একটি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী রাজনীতিকীকরণের মাধ্যমে গোটা গণপরিবহন খাত চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির নৈরাজ্যে পরিণত করেছে। রাজনৈতিক পোশাকের এই গোষ্ঠী গণপরিবহন খাতে অব্যবস্থাপনা টিকিয়ে রাখে নিজেদের স্বার্থে। কারণ যত বেশি অব্যবস্থাপনা, তত বেশি দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি।
শনিবার (২ নভেম্বর) রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়। ‘প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত সংস্কার বিষয়ে জাতীয় সংলাপ আয়োজন উপলক্ষে’ এ সংবাদ সম্মেলন হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় সংলাপের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ৫৩ বছরের বাংলাদেশে টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল নেই। সড়ক পরিবহনে আইন-কানুন, নীতি-নৈতিকতার তেমন গুরুত্ব ও প্রয়োগ নেই। একটি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী রাজনীতিকীকরণের মাধ্যমে গোটা গণপরিবহন খাত চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির নৈরাজ্যে পরিণত করেছে। রাজনৈতিক পোশাকের এই গোষ্ঠী গণপরিবহন খাতে অব্যবস্থাপনা টিকিয়ে রাখে নিজেদের স্বার্থে। কারণ যত বেশি অব্যবস্থাপনা, তত বেশি দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির সুযোগ থাকে। তাই রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কোম্পানিভিত্তিক বাস পরিচালনার উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত করছে এই গোষ্ঠী। অথচ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে এদের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ ছয় বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। শুধু কমিটি গঠন এবং সুপারিশমালা তৈরির মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ।
তিনি আরও বলেন, রাজধানীতে কোম্পানিভিত্তিক বাস সার্ভিস চালু করলে রাজধানীর ব্যক্তিগত যানবাহন নিরুৎসাহিত হবে। এতে যানজট কমবে। যানজট কমলে ঝুঁকিপূর্ণ মোটরসাইকেলের ব্যবহার কমবে। নগরীর সাধারণ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সহজ ও সাশ্রয়ীভাবে যাতায়াত করতে পারবেন। যেহেতু গণপরিবহনের চাঁদাবাজির বিপুল অর্থ রাষ্ট্রের বহুদূর পর্যন্ত পৌঁছায়- একারণে কোনোভাবেই গণপরিবহনের উন্নতি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। যারা গণপরিবহন পরিচালনার নীতি-সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তারা রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবহার করেন না। তারা এই ভোগান্তি জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেন না।
গণপরিবহন ৫৩ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করে, আর ব্যক্তিগত যানবাহন মাত্র ১১ শতাংশ যাত্রী পরিবহন করে। অথচ ব্যক্তিগত যানবাহন ৭০ শতাংশ সড়ক দখল করে চলে। এটা সাধারণ মানুষের প্রতি চরম বৈষম্য। রাজধানীতে মোটরবাইক ও ব্যক্তিগত যানবাহন নামাতে আইনগত কোনো বাধা নেই। কিন্তু বাস-মিনিবাস নামাতে রয়েছে নানা বাধা। অনুমোদন লাগে আরটিসির। এটা দুর্নীতি ও চাঁদাবাজির আরেকটি খাত। আইন করে বন্ধ রাখা হয়েছে সিএনজি অটোরিকশা এবং ট্যাক্সির লাইসেন্স প্রদান। জনবিরোধী এসব সমস্যা সমাধানে বিআরটিএ’র কোনো পদক্ষেপ নেই। সক্ষমতার অভাবে বিআরটিএ মূলত লাইসেন্স প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, বলেন তিনি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সম্পর্কে ঘোষণাপত্রে বলা হয়, অদক্ষ চালক, ত্রুটিপূর্ণ মোটরযান, অনুপযুক্ত সড়ক, মালিক শ্রেণির অপেশাদারী ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় অগণিত মানুষ নিহত হচ্ছে। অসংখ্য মানুষ আহত ও পঙ্গু হচ্ছে। কত পরিবার বিলীন হয়ে যাচ্ছে সামাজিক অর্থনীতির মূল স্রোত থেকে- তার হিসাব নেই। কিন্তু এসব দুর্ঘটনার দায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিচ্ছে না। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার অভাবে দায়ীদের শাস্তি হচ্ছে না। সংজ্ঞা অনুযায়ী বাংলাদেশের অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। সড়ক, যানবাহন ও চালক সঠিক থাকার পরেও যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে সেটা দুর্ঘটনা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলাজনিত কারণে দুর্ঘটনার সহায়ক উপাদান বিদ্যমান থাকায় যখন দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটে তখন তা অবশ্যই কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। এই হত্যাকাণ্ডের দায় কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সম্পর্কে ঘোষণাপত্রে বলা হয়, বিআরটিএ সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী একটি টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠান। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন প্রশাসনিক ক্যাডার সার্ভিস থেকে। যাদের সড়ক বা মোটরযান সম্পর্কিত বাস্তব জ্ঞান থাকে না। ফলে চেয়ারম্যানের পক্ষে সবকিছু জানা-বুঝা সম্ভব হয় না। তাছাড়া তিনি পরবর্তী প্রমোশন পেয়ে অন্যত্র চলে যান। এই পরবর্তী প্রমোশনের আকাঙ্খা কাজ করায় বিআরটিএ নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন চিন্তা তার মানসিকতায় কাজ করে না। এসব কারণে আমরা মনে করি, বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নিযুক্ত হতে হবে সংস্থার ভেতর থেকে দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে।
এছাড়া সড়ক ও মোটরযান বিষয়ে ব্যাপক অভিজ্ঞ কোনো ব্যক্তি কিংবা কোনো একাডেমিশিয়ানকেও চেয়ারম্যান করা যেতে পারে। একইসাথে চেয়ারম্যান যাতে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারেন এমন বিশেষ যোগ্যতাসম্পন্ন জনশক্তি থাকতে হবে। চেয়ারম্যান-সহ এই বিশেষ জনশক্তির বেতন কাঠামো ভিন্ন হতে পারে। তবে অবশ্যই প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। চেয়ারম্যান তার দক্ষ জনবল দ্বারা টেকসই ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে কাজ করবেন। সারা দেশের মোটরযান তদারকির লোকবল নেই বিআরটিএ’র। এই সংকটের সমাধান করতে হবে। যেখানে জীবনের প্রশ্ন জড়িত সেখানে সংকট জিইয়ে রাখা যাবে না। বিআরটিএ’র নিয়ন্ত্রণে চালক তৈরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।
বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত মোটরযানের তুলনায় লাইসেন্স প্রাপ্ত চালকের সংখ্যা কয়েক লাখ কম রয়েছে। এই অবস্থায় দক্ষ চালকের ঘাটতি পূরণ না করে বিআরটিএ নতুন মোটরযানের নিবন্ধন প্রদান করছে। এর অর্থ বিআরটিএ নিজেই লাইসেন্সবিহীন চালক দ্বারা মোটরযান চালানোর অনুমতি দিচ্ছে। একটি প্রতিষ্ঠান কোন নৈতিকতায় এটা করতে পারে?