বিদায়, আবুল উমারাহ মুহম্মদ ফখরুদ্দীন, অগ্রজতুল্য সহকর্মী, গীতিকবি

  • সৈকত রুশদী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আবুল উমারাহ মুহম্মদ ফখরুদ্দীন

আবুল উমারাহ মুহম্মদ ফখরুদ্দীন

"ও আমার বাংলা মা তোর আকুল-করা রূপের সুধায় ..."

অনন্য এক দেশপ্রেম ও জাগরণের অবিস্মরণীয় এই গানের রচয়িতা মুক্তিযোদ্ধা আবুল উমরাহ মুহম্মদ ফখরুদ্দীন আর নেই।

বিজ্ঞাপন

চির বিদায় নিয়েছেন তিনি শনিবার (২৪ অক্টোবর) এই ইহজগত ছেড়ে। অতিমারী কোভিড-১৯ কেড়ে নিয়েছে তাঁর প্রাণ। ঢাকার একটি হাসপাতালে।

পেশাগত সূত্রে তাঁর সাথে আমার পরিচয় জাতীয় প্রেসক্লাবে। ১৯৮০-এর দশকের মাঝামাঝি। তবে ঘনিষ্ঠতা হয় ১৯৮৭ সালের মার্চ মাসে আমি 'দৈনিক খবর' ছেড়ে 'দ্য বাংলাদেশ টাইমস'-এ যোগ দেওয়ার পর।

বিজ্ঞাপন

তিনি বসতেন ঢাকার ১ রাজউক এভিনিউয়ে 'টাইমস-দৈনিক বাংলা' ভবনের পশ্চিম বাহুর তিনতলায়। আর 'দ্য বাংলাদেশ টাইমস'-এর রিপোর্টিং, ফটোগ্রাফি ও রীডিং বিভাগ সহ বার্তা বিভাগ ছিল এল আকৃতির ভবনের দক্ষিণ বাহুর দোতলায়।

আমাদের রিপোর্টারদের অফিসে আসা শুরু হতো সন্ধ্যার দিকে। তখন তাঁর কাজের পালা শেষ।

তবে সম্পাদকীয় পাতার এবং সাপ্তাহিক সাহিত্য বিভাগের মেকআপ দেখার জন্য সপ্তাহে দুই-তিনদিন সন্ধ্যার পর আসতেন দোতলার বার্তা বিভাগে। সেসময় অবশ্যই একবার রিপোর্টিং-এ এসে অনুজপ্রতীম সুহৃদদের কুশলাদি জানতে চাইতেন সহাস্য মুখে।

বয়সে আমার চেয়ে অন্তত ১৫ বছরের বড় এবং পেশাগতভাবে অনেক জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তিনি সবসময়ই ছিলেন বন্ধুসুলভ। প্রকৃত বড় ভাইয়ের মতো।

ফখরুদ্দীনের সাথে ২০০১ সালে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

তাঁর স্বল্প সময়ের উপস্থিতি রিপোর্টিং বিভাগে নানান ধরণের সংবাদ ও ছবি সংগ্রহ করে নিয়ে আসা এবং তা' প্রকাশে নানাবিধ চাপ নিয়ে রিপোর্টার ও ফটোগ্রাফারদের উদ্বেগ ও উত্তেজনাকর পরিবেশে বয়ে দিতো স্বস্তি ও আস্থার পরশ। সকলের প্রতি একরাশ ভালোবাসার বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে যেতেন।

এমন অমায়িক ও নিরহংকারী সাংবাদিক ও মানুষ আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি।

 তাঁর স্নেহের সুযোগে মাঝে বিকেলে তাঁর বিভাগে গিয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছি। আড্ডা বলা হলেও তাঁর সাথে আলাপচারিতা সব সময়ই ছিল আনন্দময় ও জ্ঞানগর্ভ।

প্রথম থেকেই ইংরেজী ভাষায় সাংবাদিকতার কারণে তিনি সর্বসাধারণ ব্যাপকভাবে পরিচিত ছিলেননা।

কিন্তু ইংরেজী ভাষার পত্রিকার দেশী-বিদেশি পাঠকদের কাছে এ ইউ এম ফখরুদ্দীন (AUM Fakhruddin) নামে পরিচিত এই সাংবাদিক ছিলেন আকর্ষণীয় এক লেখক। রচনার বিষয়ের বৈচিত্র্যময়তায় এবং শব্দচয়নে গীতিকবিতার মাধুর্য্যে।

বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সহ বহু গুণী ব্যক্তির সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং সাহচর্য তাঁর লেখনীকে করেছিল সমৃদ্ধ ও পরিশীলিত।

'দ্য বাংলাদেশ টাইমস'-এ আমার পাঁচ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে তাঁর সাথে আড্ডায় আমি তাঁর কাছে শিখেছি নতুন নতুন শব্দের যথাযথ ব্যবহার।

তিনি 'দ্য বাংলাদেশ টাইমস' ছাড়ার পরে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক 'দ্য টেলিগ্রাফ' ও 'দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট' এবং প্রখ্যাত সাপ্তাহিক 'হলিডে'-তে কাজ করেন।

তাঁর স্ত্রী মমতাজ বিলকিসও পেশায় একজন সাংবাদিক। কাজ করেছেন জাতীয় সংবাদ সংস্থা 'বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা' (বাসস)-তে।

'দ্য বাংলাদেশ টাইমস'-এ তাঁর কক্ষে এক একান্ত আড্ডায় লাজুক মুখে ফখরুদ্দীন ভাই জানিয়েছিলেন তিনি কিছু গান লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে জনপ্রিয় এই 'জাগরণের গান'টিও।

স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের জুন মাসে তাঁর লেখা এই গানটি প্রথম প্রচারিত হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনে। বিজয় অর্জনের পরপরই।

বরেণ্য সুরকার আলাউদ্দিন আলীর সুর সংযোজনায়। জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনের সুরেলা কণ্ঠে।

প্রচারের সাথে সাথেই জনপ্রিয় হয় গানটি তার কথা, সুর ও ধ্বনির বাঙময়তায়।

অগণন প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সদ্য স্বাধীন দেশে বাংলা মায়ের প্রতি বাঙালির চিরায়ত ভালোবাসার এক অনন্য প্রকাশে।

পরে বিভিন্ন সময়ে গানটি আবার রেকর্ড করেছেন আবিদা সুলতানা, ফেরদৌস আরা ও ফাহমিদা নবী।

গানটি ১৯৮৪ সালে ঢাকা থেকে 'গীতিকবি সংসদে'র সংকলনে প্রকাশিত হয়। আর ১৯৯১ সালে 'বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে'র বাংলা 'দেশাত্মবোধক গান' গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়।

সুরকার লাকী আখন্দের পরিচালনায় গানটির ডিভিডি প্রকাশিত হয় ২০০৬ সালে।

২০০৮ সালে গানটি 'এইচএসবিসি' ব্যাংকের 'শতবর্ষের গানে' সাবিনা ইয়াসমিন কণ্ঠে প্রকাশিত হয়।

এই গানটির জন্য 'জাগরণ সংস্কৃতি কেন্দ্র' ‘জাগরণের গান' অনুষ্ঠানে গীতিকার আবুল উমারাহ মুহম্মদ ফখরুদ্দীনকে 'গীতিকার ২০০৯'-এ সম্মাননায় ভূষিত করে।

আমি ২০০৩ সালে কানাডায় চলে আসার দীর্ঘদিন পর তাঁর সাথে আবার যোগাযোগ হয় 'ফেসবুক'-এর কল্যাণে। 'মেসেঞ্জারে' বার্তা আদান-প্রদান ও আলাপচারিতার পর তিনি ইমেইল করে গানটির কথা এবং সাবিনা ইয়াসমীনের কণ্ঠে গীত গানটি আমাকে পাঠান।

 

এই গানের দুই সুরকারের পরে প্রয়াত হলেন আজ গীতিকারও। গানের কথাগুলো সংযোজন করছি প্রয়াত এইউএম ফখরুদ্দীন ভাইয়ের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করে।

প্রথিতযশা সাংবাদিক ও গীতিকার আবুল উমরাহ মুহম্মদ ফখরুদ্দীন আজ নেই। কিন্তু বাংলার আকাশে বাতাসে থাকবে বাংলাদেশের এই গুণী সন্তানের চিরায়ত সৃজন।

সন্মাননাপ্রাপ্ত জাগরণের গান: বাংলাদেশের রূপের সুধা

গীতিকার- আবুল উমারাহ্ ফখরুদ্দীন

সংগীত পরিচালক-আলাউদ্দিন আলী

কন্ঠশিল্পী- সাবিনা ইয়াসমিন, আবিদা সুলতানা, ফাহমিদা নবী, ফেরদৌস আরা

প্রথম সম্প্রচার-বিটিভি ১৯৭১

" আমার বাংলা মা তোর আকুল-করা রূপের সুধায়

হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে

যায় জুড়িয়ে …………………….

আমার বাংলা মা গো

ফাগুনে তোর কৃষ্ণচূড়া পলাশ বনে কিসের হাসি;

চৈতী রাতে উদাস সুরে রাখাল বাজায় বাঁশের বাঁশী

বোশেখে তোর রুদ্র ভয়াল কেতন উড়ায় কালবোশেখী;

জষ্ঠি মাসে বনে আম-কাঁঠালের হাট বসে কি!

শ্যামল মেঘের ভেলায় চড়ে আষাঢ় নামে তোমার বুকে;

শ্রাবণ ধারায় বরষাতে তুই সিনান করিস পরম সুখে

নীলাম্বরী শাড়ী 'রে শরৎ আসে ভাদর মাসে;

অঘ্রাণে তোর ধানের ক্ষেতে সোনা রঙের ফসল হাসে

রিক্ত চাষীর কুঁড়ে ঘরে দিস মা গো তুই আঁচল রে;

পৌষ পাবনের নবান্ন ধান আপন হাতে উজাড় 'রে

আমার ………… বাংলা মা গো"

টরন্টো

২৪ অক্টোবর ২০২০