অতিথি পাখির অভয়ারণ্যে ফেনীর জাম্বারা দিঘি
চারদিকে কিচিরমিচির শব্দ। ঝাঁকে ঝাঁকে দলবেঁধে উড়ছে পাখি। কিছু পাখি আবার মাথা নুইয়ে গোসল করছে। এ যেন চোখ জুড়ানো অপরূপ দৃশ্য। প্রতি বছরের মতো এ বছরও অতিথি পাখির কলকাকলিতে মুখরিত ফেনীর শর্শদি ইউনিয়নের মধ্যম জাহানপুর গ্রামের জাম্বারা দিঘি।
হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে বরফ শীতল দেশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে আসা এসব পাখির কলকাকলিতে পুরো গ্রাম এখন মুখরিত। গ্রামবাসীও পরম যত্নে আগলে রাখছেন অতিথিদের।পাখিপ্রেমীরা এ দৃশ্য একনজর দেখার জন্য ছুটে আসেন দূরদূরান্ত থেকে। অতিথি পাখির মধ্যে পানকৌড়ির সংখ্যা কম হলেও ছোটসরালি ও বালিহাঁসের সংখ্যা বেশি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পাখিদের দিনভর জলকেলি, খুনশুটি, সে সঙ্গে কিচির-মিচির শব্দ, কখনো ঝাঁক বেঁধে নান্দনিক কসরতে ডানা মেলে নীল আকাশে উড়াউড়ি। গ্রামবাসী বিরক্ত হওয়া তো দূরের কথা, অতিথিদের রেখেছেন পরম যত্নে। রক্ষা করছেন শিকার থেকে।
জানা গেছে, পানকৌড়ি, বালি হাঁস, রাঙ্গা ময়ূরী, ছোট সরালি পরিযায়ী পাখির এ বিচরণ ক্ষেত্রটি ডিসেম্বরের শেষের দিক থেকেই শুরু হয়। শীতপ্রধান এলাকা থেকে আসা এসব অতিথি পাখি অনুকূল পরিবেশ আর প্রয়োজনীয় খাবার নিশ্চিত হওয়ায় আস্তানা গড়ে এ দিঘিতে। পাখি প্রেমীরা বলছেন, এ দিঘীতে প্রায় ১০ প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটেছে এবার। ডিসেম্বরের শেষ থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দিঘীটিতে অবস্থান করে এই পাখি।
দিঘীর এক পাশে গ্রামের বাসিন্দারা গোসলসহ দৈনন্দিন সব কাজ করলেও অন্য প্রান্তে পাখিরা নিজেদের রাজ্য গড়ে তুলেছেন। প্রতিদিন শত শত মানুষ আসছেন তবে এতে অতিথি পাখিদের নেয় কোনো হেলদোল।
ছোটবেলা থেকেই এ দিঘিতে পাখিদের এমন আগমন দেখছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অন্যদিকে অতিথি পাখিদের দেখতে আসা দর্শনার্থীরাও খুশি এমন কিচিরমিচির শব্দ শুনে।
স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল ওয়াহাব জানান, আমাদের ছোটবেলা থেকেই দেখছি এ পাখিগুলো জাম্বারা দিঘিতে আসে। শীত মৌসুম তারা এখানে অবস্থান করে। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ায় এটি আমাদের গ্রামের সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেয়।
মধ্যম জাহানপুর গ্রামের ষাটোর্ধ্ব ইয়াকুব নবী বলেন, আমরা দিঘির এক পাশে গ্রামের বাসিন্দারা গোসলসহ দৈনন্দিন সব কাজ করি। অন্যপ্রান্তে পাখিরা যেন নিজেদের রাজ্য গড়ে তুলতে পারে।
একই গ্রামের যুবক নুর উদ্দিন বলেন, পাখিদের নিরাপত্তার বিষয়ে গ্রামের যুবকসহ সবাই সজাগ থাকেন। দর্শনার্থীদের পাখিদের বিরক্ত না করতে বোঝানো হয়।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে হওয়াতে এ দিঘিতে আগত পাখিদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন পাখি প্রেমীরা।
পাখিদের সৌন্দর্য অসাধারণ অনুভূতি বলে উল্লেখ করেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অতিরিক্ত কর কমিশনার হাফিজ আল আসাদ বলেন, দিঘিটির বিষয়ে আগেই জানা ছিল। এখানে পাখিগুলো দেখতে বেশ মনোমুগ্ধকর লাগে। এখানকার স্থানীয়রাও পাখিদের যত্ন নেয়৷ খাবার দেয়, কেউ বিরক্ত করে না তাদের৷ এমন দৃশ্য সচরাচর এখন দেখা মেলে না। তাই দূর থেকে ছুটে এলাম পাখিগুলো দেখার জন্য।
মুশফিক হাসান নামে এক দর্শনার্থী বলেন, পাখিগুলো এখানে আসে যে এটি আমরা আগেই জানি৷ সেজন্য বাবা মায়ের সাথে দেখতে এসেছি। পাখির কিচিরমিচির শব্দ শহরের কোলাহলে শোনা যায় না।এখানে এসে অতিথি পাখিদের ভালোই উপভোগ করলাম।
অন্যদিকে নিজের এলাকায় পাখিদের এমন আগমনে খুশি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ পুলিশ কমিশনার মো. জসিম উদ্দিন। পাখিদের আতিথেয়তা দিতে দিঘিতে ব্যবস্থা করেছেন খাবার। দর্শনার্থীদের জন্য ব্যবস্থা করেছেন পাখি দেখার নির্দিষ্ট স্থান।
পাখিদের বিষয়ে তিনি বলেন, মধ্যম জাহানপুরের এ জাম্বারা দিঘিতে বিভিন্ন দেশ থেকে অতিথি পাখি আসে। কোনো আগন্তুক লোক কিংবা অন্যকেউ পাখি শিকার বা তাদের বিরক্ত করতে না পারে এ বিষয়ে এলাকাবাসী সতর্ক অবস্থানে থাকে। পাশাপাশি সচেতনতার জন্য বিলবোর্ড ফেস্টুন করা হয়েছে এবং স্থানীয়দের একটি কমিটি রয়েছে যারা পাখিদের খাবার দেওয়াসহ তাদের দেখবাল করে। বাইরের দর্শনার্থী যারা আসে তাদের জন্য পাখি দেখার জন্য জায়গা ব্যবস্থা করা হয়েছে। জেলাপ্রশাসন থেকেও খাবার দেয়ার জন্য ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এটি ফেনীর ঐতিহ্য, এটি রক্ষার জন্য আমরা কাজ করছি।
ফেনী শহর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পশ্চিমে শর্শদি ইউনিয়নের মধ্যম জাহানপুর গ্রামের জাম্বারা দিঘির সড়কপথে দূরত্ব ৭ কিলোমিটার। শহরের ট্রাংক রোডের মদিনা বাস স্ট্যান্ড থেকে সিএনজি অটোরিকশা সার্ভিসে জাম্বরা দিঘি পর্যন্ত জনপ্রতি ভাড়া গুনতে হয় ২০ টাকা। রিজার্ভ আসা যাওয়া ভাড়া ২০০ টাকা। এছাড়াও ফেনী মহিপাল থেকে ফতেহপুর ফ্লাইওভারের নীচ দিয়ে এ দিঘিতে যাওয়া যায়।