মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি: ড. নূরুন নবী
২০২০ সালে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য একুশে পদক পান যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালি ড. নূরন নবী। পেশায় তিনি একজন বিজ্ঞানী। তার পেটেন্টকৃত আবিস্কারের সংখ্যা ৫৫টি, পাবলিকেশেন সংখ্যা ৫০টি। তিনি নিউইয়র্কের অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক পত্রিকা সাপ্তাহিক প্রবাসীর প্রেসিডেন্ট ও সম্পাদক। ২০০৭ সাল থেকে নিউজার্সি অঙ্গরাজ্যের প্লেইনবোরো শহরের নির্বাচিত কাউন্সিলম্যান। তিনি একজন সংগঠক এবং রাজনীতিবীদ। তবে তার সবেচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। নিউইয়র্ক বইমেলাসহ বাংলাদেশ এবং নিউইয়র্কে শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন কাজের সাথে তিনি সম্পৃক্ত। করোনার মধ্যে ড. নূরুন নবী বার্তা২৪.কম-এর সাথে একান্তে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন। ভার্চ্যুয়ালি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আদনান সৈয়দ।
প্রশ্ন: আপানার অনেক পরিচয়। তবে কোন পরিচয়ে আপনি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন?
ড. নূরন নবী: মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে আমি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। কারণ মুক্তিযুদ্ধ জাতির জীবনে একবারই আসে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেওয়ার।
প্রশ্ন: ফার ইস্টার্ন রিভিউতে আপনাকে কেন ‘ব্রেইন অব দি ফোর্স’ বলে বিবেচনা করা হয়?
ড. নূরন নবী: আমরা টাঙ্গাইলে হিট অ্যান্ড রান কায়দায় যুদ্ধ করেছি। প্রথম দিকে মুক্ত অঞ্চল ধরে রাখার মতো আমাদের কোনও সক্ষমতা ছিল না। ফলে অভিযান চালিয়ে চলে গেলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেখানের জনগণকে অত্যাচার করতো। তাই মুক্তাঞ্চল ধরে রাখার প্রয়োজনীতা দেখা দেয়। যার জন্য প্রচুর গোলা বারুদ ও আধুনিক অস্ত্রের প্রয়োজন ছিল। ওই সময় ভারত থেকে কোনও সাপ্লাই লাইনও ছিল না। তাই ভারত থেকে টাঙ্গাইলে অস্ত্র সংগ্রহের দায়িত্ব আমার উপর বর্তায়। এজন্য আমি তিনবার ভারতে গিয়ে ভারতীয় বাহিনীর জেনারেলদের সাথে আলোচনা করে ৪০টি নৌকা বোঝাই অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসি। অবশ্য এ জন্য আমাকে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবদিহি করতে হয়েছিল। এমনকি ভারতীয় জেনারেলদের আস্থা অর্জন করতে হয়েছিল। অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনতে পারায় আমাদের মুক্তিবাহিনীর মনোবল বেড়ে যায় এবং শত্রুর বিরুদ্ধে ক্রমাগত জয় অর্জন করতে থাকি।
প্রশ্ন: প্রবাসে বসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা কতটুকু সফল বলে আপনার কাছে মনে হয়?
ড. নূরন নবী: প্রবাসে সাহিত্য চর্চার করার যেমন সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তেমনি রয়েছে অনেক সুবিধা। প্রবাস জীবন অনেকটাই শৃঙ্খলাবদ্ধ। ফলে লেখক নিজের মতো করে লেখালেখিতে মনোযোগ দিতে পারেন। প্রবাসে বই লেখার অন্যতম সমস্যা হলো হাতের কাছে রেফারেন্স বই না থাকা। ইন্টারনেটেও বাংলা রেফারেন্স বইয়ের বড়ই অভাব। প্রবাসে বাংলা সাহিত্য চর্চা বাড়লেও প্রকাশিত বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। এরমধ্যেও অনেক প্রবাসী লেখক জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কার পাচ্ছেন। এটা ভালো দিক। তবে প্রবাসী লেখকদের লেখার মানের দিকে নজর দেওয়া উচিত।
প্রশ্ন: আপনার প্রবাস জীবন সম্পর্কে কিছু বলুন?
ড. নূরন নবী: দেশের জন্য মন কাঁদলেও আমার প্রবাস জীবন ভালই কাটছে। আমি প্রবাসে থাকলেও আমার অনেক কর্মকান্ড দেশ নিয়ে। দেশের জন্য যেসব কাজ করছি, তা দেশে থাকলে হয়তো করতে পারতাম না।
প্রশ্ন: আমেরিকায় বাংলা ভাষার চর্চা সম্পর্কে আপনার মত কী?
ড. নূরন নবী: প্রবাসে বড় বড় শহরে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় বাংলা স্কুল চালু রয়েছে। সেখানে বাংলা ভাষা ছাড়াও শিশুরা নৃত্য, বাদ্যযন্ত্র এবং বাংলা গান শিখছে। তবে এখানের ছোট শহরগুলোতে বাঙালি কম হওয়ায় এসব চর্চা দেকা যায় না। প্রবাসে বাংলা শিক্ষা নির্ভর করে বাবা মায়ের ইচ্ছার উপর। তবে প্রবাসের বাংলা পত্রিকাগুলো বাংলা চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
প্রশ্ন: বাংলা ভাষায় হিন্দি ও ইংরেজির ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ভবিষ্যতে বাংলা সাহিত্য চর্চায় এটা কি ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে?
ড. নূরন নবী: হিন্দি ও ইংরেজি বাংলা ভাষা চর্চায় প্রভাব ফেলবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ ভাষা একটি প্রবাহমান বিষয়। সময়ের সাথে এর বিবর্তন হয়। অন্য ভাষা থেকে শব্দ সংযোগ হয়ে ভাষা সমবৃদ্ধ হয়। বর্তমানে আমরা গ্লোবাল ভিলেজে বাস করি। ভাষা ও সংস্ক্রতির আদান প্রদান হতে বাধ্য। এটাকে রদ করা যাবে না। দূষণ বা সংমিশ্রণ যাই বলি না কেন, তা আপন গতিতেই চলবে।
প্রশ্ন: কথা সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন- বাংলা ভাষা যদি ভবিষ্যতে টিকে তাহলে বাংলাদেশেই টিকবে। আপনার কি মনে হয়?
ড. নূরন নবী: আমিও সেটা মনে করি। কারণ রক্ত দিয়ে আমরা বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। বাংলাদেশেই বাংলা ভাষা টিকে থাকবে এবং উৎকর্ষ লাভ করবে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে মৌলাবাদীদের উত্থান নিয়ে আপনার বিশ্লেষণ জানতে চাই।
ড. নূরন নবী: বাংলাদেশে মৌলাবাদীদের উত্থানের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ১৯৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে বাংলাদেশকে একটি মিনি পাকিস্তান বানাতে চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের মূল আদর্শ বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে আর অন্য কোনও আদর্শ ব্যবহার করা কার্যকর হবে না। বিধায় ধর্মভীরু বাঙালিদেরকে ইসলামের নামে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা কখনো ধর্মান্ধদের দখলে যাবে না। সেই পরিস্থিতি আসলে বাঙালিরা রুখে দেবে।
প্রশ্ন: ডিজিটাইজেশনের ফলে বই পড়ার প্রবণতা কমেছে। এই প্রবণতা বাড়াতে আপনার পরামর্শ কী?
ড. নূরন নবী: ভিডিও গেম, ফেসবুক, আইপ্যাড, কিন্ডেল কখনও বই পড়ার বিকল্প হতে পারে না। একজন লেখককে অবশ্যই বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনা করতে হবে। বই পড়ুয়াদের সংখ্যা একটু কমেছে বটে। কিন্তু যারাই বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশুনা করবেন, তারাই ভালো লেখক হয়ে উঠবেন।
প্রশ্ন: সাহিত্যের ভাষা কোনটা হওয়া উচিৎ- মুখের ভাষা নাকি আঞ্চলিক ভাষা?
ড. নূরন নবী: আমি মনে করি, প্রমিত ভাষা বা আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্য রচনায় কোনও বাধা নেই। কিন্তু নজর রাখতে হবে কিভাবে ভাষাকে ব্যবহার করতে হবে। চরিত্রের উপর নির্ভর করবে কোন ভাষা ব্যবহৃত হবে।
প্রশ্ন: একুশে পদক পাওয়া সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই।
ড. নূরন নবী: রাষ্ট্রের এ ধরনের একটি পুরস্কার পওয়া অবশ্যই সম্মানের ও আনন্দের। আমি দায়বদ্ধতা থেকে লেখালেখি করি, পুরস্কারের জন্য নয়। আমার এই পুরস্কার শুধু আমার একার নয়, এটা প্রবাসী সব বাঙালির। ভালো কাজ করলে প্রবাসীরাও জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পেতে পারে।
প্রশ্ন: নিউইয়র্কে বইমেলা নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
ড. নূরন নবী: গত ৩০ বছর ধরে নিউইয়র্কে বইমেলা চলে আসছে। এর গুরুত্ব অনেক। এই বইমেলা নিউইয়র্ক তথা উত্তর আমেরিকায় বাংলা সাহিত্য চর্চা, পাঠক সৃষ্টি এবং লেখক সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছে। দেশ বিদেশের লেখক ও পাঠকদেরকে মুখোমুখী করেছে। ভবিষ্যতে এই বইমেলা আরও উৎকর্ষ লাভ করবে।
প্রশ্ন: আপনার প্রকাশতি ‘স্মৃতিময় নিপ্পন’ এবং ‘জাপানীদের চোখে বাঙালি বীর’ গ্রন্থ সম্পর্কে কিছু বলেন।
ড. নূরন নবী: আমি দায়বদ্ধতা থেকে লেখক হয়েছি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস শুধু বিকৃতি নয়, এটাকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা শুরু হয়েছিল। আমি তখন ভাবলাম, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে আমি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। আমি যদি আমার নিজের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করি, সেটা ইতিহাসের অংশ হয় থাকবে। তাই আমি মুক্তিযুদ্ধের উপর আমার অভিজ্ঞতা লেখা শুরু করি। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য আমি ২০১৭ সালে বাংলা একাডেমির সম্মান সূচক ফেলোশিপ পেয়েছি এবং গত বছর একুশে পদক পেয়েছি। এবার বইমেলায় ‘জাপানিদের চোখে বাঙ্গালী বীর’ এবং ‘স্মৃতিময় নিপ্পন’ গ্রন্থ দুটোর পাশাপাশি আরও একটি বই Bangabandhu and Turbulent Bangladesh বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে।