ভারতের জাতীয় ঐক্যের প্রতিমূর্তি সরদার বল্লভাই প্যাটেলের জন্মবার্ষিকী

  • সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

ভারতের স্বাধীনতার জন্য যারা আত্মত্যাগ করেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন নেতা সরদার বল্লভাই প্যাটেল। যাকে ভারতের জাতীয় ঐক্যের প্রতিমূর্তি এক কিংবদন্তি নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সরদার প্যাটেল এক নিখাদ স্বনির্মিত মানুষ, সরদার প্যাটেলের জীবন কাহিনী সুদৃঢ় ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম আর আন্তরিকতার নজির।
 
১৮৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর, প্রভাবশালী পতিদার সম্প্রদায়ে তাঁর জন্ম। শিক্ষাজীবনের শুরু গুজরাটে এবং এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন লন্ডনে গিয়ে আইন পড়বেন। কিন্তু তাঁর পিতার আকস্মিক মৃত্যুর কারণে তাঁর পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে যায়। ইস্পাত কঠোর সংকল্পের বলে, যে সংকল্প শেষ দিন পর্যন্ত ছিল তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তরুণ প্যাটেল ‘আইন পরীক্ষার জন্য একাগ্রভাবে পড়াশোনা করেন, যার কারণে ইংল্যান্ডে পড়তে যাওয়ার জন্য তাঁর পরিবারকে অর্থ ব্যয় করতে হয়নি।’
 
১৯১২ সালের জুন মাসে তিনি ইংল্যান্ডের মিডল টেম্পল থেকে এলএলবি শেষ করেন। আড়াই বছরের মধ্যে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। দুর্দান্ত আইনি পরামর্শের কারণে তাঁর একটি নিজস্ব পাঠকমণ্ডলী তৈরি হয়ে যায়। তিনি অচিরেই সবার কাঙ্ক্ষিত আইনজীবীতে পরিণত হয়ে ওঠেন। কিন্তু তিনি চাইছিলেন সমাজের জন্য কিছু করতে, যার দ্বারা একটি স্থায়ী পরম্পরা রেখে যেতে পারেন।

তাই তো মহান এই নেতা বলেছিলেন ‘সন্দেহ নেই যে, আমার প্রসার এখন বেড়ে চলেছে। আমি এখন বড় কিছু করতে পারছি। কিন্তু আমার এই প্রসার কাল থাকতেও পারে, নাও পারে। আমার টাকা কাল শেষ হয়ে যাবে, আমার যারা উত্তরাধিকারী, তারাই এই টাকা উড়িয়ে দেবে। বরং তাদের জন্য টাকার চেয়ে আরও ভালো একটি উত্তরাধিকার আমি রেখে যেতে চাই।’
 
প্যাটেল তাঁর জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের কথা পরবর্তীতে লিখেছেন, যে সময় তিনি দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। গান্ধীর সঙ্গে দেখা হওয়ার মুহূর্ত ১৯১৫ সালে হঠাৎ পাওয়া সুযোগে আহমেদাবাদের গুজরাট ক্লাবে মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে একটি বৈঠক, দেশের জন্য কাজ করার তাঁর সংকল্পকে আরও দৃঢ় করে।
 
মহাত্মা গান্ধীর জীবন ও দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাঁর একান্ত অনুসারীতে পরিণত হলেন প্যাটেল, এবং তাঁর সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার যাত্রায় বেরিয়ে পড়লেন। তিনি একটি একটি সফল ‘কর দেবো না’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন, যার পরিণতিতে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কৃষকদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া জমি ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়।

ভারতের জাতীয় ঐক্যের প্রতিমূর্তি সরদার বল্লভাই প্যাটেলের জন্মবার্ষিকী
কৃষকদের সংগঠিত করায় প্যাটেলের বীরোচিত ভূমিকার কারণে তাঁকে সরদার খেতাব দেয়া হয়



কৃষকদের সংগঠিত করায় প্যাটেলের বীরোচিত ভূমিকার কারণে তাঁকে সরদার খেতাব দেওয়া হয়, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় যার অর্থ নেতা।

সরদার প্যাটেল পরবর্তীতে অনেকবার বঞ্চিত ও নিপীড়িত কৃষকদের অধিকার আদায়ে অহিংস প্রতিরোধের গান্ধীবাদী পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন। ১৯৩০ সালে, মহাত্মা গান্ধীর সূচনা করা লবণ-সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণের দায়ে সরদার প্যাটেলকে কারাবন্দী করা হয়।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থাকা সত্ত্বেও, মহাত্মা গান্ধীর একনিষ্ঠ সমর্থক ও মিত্র থেকে যান প্যাটেল। ১৯৪২ সালে প্রভাবশালী নেতারা গান্ধীর ভারত ছাড় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অসহযোগ আন্দোলনের যৌক্তিকতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে স্বাধীনতা সংগ্রামের মতবিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে। সরদার প্যাটেল বলিষ্ঠ কণ্ঠে গান্ধীকে সমর্থন জানিয়ে আসতে থাকেন এবং কার্যত বাধ্য হয়েই সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটিকে ভারত ছাড় আন্দোলনে সমর্থন দিতে হয়।

জাতি গঠনে দুর্দান্ত সাংগঠনিক যোগ্যতা ও অদম্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধতার কারণে সরদার প্যাটেল ভারতের প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ঐক্যবদ্ধকারী প্যাটেলকে যথার্থই স্মরণ করা হয় তাঁর লৌহ কঠিন সংকল্প ও দৃঢ়তার জন্য, যার দ্বারা তিনি ৫০০ এর বেশি দেশীয় রাজ্যকে সমন্বিত করে ফেডারেল ইন্ডিয়ার কাঠামো প্রস্তুত করেন। এই স্মরণীয় কীর্তির কারণেই তিনি ব্যাপক শ্রদ্ধা ও সম্মানে ভূষিত হন, যার কারণে তাঁকে ভারতের লৌহ মানব বলা হয়ে থাকে।

সমাজ সংস্কারক প্যাটেল:
রাষ্ট্রকে জাতীয় উন্নয়ন ও উত্থানের কারিগর হিসেবে দেখার ধারণাটি প্যাটেলের চিন্তারই বাস্তবায়ন। রাষ্ট্রের বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর প্রচারিত রাজনৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে মিলে যায়। জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম কেবল একটি রাষ্ট্রের ভিত্তি স্তম্ভই নয়, বরং রাষ্ট্রকে একসঙ্গে টিকিয়ে রাখার জন্যও এই উপাদানদুটি আবশ্যক। প্যাটেলের চিন্তায়, ব্যক্তি স্বাধীনতাকে হতে হবে রাষ্ট্রের সংবিধানের ধারার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।

বিশ্ব্যায়নকারী হিসেবে প্যাটেল:
সরদার প্যাটেল ছিলেন আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণকারী, যিনি প্রতীকী আদর্শবাদের পরিবর্তে একটি বাস্তবমুখী বৈদেশিক নীতির সুপারিশ করেন। তিনি উপর্যুপরি পরামর্শ দিয়ে গেছেন যেন, দেশের সার্বভৌমত্ব ও সংহতি ব্যাহত হয় এমন কোনো পদক্ষেপ কিছুতেই গ্রহণ করা না হয়।

বিজ্ঞাপন
কৃষকদের সংগঠিত করায় প্যাটেলের বীরোচিত ভূমিকার কারণে তাঁকে সরদার খেতাব দেয়া হয়
ভারতের লৌহ মানব বলা হয়ে থাকে



প্যাটেলের ঐতিহ্য: জাতি গঠনকারী:
সরদার প্যাটেল যদিও ভারতের স্বাধীনতার পর মাত্র আড়াই বছর বেঁচেছিলেন, কিন্তু এই অল্প কয়েক মাসেই তিনি একটি আধুনিক, শক্তিশালী ও স্বনির্ভর ভারতের ধারণা তৈরি করে যান। ভারতের একক রাজ্যগুলিকে সংঘবদ্ধ ও সুসংহত করার কৃতিত্বের জন্য প্রায়শ জার্মানির কিংবদন্তী নেতা অটো ভ্যান বিসমার্কের সাথে তুলনীয় প্যাটেল জাতিগঠনে নানাভাবে ভূমিকা রাখেন। তিনি ভারতের সংবিধান প্রণয়নকারীদের সভায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন এবং সংবিধানের খসড়া প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ড. ভিমরাও রামজি আম্বেদকরের নিয়োগে এবং সংবিধান রচনার প্রক্রিয়ায় সকল রাজনৈতিক বলয় হতে নেতাদের যুক্ত করতে তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সরদার প্যাটেল ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস এবং ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের প্রতিষ্ঠাতা। তিনিই ভারতের সিভিল সার্ভিসের স্বায়ত্তশাসন ও নিরপেক্ষতা রক্ষার্থে সংবিধানে অনুচ্ছেদ যুক্ত করে যান।

সরদার প্যাটেলের মৃত্যুর কয়েক দশক পরও, ভারতের প্রতি তাঁর নিরঙ্কুশ ভালোবাসা ও আত্মত্যাগের কথা ভারতের পুনরুত্থানে আত্মনিয়োগকারীদের উজ্জীবিত করে। এই দিনে কিংবদন্তীতুল্য এই মহান ব্যক্তির প্রতি আজও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন অব্যাহত রয়েছে। সরদার প্যাটেলকে ১৯৯১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান ‘ভারত রত্ন’ খেতাবে ভূষিত করা হয়।