কলকাতার যে দুর্গাপূজা আয়োজনে মুসলমানেরা, ঈদে হিন্দুরা

  • স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

খিদিরপুরের মুন্সিগঞ্জ এলাকার পূজা, যেখানে মুসলমানরা পূজার আয়োজন করে

খিদিরপুরের মুন্সিগঞ্জ এলাকার পূজা, যেখানে মুসলমানরা পূজার আয়োজন করে

কলকাতায় মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলের মধ্যে খিদিরপুর অন্যতম। গোটা খিদিরপুর জুড়ে সবচেয়ে বেশী মুসলমান থাকেন এ অঞ্চলে। হিন্দু নেই তা নয় তবে সংখ্যায় খুবই কম। তা বলে মাতৃ শক্তির আরাধনা হবে না তাও হতে পারে! তাই সমগ্র পশ্চিমবাঙলার সাথে খিদিরপুরেও একাধিক দুর্গাপূজা হচ্ছে। তবে খিদিরপুরের মুন্সিগঞ্জ এলাকার পূজা একটু ভিন্ন।

ওই এলাকায় গত ৬০ বছর ধরে পূজার পুরো দায়িত্ব বহন করেন মুসলমানরা। মণ্ডপে প্রতিমা আনা, দেবীর ভোগ, মণ্ডপসজ্জা, আলো এমনকি বিসর্জনও। মন্ত্রোচ্চারণ বা আচার অনুষ্ঠান বাদে গোটা দায়িত্ব নিয়ে থাকে মুন্সিগঞ্জের ফাইভস্টার ক্লাব। আর তা এক দুই বছর ধরে নয় গত ষাট বছর ধরে নিয়ম করে দুর্গাপুজোর দিনগুলোয় সব কিছু ভুলে আন্তরিকভাবে মজে থাকে দুর্গাপূজায়। অবশ্য এর খোঁজ কলকাতার মানুষ খুব একটা রাখেন না।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু পাড়ার মানুষের কাছে ঈদের মতোই উৎসবের সময় দুর্গাপূজা বা কালীপূজা হয়।

বিজ্ঞাপন

দুর্গাপূজা আদতে হিন্দু বাঙালিদের সবথেকে বড় উৎসব। তবে এই অঞ্চলে এলে বোঝা দায় কাদের পূজা! সম্প্রীতি বহন করে ওই এলাকার মানুষের কাছেও হয়ে উঠেছে দুর্গাপূজাও এক উৎসব।

মুন্সিগঞ্জ তার এক বড় উদাহরণ। তিন রাস্তার মোড়ে সাদামাটা প্যান্ডেল। বাহুল্য নেই। কিন্তু সম্প্রীতি আছে।

সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল ছোট্ট সলমান আহমেদ, তার যেনো অনেক দায় দায়িত্ব!

নবমীর দিন দেবীর ভোগ রন্ধনশালা থেকে মণ্ডপে আনতে সেই নেতৃত্ব দিচ্ছে! সালমন বলছিল, দুর্গাপূজায় খুব মজা হয়। ঠাকুর দেখতে যাই। ফুচকা আর আইসক্রিমের দোকান বসে, দোলনায় চাপি। আবার আমাদের পূজায় চলে আসি।

এই পূজাটাকে সলমান যেমন ছোটবেলা থেকেই 'আমাদের পূজা' বলে ভাবতে শিখেছে, তেমনই নিজেদের পূজা বলেই মনে করেন পাড়ার সবাই।

ষাট বছর ধরে এভাবেই পূজা হয়ে আসছে। আমাদের মামা, দাদাদের দেখেছি সকলে মিলে দুর্গাপূজা-কালীপূজা-ঈদ-মহররম পালন করতে, আমরাও সেভাবেই করি। আবার আমাদের জুনিয়ার যারা বড় হয়েছে, তারাও পূজার কাজে এগিয়ে আসে। চাঁদা তোলা, ঠাকুর নিয়ে আসা, ভাসান দেওয়া সবেতেই সবাই থাকি আমরা- বলছিলেন পূজা কমিটির প্রধান অজগর আলি।

অপরদিকে জনার্দন সাহা বলছিলেন, এই তো মহরম গেল। আমরাও বাজার করেছি, খাবার বিলি করেছি, পানি দিয়েছি। কখনও কোনও সমস্যা হয় না এ পাড়ায়। ঈদের মাসে এখানকার মুসলমান পরিবাররা রোজা রাখে তখন আমরা ইফতারের আয়োজন করি গোটা মাস। এখানে হিন্দুর সংখ্যা অনেক কম বলে অন্য অঞ্চল থেকে সহযোগিতা করতে হিন্দুরা আসেন। আসলে আমরা এখানে হিন্দু মুসলমান দেখিনা। তাই আজ পর্যন্ত ইতিহাসের পাতায় যত দাঙ্গা হয়েছে তার একটারও আচ আমাদের এলাকায় পড়েনি। তাই ৯২ এর বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে যখন সারা দেশ জ্বলছিল, তখনও এ পাড়ায় তার আচ পড়েনি।

পাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলেন পূজার আরেক উদ্যোক্তা সামাদ। এগিয়ে এসে বললেন, ঠাকুর নিয়ে আসতে যাই আমরা, প্যান্ডেলে ঠাকুর তোলা, দেখভাল সবই মুসলমানরা করি।তবে প্রতিমার কাছে যারা পূজায় বসেন তারা হিন্দু, কারণ সেই কাজে তো মন্ত্র লাগে! আমরা তো আর মন্ত্র জানি না!

শাস্ত্র বা মন্ত্র না জানলেও পূজার ব্যবস্থাপনায় পাড়ার মুসলমান ছেলেরাই সামনের সারিতে। পূজার দেখভাল করছিলেন কয়েকজন, তাদেরই অন্যতম মুহম্মদ নাজিম বলেন, জাত বা ধর্ম এটা নিজস্ব বিষয়। তাই আমাদের পাড়ায় জাতপাত-হিন্দু-মুসলিম ব্যাপারটাই নেই। একটা হিন্দু বাড়ির বাচ্চা আর মুসলিম বাড়ির বাচ্চা ছোট থেকেই একসঙ্গে বড় হয়। আমরাও যেমন ছোট থেকে এভাবেই বড় হয়েছি, বলুন তো কারো যখন রক্তের প্রয়োজন হয় ডাক্তার তখন রক্তের গ্রুপটা বলে দেয়। তখন কিন্তু হিন্দুর রক্ত বা মুসলমানের রক্ত দেখা হয় না। আমরা এ পাড়ায় এভাবেই বড় হয়েছি।

পূজার খিচুড়ি ভোগ বানাচ্ছিল সেলিমের পরিবার তার কথায়, বছরে একবারই দুর্গাপূজা। এখন খুব ব্যস্ত আমরা। কথা বলার সময় নেই। আপনি তো নিজে চোখেই দেখতে পাচ্ছেন। দু:খ একটাই লাগে আমাদের পূজা নিয়ে কেউ খুব একটা লেখেনা। কারণ কেউ খোঁজ রাখে না। রাখবেই বা কেনো আমাদের তো সাদামাটা পূজা। তবে ঈদের সময় এলে চিত্রটাই পাল্টে যায় এখানে। তখন আমাদের হিন্দু বন্ধুরা বাড়ি বাড়ি ইফতার বানায়। আবার রোজার সময় আমরা ক্লান্ত থাকি তখন ওরা ইফতার বানায়। ছোট থেকে এরকমই চলে আসছে এ পাড়ায়।

অপর এক উদ্যোক্তার কথায় এখন পূজার সামলানো মুশকিল। সব মিলিযে দেড়লাখ রুপি চাদা উঠেছে। তাই দিয়ে হচ্ছে কোনো রকমে পূজা। আমাদের পুজোয় কোনো বিজ্ঞাপন নেই, নেই কোনো স্পনর। তাই চাঁদা দিয়েই পূজা করতে হচ্ছে। কিন্তু আর কতদিন নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে শুধু চাঁদা তুলে পূজা চালিয়ে যেতে পারবো জানি না।

সেই চিন্তা রয়েছে মুন্সিগঞ্জের এই পাড়ার বাসিন্দাদের। তবে ভবিষ্যত কী হবে, তা নিয়ে অবশ্য এখন আর ভাবতে চান না তারা। পূজার শেষদিনটা নবমী আনন্দে কাটুক! এখন এটাই তাদের কাম্য।