শচীন কর্তার সংগীত সরণি
তার বর্ণাঢ্য জীবনের শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের কুমিল্লায়। তারপর দীর্ঘসময় কেটেছে বম্বের সঙ্গীতাঙ্গনে। অবশেষে স্থায়ী ঠিকানা ছিল কলকাতা। অক্টোবর মাস তার জীবনে প্রবলতম: ১ তারিখে জন্ম (১৯০৬ সাল) আর ৩১ তারিখে মৃত্যু (১৯৭৫ সাল)।
আধুনিক বাংলা গানের মহারাজা, 'শচীন কর্তা' কিংবা 'এস ডি বর্মন' নামে সুপরিচিত তিনি। পুরো নাম শচীন দেব বর্মন। ১৯২৫ সাল পর্যন্ত কুমিল্লায় বাস। জেলা স্কুল, ভিক্টোরিয়া কলেজে অধ্যয়ন। তারপর স্থায়ীবাস কলকাতার দক্ষিণাংশে, সাউথ এন্ড পার্ক এলাকায়।
বিখ্যাত বাজার গড়িয়াহাটের গোলপার্ক থেকে পঞ্চাননতলার দিকে হাঁটলে ডান দিকে পড়ে একটি রাস্তা। একটু এগোলেই দেখা যায় দেব বর্মন পরিবারের বাড়ি। ৩৬/১, সাউথ এন্ড পার্ক যার ঠিকানা।
ব্রিটিশ আমলে ১৯৪৪ সালে জমি কিনে এই বাড়িটি তৈরি শুরু করেন 'শচীন কর্তা'। তার আগে তিনি সপরিবারে হিন্দুস্তান রোডে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। ১৯৪৮ সালে নতুন বাড়িতে গিয়ে উঠেন সপরিবারে।
তার পুত্র রাহুল দেব বর্মনও বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ও পরিচালক। তার ডাক নাম ছিল টুবলু। শচীন ও মীরা যখন মুম্বাই চলে গেলেন, রাহুল দেব বর্মন এই বাড়িতে থাকতেন দিদিমাকে নিয়ে। এখানেই তার স্কুলজীবন। তারপর রাহুলও বোম্বে পাড়ি দেন।
কত বিখ্যাত গান বাঁধা হয়েছে এই বাড়িটায়, তা এখন সোনালি ইতিহাসের অংশ । এখানে পা রেখেছেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, গুরু দত্ত, সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো কত বরেণ্য মানুষ। পরে সেই বাড়ি শচীন-পুত্র রাহুল দেব বর্মন বিক্রি করে দেন।
বাড়িটি যেই রাস্তায়, তার নামে ‘সংগীত’ যুক্ত হোক, এরকম প্রস্তাব দিয়েছিলেন কলকাতার নাগরিকগণ। কলকাতা পুরসভা প্রস্তাব গ্রহণও করে। সাউথ এন্ড পার্কের নাম পাল্টে হতে চলেছে ‘সংগীত সরণি’। শচীনকর্তার ১১৩তম জন্মদিন থেকে নতুন নামে পরিচিত হবে সড়কটি।
জানা গেল, ইতিমধ্যেই দেব বর্মন পরিবারের বাড়িটিকে হেরিটেজ-২ জোন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে, বাড়ির সামনের অংশ কোনোভাবেই ভাঙা যাবে না। রাজ্য হেরিটেজ কমিশন এই বাড়িতে একটি মিউজিয়াম চালু করতে চায়। সেই বিষয়ে বাড়ির এখনকার মালিকের সঙ্গে আলোচনা চালানো হচ্ছে কমিশনের পক্ষ থেকে। প্রয়োজনে বাড়িটিকে অধিগ্রহণ করতে পারে রাজ্য সরকার।
একশো বছর পার করেও বাঙালি তো বটেই, গোটা উপমহাদেশের সংগীতপিপাসু মানুষদের হৃদয়ে এখনও স্বমহিমায় জায়গা করে আছেন শচীন দেব বর্মন। বাংলা হোক বা বলিউড, রেডিও হোক বা সিনেমা, একই সঙ্গে গায়ক, সুরকার, সংগীত পরিচালক, লোকসংগীত শিল্পী শচীন কর্তা যেন একটা যুগ। এবং যুগ হয়েও যুগোত্তীর্ণ তার কিছুটা অনুনাসিক উচ্চারণের দরদী গানগুলো: তুমি চলে গেছো বকুল বিছানো পথে, কে যায়রে ভাটির...।
ত্রিপুরার চন্দ্রবংশীয় মাণিক্য রাজপরিবারের সন্তান তিনি। বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেব বর্মন ছিলেন সেতারবাদক এবং ধ্রুপদী সংগীতশিল্পী। স্ত্রী মীরা দেব বর্মনও সুরকার ও সংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে উঠেছিলেন। আর ছেলে রাহুলও গানের জগতে কিংবদন্তী, যাকে পিতার মতো করে ডাকা হয় আর ডি বর্মন।
শুধু শিল্পী হিসাবেই নন, সংগীত পরিচালক রূপে বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে শচীন দেব বর্মন দাপটের সঙ্গে কাজ করেছেন। অর্জন করেছেন বহু রাষ্ট্রীয় ও পেশাগত সম্মান।
কুমিল্লা শহরের চর্থায় জন্ম নিয়ে যে সঙ্গীত প্রতিভা সমগ্র উপমহাদেশ মাতিয়েছেন, সেই শচীন কর্তার স্মৃতি আলো ছড়াচ্ছে দক্ষিণ কলকাতার এক জনপদে। তার স্মৃতিধন্য এলাকা পেয়েছে 'সংগীত সরণি' নামের মর্যাদা।