শহর কলকাতার উত্থানপর্ব

অচেনা গ্রাম থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রধান নগর কলকাতা  

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

কলকাতার উত্থান ও বিকাশ সত্যিই বড় আশ্চর্যের। কল্পনার বাইরে থেকে জায়গাটি উপমহাদেশের রাজনৈতিক ভূগোলে বিরাট জায়গা দখল করে নেয়। ইংরেজদের সাফল্যের সূত্রে কলকাতা লাভ করে চরম সৌভাগ্য। একটি অচেনা ও অতিসামান্য গ্রাম থেকে কলকাতা নগর লন্ডনের পর পরিণত হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ নগরে। সমগ্র ভারতবর্ষের রাজধানীর গৌরব লাভের পাশাপাশি শিল্প-সাহিত্য-শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয় কলকাতা। উপমহাদেশে ইউরোপীয় তথা ব্রিটিশ আধুনিকতা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কলকাতা পালন করে অগ্রণী ভূমিকা।

কারণ, এ কথা ঠিক যে মুঘল শাসনে বৃহত্তর বাংলা ছিল রাজধানী ঢাকা থেকে শাসিত। মুর্শিদকুলি খান আধা-স্বাধীন নবাব হয়ে রাজধানী ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গের মুর্শিদাবাদে সরিয়ে নেন। ঢাকার আগে সুলতানি আমলে বাংলা শাসিত হতো সোনারগাঁও থেকে। বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের অখ্যাত ও অনুপযুক্ত কলকাতা এলাকা যে রাজধানী তথা শাসনের মূলকেন্দ্র হওয়ার সম্ভাবনা রাখে, ইংরেজের আগে তা কেউ অনুধাবণ করতেও পারেনি।

ফলে বরিশা এলাকার সাবর্ণ চৌধুরীর জমিদারীর অন্তর্গত একটি নগণ্য গ্রাম ছিল ‘ডিহি কলকাতা’। উত্তর-দক্ষিণ-পূর্বে আরও কয়েকটি গ্রাম নিয়ে ছিল ‘পরগণা কলকাতা’। উত্তরাংশের অপর কয়েকটি গ্রাম ছিল নদীয়া-কৃষ্ণনগরের রাজাদের অধীন। দক্ষিণে বেহালা-বড়িশা পর্যন্ত ছিল সাবর্ণ চৌধুরীদের জমিদারীর মধ্যে।

সাধারণ বাংলার গ্রামের মতোই ছিল ডিহি কলকাতা। রাজস্ব ইত্যাদি আদায়ের কেন্দ্রীয় গ্রাম বলে একে বলা হতো ‘ডিহি’। তার সীমানাও ছিল খুবই ছোট ও সঙ্কীর্ণ। উত্তরে বর্তমান মহাত্মা গান্ধী রোড, দক্ষিণে ধর্মতলা স্ট্রিট-গঙ্গার তীর পর্যন্ত।

ইংরেজ ও তাদের সহযোগীদের হাতে পরবর্তী দুইশ বছরে এই ছোট্ট সীমানাটিই উপনিবেশিক-মহানগরের আকার ধারণ করে। অথচ বাংলায় তো বটেই, উপমহাদেশেরও অনেক প্রাচীন নগরের চেয়ে কনিষ্ঠ কলকাতার বয়স দুইশ বছরের সামান্য বেশি।

এহেন কলকাতায় একজন জব চার্নক এসে ইতিহাসের চাকাকে নিজেদের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। ১৬৯০ সালে চার্ণক যদি সুতানুটিতে তৃতীয়বার ‘হল্ট’ করে বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের সিদ্ধান্ত না নিতেন এবং যদি কৌশলে নবাবের অনুমতি হাতিয়ে সেখানে দূর্গ প্রতিষ্ঠা না করা হতো, তাহলে চট্টগ্রাম অথবা ঢাকা বা মুশির্দাবাদ থাকতো বাংলার প্রধান শহর আর মাদ্রাজ হতো ভারতের মূল কেন্দ্র। কলকাতা প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ও রাজধানী হতে পারতো না। সেজন্য ঐতিহাসিকরা ১৬৯০ সালকে কলকাতার প্রতিষ্ঠা-বছর আর জব চার্নককে প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করেন।

ভাগ্যের এটাও একটি দেখার মতো বিচিত্র খেয়াল যে, জব চার্নকই কলকাতার প্রথম বিদেশি বণিক নন, কিন্তু তিনিই প্রতিষ্ঠাতা। এমন কি, ইংরেজরাও কলকাতা বা বাংলার প্রথম বাণিজ্য স্থাপনকারী নয়। অনেক আগে সপ্তদশ শতাব্দীর গোড়া থেকেই বাংলায় বিদেশি এসেছে, যাদের মধ্যে পর্তুগিজ, আর্মেনিয়ান, ডাচ, দিনেমার ও ফরাসিগণ অন্যতম। কলকাতার সেন্ট জর্জ গির্জা, যেখানে চার্নকের সমাধি রয়েছে, সেটিরও আগে কলকাতায় আর্মেনিয়ান নাজারেথ গির্জা প্রতিষ্ঠিত হয়। চট্টগ্রামে দেয়াঙ-এ, হুগলিতে, মাদ্রাজে গির্জা, কুঠি, আবাস বানিয়ে বিদেশিরা বহাল তবিয়তে ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল।

কিন্তু ইংরেজরা ছাড়া কেউই কলকাতার মতো একটি নির্দিষ্ট শহর বা অঞ্চলকে কব্জা করে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হাসিলের পথে অগ্রসর হয়নি। রাজনেতিক কর্তৃত্ব, কৌশল ও ভাগ্য শেষ পর্যন্ত জব চার্নকের স্বজাতি ইংরেজের দিকে এবং নগর-কেন্দ্র কলকাতার প্রতি ঝুঁকে যায়। প্রাচীন-সমৃদ্ধ বাংলার অবসানে সূচনা ঘটে নতুন-দখলদার শাসকদের ছত্রছায়ায় কলিকাতাকেন্দ্রীক শোষিত-নিষ্পেষিত-উপনিবেশিক বাংলার। (শেষ পর্ব)

আরও পড়ুন: সুতানুটি গ্রাম থেকে রাজধানী হলো কলকাতা

আরও পড়ুন: ১৬৯৯ সালে প্রেসিডেন্সি হয় কলকাতা

আরও পড়ুন: জব চার্নকের কলকাতা

আরও পড়ুন: সুতানুটি থেকে কলকাতা

আরও পড়ুন: চট্টগ্রামের বদলে ইংরেজদের কাছে গুরুত্ব পায় কলকাতা

বিজ্ঞাপন