দেরনা বিপর্যয়ের কারণ রাজনৈতিক!

  • আসমা ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

আরব রাজনীতিতে পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোর হস্তক্ষেপে বারবার গৃহযুদ্ধ সৃষ্টি হয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে যুদ্ধ চলেছে দীর্ঘ সময় ধরে। তিউনিসিয়ায় সৃষ্ট আরব বসন্তের হাওয়া লেগেছিল মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশেই। একদিকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে পশ্চিমাদের সরকারবিরোধী দলকে সমর্থন, অন্যদিকে প্রভাব বজায় রাখতে সরকারপক্ষকে প্রতিপক্ষ পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোর মদদ - এ খেলায় ভেঙেছে লিবিয়াও। প্রায় এক যুগ সময়ের এতো উত্থান পতনের সাক্ষী লিবিয়া আজকে প্রাকৃতিকভাবে বিপর্যস্ত।

২০১১ সালের ২০ অক্টোবরের ঘটনা। দীর্ঘ ৪২ বছরের শাসনামলের অবসান ঘটেছিলো মুয়াম্মার গাদ্দাফির। এদিন বিদ্রোহীদের হাতে গাদ্দাফি হত্যার মধ্য দিয়ে লিবিয়ার উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি একটু শান্ত হয়। সৃষ্টি হয় নতুন এক গণতান্ত্রিক লিবিয়ার। কিন্তু গাদ্দাফির মৃত্যুর এক দশক পরেও লিবিয়ার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। লিবিয়ার বিরুদ্ধে বিবাদমান দলগুলোর একের পর এক ষড়যন্ত্রে বারবার আশাহত হতে হয়েছে লিবিয়ার নাগরিকদের। জনগণকে অনিশ্চয়তা, অসাম্য, বোমা হামলা, হত্যা, অপহরণ, মানবাধিকার বৈষম্য ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি দেশটি। এর সাঙ্গে নতুন করে যুক্ত হলো সুনামির মতো ভয়াবহ বন্যা।

লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় শহর দেরনায় ভয়াবহ বন্যায় বিপুল মানুষের প্রাণহানির জন্য পরোক্ষভাবে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতিই দায়ী।

বিজ্ঞাপন

একনায়ক কর্নেল গাদ্দাফির পতনের পরপরই লিবিয়ায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা দ্রুত ভেঙে পড়েছিলো। এদিকে ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক মিশনে হামলা চালায় আল-কায়দা। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের তৎপরতায় লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলীর ক্ষমতায় আসে ন্যাশনাল ইউনিটি সরকার। ন্যাটোর সহায়তায় বিক্ষোভকারীরা ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলকে (এনটিসি) ক্ষমতায় বসায়। এরপর দেশটি দুই পক্ষে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানে দেশটির রাজধানী ত্রিপোলিসহ পশ্চিমাঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে জাতিসংঘ স্বীকৃত লিবিয়ার সরকার আব্দুল হামিদ আল-দিবেইবাহ।

অন্যদিকে বেনগাজীকে কেন্দ্র করে পূর্বাঞ্চলসহ দেশটির বেশিরভাগ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে রাশিয়া, মিসর, জর্ডান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সমর্থিত বিদ্রোহী খলিফা হাফতারের বাহিনী। এভাবেই দুই ক্ষমতাবলয়ের উত্থান দেশটিকে দুই ভাগ করে দেয়। এমন অস্থিরতা এবং রাজনৈতিক সংকট লিবিয়ার অনেক সমৃদ্ধ শহরকেই নাজুক করে তোলে। কখনও জঙ্গিদের দখলে থেকে কখনও বন্যাকবলিত হয়ে আজকের বিপর্যস্ত দেরনা শহর তার সবচেয়ে বড় সাক্ষী হলো।

বিজ্ঞাপন

১৯৫০-৬০ এর দশকে প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ নগরী দেরনা ছিল শিক্ষা ও শিল্পকলার প্রাণকেন্দ্র। ১৯৯০ এর দশকে দেরনা চরমপন্থী বিরোধী শক্তির প্রধান ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ২০১২ সালে দেরনা শহরে আইএস তাদের ‘ইসলামিক খিলাফত’ প্রতিষ্ঠা করে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্রে আল- কায়েদার হামলার ফলে ইসলাম বিদ্বেষী মনোভাব ছড়িয়ে যাওয়ার ঘটনা, অন্যদিকে দেরনায় কট্টর ইসলামিক জঙ্গিগোষ্ঠীর ঘাঁটি গড়ে উঠায় এলাকাটির প্রতি পশ্চিমাদের বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গী তৈরি হওয়াই দেরনার অবক্ষয়ের শুরু করে। তখন থেকেই মূলত দেরনা এবং লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় এলাকা একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে বাঁধ ও অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়নে নজরদারিত্ব একেবারেই কমে যায়।

একসময় নাগরিকদের জননিরাপত্তামূলক এসব ব্যবস্থা ও উন্নয়ন পরিকল্পনা একেবারেই পরিকল্পনার বাইরে চলে যায়। দীর্ঘদিন ধরেই বন্যা বা ভয়াবহ কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হলেও এলাকাটির উন্নয়নকল্পে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। যার শেষ পরিণতি হাজার হাজার মানুষ তাদের জীবন দিয়ে দেখলো। সর্বশেষ বন্যায় দেরনা হারিয়েছে প্রায় এগারো হাজারেরও বেশি প্রাণ, এখনো নিখোঁজ দশ হাজারেরও বেশি মানুষ।

তেলের নিয়ন্ত্রণকে নিজেদের করতে এবং লিবিয়ার তেলের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতে এমন অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি এবং তা বছরের পর বছর টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টায় প্রভাবশালী পরাশক্তি দেশগুলো মোটামুটি সফল।

লিবিয়ার আজকের ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি, বিবাদমান দলগুলোর মাঝে ক্ষমতা রক্ষার লড়াই দেশটিতে জঙ্গিবাদের উত্থানকে উসকে দিয়েছে। পরাশক্তি দেশগুলোর হস্তক্ষেপ এবং লিবিয়া সরকারের অবহেলিত উন্নয়ন ব্যবস্থার ফলেই দেরনাকে ভুগতে হচ্ছে এমন ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়।

লিবিয়ার বাতাসে আজকে লাশের গন্ধ। লিবিয়ার ত্রিপোলিভিত্তিক সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইব্রাহিম আল আরাবি বলেন, মরদেহ, মৃত প্রাণী, আবর্জনা এবং রাসায়নিক পদার্থের কারণে ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত হচ্ছে।

দেরনার ওয়াহদা হাসপাতালের প্রধান মোহাম্মদ আল-কাবিসি বলেন, পানিবাহিত রোগ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনও কলেরা রোগীর সন্ধান মেলেনি।