সি চিন পিং: ‘রাজপুত্র’ থেকে কৃষক, কৃষক থেকে প্রেসিডেন্ট

  • আন্তর্জাতিক ডেস্ক, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম কংগ্রেসের দিকে এখন বিশ্বের নজর। এই কংগ্রেসে মাও সে-তুংয়ের পর দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতা হিসেবে চীনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তার অবস্থান পোক্ত করতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। যা চীনের রাজনীতিতে নতুন এক ইতিহাস রচনা করবে।

চীনা সংবিধানে দুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট হওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ ছিল। যা ১৯৯০-এর দশক থেকে কার্যকর ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে দুবারের সেই সীমা সরিয়ে ফেলা হয়। ফলে সি চিন পিং তৃতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার দরজা অবারিত হয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

বিশ্লেষকরা বলছেন, তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হলে সি চিন পিং চীনের ক্ষমতায় নিজেকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যাবেন। সেই সঙ্গে চীনা রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ আরও শক্ত হবে। অনেকেই মনে করেন, এমনও হতে পারে, ৬৯ বছর বয়সী সি চিন পিং আজীবন ক্ষমতা ধরে রাখবেন।

১৯৫৩ সালে চীনের বেইজিংয়ে জন্ম নেওয়া সি চিন পিং বিপ্লবী নেতা শি ঝংশানের পুত্র। ঝংশান কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। মা কি জিনও ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য।

১৯৪৯ সালে মাও সেতুংয়ের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় পিপলস রিপাবলিক অব চায়না। এরপর উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ঝংশান। অভিজাত ঘরে জন্ম নেওয়ায় ছেলে বেলায় সি চিন পিংকে ‘রাজপুত্র’ হিসেবে অভিহিত করা হতো।

কিন্তু কয়েক বছর পরই সি চিন পিংদের পরিবারের সম্পদ নাটকীয়ভাবে কমতে থাকে। দল ও সরকারের সঙ্গে বারবার মতানৈক্যে জড়ান ঝংশান। তার মাশুলও দিতে হয় তাকে। ১৯৬৩ সালে তাকে দল থেকে বহিষ্কার ও কারাবন্দি করা হয়। পাঠিয়ে দেওয়া হয় হেনান প্রদেশে একটি কারখানায়। ফলে বাবার সঙ্গে কয়েক বছরের জন্য যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

এরপর ১৯৬৬ সালে চীন উত্তাল হয়ে ওঠে। শুরু হয় তথাকথিত ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’। লাখ লাখ নাগরিককে ‘চীনা সংস্কৃতি’র শত্রু আখ্যা দেয়া হয়। সারাদেশে তাদের ওপর চালানো হয় সহিংস হামলা। এতে বিপাকে পড়ে জিনপিংয়ের পরিবারও। তার এক সৎবোনকে হত্যা করা হয়। ব্যাহত হয় কিশোর সি চিন পিংয়ের লেখাপড়াও।

অভিজাত স্কুল থেকে ঝরে পড়েন সি চিন পিং। আরও মাত্র ১৫ বছর বয়সে তাকে ছাড়তে হয় বেইজিং। ষাটের দশকের শেষের দিকে শুরু হয় ‘ডাউন টু দ্য কান্ট্রিসাইড মুভমেন্ট’। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তরুণ সি চিন পিংকে পাঠানো হয় শানজি প্রদেশের লিয়াংজিয়াহে গ্রামের ‘পুনঃশিখন কেন্দ্রে’। সেখানে একটানা সাত বছর কৃষকের কাজ করতে হয় ‘রাজপুত্র‘ সি চিন পিং।

শৈশব ও কৈশোর ঝঞ্ঝা বিক্ষুদ্ধ হলেও উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করেন সি চিন পিং। বেইজিংয়ের শিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি কেমিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পাস করেন তিনি। এ সময় তার পরিচয় ছিল কর্মী-কৃষক-সেনা-ছাত্র।

এত পরিশ্রম ও কষ্ট সত্ত্বেও কমিউনিস্ট পার্টি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার বদলে বারবারই দলে যোগ দিতে চাইতেন সি চিন পিং। তবে প্রতিবারই বাবার কারণে তা ভেস্তে যায়। অবশেষে ১৯৭৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়। দায়িত্ব শুরু হয় হিবে প্রদেশ থেকে।

কয়েক বছর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পরে বাড়ে দায়িত্বভার। ১৯৮৯ সালে ৩৫ বছর বয়সে তার পদোন্নতি হয়। দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ ফুজিয়ানের নিংদে শহরের দলীয় প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন তিনি। ওই বছরই বৃহত্তর রাজনৈতিক স্বাধীনতার দাবিতে বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়।

সরকারের দুর্নীতি বন্ধ ও গণতন্ত্রের দাবিতে ১৯৮৯ সালের এপ্রিল থেকে শিক্ষার্থীরা ঐতিহাসিক তিয়েনআনমেন স্কয়ারে অনশন শুরু করে। তার সঙ্গে যোগ দেন শ্রমিকেরা। মাও সেতুংয়ের ছবির সামনে গণতন্ত্রের দেবীর মূর্তি খাড়া করে ক্ষমতাসীন সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা।

রাজধানী বেইজিং থেকে অনেক দূরে ফুজিয়ান প্রদেশ। কিন্তু রাজধানী বিক্ষোভের উত্তাপ সেখানেও ছড়িয়ে পড়ে। সেখানেও শুরু হয় বিক্ষোভ। দলের অন্য নেতাদের সঙ্গে নিয়েও সেই বিক্ষোভ মোকাবিলায় হিমশিম খেতে হয় সি চিন পিংকে।

বিক্ষোভ প্রধানত শান্তিপূর্ণ হলেও দমনে কঠোর অভিযান চালায় সরকার। বিক্ষোভকারীদের উৎখাতে ৩ জুন রাতে রাজধানী বেইজিংয়ে সেনা ও ট্যাংক নামানো হয়।

পরদিন ৪ জুন মধ্যরাতে সব দিক থেকে ঘিরে ফেলা হয় তিয়েনআনমেন স্কয়ার। বেয়নেট হাতে সেনাদের সামনে সার বেঁধে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা তিয়েনআনমেন স্কয়ার ত্যাগ করে। তবে স্কয়ারের বাইরে সেনাদের নির্বিচার গুলিতে ততক্ষণে নিহত হন শত শত ছাত্র-শ্রমিক।

ওই ঘটনার পর এ নিয়ে কোনোরকম আলোচনা নিষিদ্ধ করে চীন। এমনকি প্রায় ৩০ বছর পরও এ নিয়ে কথা বলা নিষেধ। সেই ঘটনা দেশটির ইতিহাস বই ও সরকারি নথি থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।

তিয়েনআনমেন হত্যাযজ্ঞের কোনো সরকারি পরিসংখ্যান এখন পর্যন্ত প্রকাশ করেনি চীন। তবে প্রত্যক্ষদর্শী, মানবাধিকার সংস্থা ও গবেষকদের মতে, তিয়েনআনমেনে সেদিন হাজারের ওপর লোককে হত্যা করেছিল সেনারা।

ওই ঘটনার পর সি চিন পিংকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। প্রায় দুই দশক পর ২০০৮ সালে বেইজিংয়ে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়। যার পুরো আয়োজনের দায়িত্ব পান সি চিন পিং।

এর মধ্য দিয়ে চীনও নিজেকে দেখানোর সুযোগ পায় যে, সেও এতদিনে অনেকটা এগিয়েছে এবং অলিম্পিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বৈশ্বিক আসরেরও আয়োজন করতে সক্ষম। এবং এক্ষেত্রে সফলতাও দেখায় চীন যা তার ক্রমবর্ধমান শক্তি হয়ে ওঠার প্রতীক হয়ে ওঠে।

এর মধ্যদিয়ে দলে সি চিন পিংয়ের গুরুত্ব ও প্রভাব বাড়ে। যা তাকে দলের শীর্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নেতাদের কাতারে নিয়ে যায়। ২০০৭ সালে সপ্তদশ পার্টি কংগ্রেসে তিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরো স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য হন। এর পরের বছর তিনি চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং ২০১২ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু জে. নাথান বলেছেন, চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব ২০১২ সালে সি চিন পিং কে নেতা হিসেবে বেছে নিয়েছিল, তারা বিশ্বাস করেছিল যে তাকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা মনে করেছিল সি চিন পিং নমনীয়, অনুগত হবে । কিন্তু তিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর তার উগ্র মানসিকতা সবাইকে অবাক করেছে, বলেন নাথান।

ক্ষমতা গ্রহণের পর সি চিন পিং দ্রুত তার কর্তৃত্ববাদী দিক প্রকাশ করেন। ২০১২ সালের ডিসেম্বরে এক বক্তৃতায় তিনি গণতন্ত্রকে বিপজ্জনক বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং যুক্তি দিয়েছিলেন যে ১৯৮৯ সালে তার একদলীয় কমিউনিস্ট ব্যবস্থার অবসানের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মতো পরিণতি এড়াতে চীনকে যা করা দরকার তা করতে হবে।

চীনের অভিজাত রাজনীতির বিশেষজ্ঞ ডেভিড শামবাঘ সি চিন পিংকে ‘আধুনিক সম্রাট’ বলে অভিহিত করেছেন।