বাঙালি, গুজরাতিরাই ভারতের ডোমেস্টিক ট্যুরিজমের মেরুদণ্ড

  • কনক জ্যোতি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

মুঘল ঐতিহ্যময় দুর্গ। ছবি: বার্তা২৪.কম

মুঘল ঐতিহ্যময় দুর্গ। ছবি: বার্তা২৪.কম

বিস্ময়কর মুঘল স্থাপনা আর ঐতিহাসিক, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য ভারত বিশ্ব পর্যটন মানচিত্রের অন্যতম শীর্ষ দেশ। বিশ্বের লক্ষ লক্ষ ভ্রমণপিয়াসী মানুষ প্রতিবছরই ভিড় করেন ভারতের নানা পর্যটন ডেস্টিনেশানে। তবে বহু জাতি, ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতিতে ভরপুর ভারত নামক দেশটির আভ্যন্তরীণ পর্যটনের মেরুদণ্ড হিসেবে গণ্য করা হয় বাঙালি ও গুজরাতিদের।

অভিনব পর্যটন সংশ্লিষ্ট উদ্যোগের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে, যাতে গুজরাতেরর ছয়টি ট্রাভেল এজেন্ট অংশ নেয়। প্রতিষ্ঠান ছয়টি সারা ভারত জুড়ে সড়ক ভ্রমণের আয়োজন করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ডোমেস্টিক বা আভ্যন্তরীণ ট্যুরিজম বাড়ানো এবং করোনা মহামারির ফলে পর্যটন শিল্পে যে মন্দা এসেছে, তা কাটিয়ে ওঠা।

বিজ্ঞাপন

উদ্যোক্তারা যখন কলকাতায় পৌঁছলেন, তখন স্থানীয় গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানান। ট্রাভেল এজেন্ট রাজিব শেঠি স্পষ্টভাষায় বলেন, ‘বাঙালিরা এবং গুজরাতিরাই ভারতের ডোমেস্টিক ট্যুরিজমের মেরুদণ্ড। এরা ঘর থেকে না বেরোলে ভারতের ডোমেস্টিক ট্যুরিজমের কোনও উন্নতি হবে না।’

ভারতের ভ্রমণ সংস্কৃতিতে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, যে কোনও ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশনে বাঙালির দেখা পাওয়া যাবেই। এর পিছনে অনেক কারণ রয়েছে, যা ব্যাখ্যা করেছেন দিল্লির ‘ওয়ান্ডারার্স ফুটপ্রিন্ট’ নামে ‘ট্রাভেল বুটিক’-এর পরিচালক পার্বতী ভট্টাচার্য।

তার মনে পড়ে প্রায় ১৫ বছর আগে ছুটি কাটাতে হিমালয়ের কোলে লেহ’র এক নির্জন প্রান্তে গিয়েছিলেন। অনিবার্যভাবেই সেখানে দেখা পেলেন একদল বাঙালির। লাদাখ সবে জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে তখন।

barta24
জয়পুরের অনন্য হাওয়া মহল। ছবি: বার্তা২৪.কম

এমন উদাহরণও রয়েছে যে, বাঙালিরাই প্রথম কাশ্মীরকে 'হানিমুন ডেস্টিনেশান' করেন। কলকাতার প্রবীণ দাশগুপ্ত দম্পতি জানান, ‘১৯৭১ সালে মধুচন্দ্রিমা যাপনে তারা গিয়েছিলেন কাশ্মীর। গুলমার্গ এবং বিখ্যাত ট্যুরিস্ট স্পটগুলোয় দেখেছেন, গাইডেরা সাবলীল হিন্দি, অল্প অল্প ইংরেজি এবং আশ্চর্যভাবে খুব ভালো বাংলা বলতে পারেন। কারণ, প্রচুর বাঙালি পর্যটকের সঙ্গে তখনই তাদের কথা বলতে হয়।’

মজার অভিজ্ঞতার কথা বলেন বাঙালি ভ্রামণিক পিনাকি ঘোষ, যিনি ১৯৯০-এর দশকে জার্মানির এক ছোট্ট শহরে গিয়েছিলেন এয়ার শো দেখতে। তিনি জানান, ‘আমি হাজির হয়েছিলাম হঠাৎই। শহরটার নামও মনে নেই। সেখানেও দেখি দু’জন বাঙালি। দুই গবেষক-পড়ুয়া বাঙালি দিব্যি কাজ করছেন ইউরোপের সেই নিভৃত শহরে।’

বিশ্বায়নের তোড়ে বিশ্বের প্রত্যেক কোণে পৌঁছে গিয়েছে বাঙালি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কালজয়ী ‘চাঁদের পাহাড়’-এর শংকর হয়ে তারা ঘুরছেন বিশ্বময়। পৃথিবীর কেন্দ্র কিংবা প্রান্তে কান পাতলেই শোনা যাবে বাংলার মধুর ধ্বণিপুঞ্জ।

‘খোরলো ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস’-এর নীলাঞ্জন বসু জানান, ‘বাঙালিরা ঘুরতে ভালোবাসেন, তবে গন্তব্যের ব্যাপারে তারা একটু খুঁতখুঁতে। বেশিরভাগ বাঙালি অ্যাডভেঞ্চার ভ্রমণ পছন্দ করেন না। অফবিট জায়গাতেও গরম খাবার এবং থাকার আরামদায়ক বন্দোবস্ত আশা করেন। খুব বেশি খরচ করতে চান না। তবে তারা কৌতূহলী এবং নতুন বিষয়ে জানার জন্য ভীষণ আগ্রহী।’

barta24
বিশ্বের বিস্ময় আগ্রার তাজমহল। ছবি: বার্তা২৪.কম

‘খরচের কথা বিবেচনা করলে দেখা যাবে, বেশির ভাগ বাঙালিই পছন্দ করেন বাজেট ট্যুরিজম’, ট্রাভেল অপারেটররা এই তথ্য দিয়েছেন। কয়েক বছর আগে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ভারতীয় পর্যটন মেলায় একজন মুখপাত্র বলেছিলেন, ‘সারা ভারতে সর্বোচ্চ স্থানে এমনকি বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ভ্রমণপ্রিয় জাতি বাঙালি, যারা বাজেট ট্যুরিজম পছন্দ করেন।’

এ কথার সত্যতা পাওয়া যায় লকডাউনের পর পরই, যখন পর্যটন আবার শুরু হল, খুব দ্রুতই পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অর্থ উপার্জন বাড়তে থাকে। কারণ, মহামারির ফাঁকফোকর গলে নিজের রাজ্যেই সংক্ষিপ্ত-দূরত্বে ঘুরতে বেড়িয়ে পড়েন বাঙালিরা।

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের ভ্রমণের বাতিক মব্জাগত। ভ্রমণ সংস্কৃতি তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। ভ্রমণের জন্য তারা আর্থিক ও বাৎসরিক পরিকল্পনা মোতাবেক সুচিন্তিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

দিঘা-পুরী-দার্জিলিং, বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় তিন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য সারা বছরের বাজেটে খরচ বরাদ্দ করে রাখেন বাঙালি মধ্যবিত্তরা। পশ্চিমবঙ্গের বিচিত্র সব গন্তব্য, পাহাড় থেকে সমুদ্র চষে বেড়াতে বাঙালি সব সময়ই প্রস্তুত।

পশ্চিমবঙ্গ কিংবা সর্বভারতী পরিসরে বাঙালির দৃষ্টান্তমূলক ভ্রমণ প্রচেষ্টার মধ্যে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষাও রয়েছে। সেটা হিমালয় বা থর মরুভূমি কিংবা কচ্ছের দুর্গম অঞ্চলের গভীরে চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, তেমনই অচেনা জায়গায় নিজের পছন্দের খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান।

যেমন কুণ্ডু স্পেশালের ‘কিচেন ট্যুরস’। অনেকেই রয়েছেন, যারা বাইরের খাবারে স্বছন্দ নন, তারা যাতে নিজেদের রান্নার সামগ্রী নিয়ে যেতে পারেন, তার বন্দোবস্ত করে দেওয়া হয় ‘কিচেন ট্যুরস’-এ।

ভারতের অন্যতম প্রাচীন ট্যুর অপারেটর 'কুণ্ডু স্পেশাল' নিজেই এক ঐতিহ্য হয়ে শতবর্ষ ছুঁতে চলেছে। স্বল্প খরচে বাঙালি হিন্দুর তীর্থভ্রমণের জন্য ১৯৩৩ সালে শ্রীপতি চরণ কুণ্ডু'র উদ্যোগ দিনে দিনি কলেবর বাড়িয়ে এখনও চলমান।

মধ্য কলকাতার এসপ্ল্যানেডে ১, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ছাড়াও কলকাতার তিনটি অফিস নিয়ে তৎপর কুণ্ডু। সারা বছরই চলছে নানা প্যাকেজ। সাশ্রয়ী খরচে ভ্রমণের জন্য আগাম বুকিং দিয়ে এদের সেবা গ্রহণ করে মধ্যবিত্ত বাঙালিরা।

শুধু ভ্রমণই নয়, বাঙালির ভ্রমণ সাহিত্যও অনন্য। ভারতে অন্য কোথাও ভ্রমণ সাহিত্যের এমন সমৃদ্ধ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে কিনা সন্দেহ। এক রবীন্দ্রনাথই ভ্রমণে দৃষ্টান্তস্বরূপ। ভ্রমণ ও ভ্রমণ সাহিত্যেও তিনি অতুলনীয়।

১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পাঁচটি মহাদেশের তেত্রিশটিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। তবে ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাদ দিলে অন্যান্য দেশসমূহ ভ্রমণ করেছেন ১৯১৩-তে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর।

দেশগুলো হলো: ফ্রান্স, হংকং, চীন, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, অস্ট্রিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, আর্জেন্টিনা, ইতালি, নরওয়ে, হাঙ্গেরী, যুগোশ্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, রুমানিয়া, গ্রীস, মিশর, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, জাপান, বার্মা, হল্যান্ড, সোভিয়েট রাশিয়া, ইরান, ইরাক ও শ্রীলঙ্কা।

১৯৩৪ এ শ্রীলঙ্কা (সিংহল) ভ্রমণ শেষে কবি শান্তিনিকেতনে ফেরেন ২৮ জুন। এরপর তিনি আর বিদেশভ্রমণে যান নি। এই ভ্রমণগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই রবীন্দ্রনাথের জীবনে ও সাহিত্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে।

ঔপনিবেশিক বিরূপতার মধ্যে নানা বিঘ্ন পেরিয়ে প্রবীণ কবির ভ্রমণ সত্যিই অনুপ্রেরণার, যে ঐতিহ্য বহনে বাঙালির কৃতিত্ব অনন্যতায় উজ্জ্বল।