নরসিংদীর শত বছরের ঐতিহ্য

রঙিন নিশান উঠিয়ে কাঁঠালকে বিদায়!

  • শরীফ ইকবাল রাসেল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, নরসিংদী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪,  শ্রাবণ মাসের শেষে বা ভাদ্র মাসের শুরুতে নরসিংদীতে উদযাপিত হয়, কাঁঠাল উৎসব

ছবি: বার্তা২৪, শ্রাবণ মাসের শেষে বা ভাদ্র মাসের শুরুতে নরসিংদীতে উদযাপিত হয়, কাঁঠাল উৎসব

শত বছরের ঐতিহ্য অনুযায়ী এবারও নিশান উঠিয়ে কাঁঠালের মৌসুমকে বিদায় জানিয়েছেন নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার কৃষকেরা। এবার শনিবার (২৭ জুলাই) কাঁঠাল উৎসবটি উদযাপিত হয়েছে।

এ উপলক্ষে মৌসুমের বড় বড় কাঁঠাল নিয়ে বিভিন্ন রঙে সাজানো হয়, কাঁঠাল বোঝাই ভ্যানগাড়ি। পরে গান-বাজনা করে নেচে-গেয়ে সেই কাঁঠাল বাজারে বিক্রি করা হয়। এটি এই অঞ্চলের শত বছরের ঐতিহ্য বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিজ্ঞাপন

মৌসুমি ফল কাঁঠাল বিক্রির শেষ সময়ে স্থানীয়ভাবে কাঁঠালের বিদায় জানাতে নরসিংদীর শিবপুরে শত বছর ধরে চলে আসছে কাঁঠালের ‘নিশান উৎসব’। এ অঞ্চলের কৃষকেরা উৎসবটি উদযাপন করে আসছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে।

উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এ উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। বিশেষ করে বাঘাব, জয়নগর ও যোশর ইউনিয়নে এই উৎসব বেশি উদযাপিত হয়। এ ইউনিয়নের কৃষক ও ব্যবসায়ীরা মৌসুমের শেষের দিকে বড় বড় কাঁঠাল ভ্যানে বোঝাই করে বিভিন্ন রঙ-বেরঙের নিশান দিয়ে সাজিয়ে স্থানীয় চৈতন্যা, কামারটেক, গাবতলী, বারিচা ও মরজাল বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন। উৎসবে গান-বাজনা বাজিয়ে আনন্দ করেন নানান বয়েসি মানুষ।

প্রতি বছর কাঁঠালের মৌসুমের শেষদিকে গাছে থাকা অবশিষ্ট ভালো ও বড় কাঁঠাল এভাবেই হাটে বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে যান তারা। কাঁঠালকে বিদায় জানাতে মূলত এ উৎসবের আয়োজন করা হয়।

গাছের বড় বড় কাঁঠাল ভ্যানগাড়িতে সাজিয়ে নিশান উঠিয়ে নেচে-গেয়ে উদযাপন করা হয়, 'কাঁঠাল উৎসব', ছবি- বার্তা২৪.কম


স্থানীয়ভাবে এ উৎসবকে বলা হয় কাঁঠালের ‘নিশান উৎসব’। নিশান উঠিয়ে বিভিন্ন রঙে সাজানো হয় কাঁঠালের ভ্যান। পরে ঢাকঢোলের তালে তালে নেচেগেয়ে সেই কাঁঠাল বাজারে বিক্রি করা হয়। এতে ভালো দামও পাওয়া যায়। উপজেলার বিভিন্ন এলাকাতেও বিভিন্ন সময় এ উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে।

স্থানীয়দের মতে, শত বছরেরও বেশি সময় ধরে বছরের ভাদ্র মাসে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। শ্রাবণ মাসের মাসের শেষদিকে অথবা ভাদ্র মাসের শুরুতে একটা দিনে সকালে গ্রামের কাঁঠাল ব্যবসায়ী ও কৃষকেরা একটি স্থানে জড়ো হন। এ উৎসবটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম টিকে থাকবে বলে প্রত্যাশা এলাকাবাসীর।

শিবপুর উপজেলার ছোটাবন্দ এলাকার কৃষক ফারুক মিয়া জানান, একসময় দাদা, পরে বাবা, বর্তমানে তিনি নিজে এই কাঁঠাল বাগান করেন। পাশাপাশি এলাকার কাঁঠাল মৌসুমে বাগান কিনে থাকেন।

প্রতি মৌসুমে কাঁঠাল বিক্রি শেষের দিকে গাছের বড় বড় কাঁঠাল পেড়ে একসঙ্গে করে এলাকার কৃষকেরা একসঙ্গে হয়ে কাঁঠাল ভ্যান বোঝাই করেন। সবাই মিলেমিশে সেই ভ্যানগাড়িটি বিভিন্ন রঙ-বেরঙের কাগজ দিয়ে সাজানো হয়। এভাবেই বিভিন্ন গান-বাজনার তালে তালে নেচে-গেয়ে বাজারে নিয়ে বিক্রি করা হয়। বিক্রি শেষে বাড়ি ফিরে এসে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয়। তিনি আশা করেন, পরবর্তী প্রজন্মও এটি ধরে রাখবে। নতুন প্রজন্মের সদস্যদের মতে, ছোটকাল থেকেই দেখে আসা বাপ-দাদারা এ উৎসবের আয়োজন করে আসছেন। সেই ঐতিহ্য ধরে রাখতেই এ উৎসব।

এবার কাঁঠালের ফলন ভালো হয়েছে; সে কারণে তাই আনন্দটাও বেশি। প্রতিবছরই এ সময়টাতে যার যার গাছ থেকে শেষ সময়ের ভালো কাঁঠাল নিয়ে এসে একটি জায়গায় জমায়েত হন এলাকাবাসী। পরে সেখান থেকে দল বেঁধে বাজারে যান।

কারো কারো ভ্যানে ব্যানার টানিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়, কোন ব্যাপারীর কাঁঠাল, ছবি- নরসিংদীর শিবপুর, বার্তা২৪.কম


শিবপুর উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা উজ্জল চন্দ্র দেবনাথ জানিয়েছেন, নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার জয়নগর, যোশর ও বাঘাবো ইউনিয়নে সব থেকে বেশি কাঁঠাল উৎপাদন হয়ে থাকে। কৃষকদের কাঁঠালে পোকা-মাকড় রোধে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক সেবা দেওয়া হয়ে থাকে আর মৌসুমের শেষে কাঁঠালের নিশান উৎসবটি কৃষকের মনে একধরনের আনন্দ দেওয়ার লক্ষ্যেই ঐতিহ্যগতভাবে ধরে রেখেছেন এই অঞ্চলের কৃষকেরা।

শিবপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিন সাদেক বলেন, নরসিংদী জেলার মধ্যে শিবপুর উপজেলা প্রাচীনকাল থেকে কাঁঠাল উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। কেননা, এই অঞ্চলকে মূলত ‘মধুপুর গড় অঞ্চল’ বলা হয়ে থাকে।

এখানকার মাটি লালচে, এঁটেল ও পাহাড়ি অঞ্চলবেষ্টিত। এই উপজেলায় হেক্টরপ্রতি ৪০ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়ে থাকে। সেই হিসাবে উপজেলায় এ বছর ৬শ ৮৫ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদন হয়েছে। কাঁঠাল যাতে বারোমাসী উৎপাদন করা যায়, সেই বিষয়ে কৃষি বিভাগ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে আর এটি শুরু হলে কৃষকেরা সবসময় কাঁঠাল উৎপাদনের পাশিাপাশি উপযুক্ত মূল্যও পাবেন।