়া কিছুই পাইনি। সহযোগিতা দেওয়ার নাম করে বিভিন্ন কাগজ জমা নিলেও কোনো খবর নাই। অথচ অনেকে পরে ভর্তি হয়েও সহায়তা পেয়েছে। পরিবার অনেক কষ্টে চিকিৎসা করাচ্ছে।
চট্টগ্রামের টাইগারপাস মোড়ে পুলিশের গুলিতে এক চোখ হারানো লেগুনাচালক হাফিজুর রহমানেরও (১৯) মেলেনি সহযোগিতা। চট্টগ্রাম শহরে লেগুনা চালিয়ে পরিবারের ব্যয় নির্বাহ করা হাফিজুরের চোখে মুখে অনিশ্চয়তার ছাপ। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন আশ্বাস নিয়ে। তার চোখ ও মাথায় এখনো পুলিশের গুলি রয়েছে।
শুধুমাত্র ইয়াসিন কিংবা হাফিজুর না, তাদের মতো অনেকেই আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়ায় ঋণ করে চিকিৎসা চালাচ্ছেন। সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা না পাওয়ায় পরিবার নিয়ে অনিশ্চয়তায় কাটছে জুলাই-আগস্টে জীবন ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করা এই যোদ্ধাদের সময়।
চিকিৎসাধীন আহত এই যোদ্ধাদের শঙ্কা, ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে তদের হয়রানি করা হবে। তাদের এখন চাওয়া, অন্তর্বর্তীকালীণ সরকার ও আন্দোলনে পরবর্তীতে গঠিত জুলাই ফাউন্ডেশন যেন গণঅভ্যুত্থানে আহত যোদ্ধাদের উন্নত চিকিৎসা ও পুনর্বাসন করে দেয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর শেরে বাংলা নগরে জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন (পঙ্গু) হাসপাতালে জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার জন্য খোলা বিশেষ দুইটি ইউনিটে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি বেডে আহতরা শরীরের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। প্রত্যেকের শরীরে ব্যান্ডেজ ও স্প্লিন্টারসহ লোহার নানা যন্ত্রপাতি তাদের সঙ্গী। আহতদের বেশিরভাগই তরুণ।
কথা হয় পঙ্গু হাসপাতালের তৃতীয় তলার বিশেষ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট এলাকায় ৩ আগস্ট পুলিশের গুলিতে আহত টেক্সটাইল কারখানার কর্মচারী মো. রায়হানের সঙ্গে। পুলিশের শর্টগানের গুলি লেগে রায়হানের বাম হাতের নার্ভ ড্যামেজ হয়ে গেছে।
চিকিৎসা ও আর্থিক সহযোগিতা পাওয়ার বিষয়ে রায়হান বার্তা২৪.কমকে বলেন, আহত হওয়ার পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলেও চিকিৎসা মেলেনি। পরবর্তীতে চট্টগ্রামের কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি হই। এখানেও ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা পোহাতে হয়েছে। হাতে গুলি লাগায় চাকরি চলে গেছে। সুস্থ হতে এখন ঋণ করে চিকিৎসা চালাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আমার ছোট ছোট দুটি বাচ্চা আছে। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে অন্ধকার দেখছি। ঋণ করে চিকিৎসা চালাচ্ছি। এখন সেই ঋণ কিভাবে শোধ করবো সে অবস্থা নাই। গতকাল রাত পর্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় আমাদের রাস্তায় দিনভর আন্দোলন করতে হলো।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের শর্টগানের গুলি পিঠ দিয়ে ঢুকে বাম হাত দিয়ে বের হয়েছে আইডিয়াল ল্যাবরেটরি কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মো. সজিবের। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় সজিব বলেন, দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে আন্দোলন করেছি। এখন পঙ্গু হয়ে নিজের অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে হচ্ছে। আমরা আশ্বাস ছাড়া কিছুই পাইনি। গতকাল মধ্যরাত পর্যন্ত আমাদের রাস্তায় বসে থাকতে হয়েছে। এটা আমাদের জন্য কষ্টের। রাস্তায় থাকার কারণে অনেকেই আরও অসুস্থ হয়ে গেছে।
আহতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল সহযোগিতা ও পুনর্বাসনের দাবিতে দিনভর আন্দোলন করার পরে মধ্যরাতে পঙ্গু হাসপাতালের সামনে আসেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক মো. সায়েদুর রহমান। তারা দাবি মেনে নিয়ে দ্রুত বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। এছাড়া বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে একটি আলোচনা বসার কথা জানান।
পঙ্গু হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ৮ শতাধিক রোগীকে জরুরী বিভাগে চিকিৎসা দিয়েছে পঙ্গু হাসপাতাল। পাশাপাশি গুরুতর আহত ৫৩৮ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের বেশিরভাগেরই বিভিন্ন অপারেশন করা হয়েছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) হাসপাতালের দুটি বিশেষ ওয়ার্ডে ৮২ জন চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন।
আহতদের চিকিৎসা সেবার বিষয়ে জানতে চাইলে পঙ্গু হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডাক্তার বদিউজ্জামান বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহতদের জন্য আমরা বিশেষ দুটি ওয়ার্ড করেছি। যেখানে বর্তমানে ৮২ জন চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা আহতদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন অপারেশন করেছেন। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়ার চেষ্টা করছি।