সুরের নিভৃত জগতের আজাদ রহমান

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

আজাদ রহমান, ছবি: সংগৃহীত

আজাদ রহমান, ছবি: সংগৃহীত

জীবৎকালেও তিনি ছিলেন নীরব ও নিভৃতচারী। খুব একটা হৈচৈ, আত্মপ্রচার, মিডিয়ার লাইম লাইট মোটেও পছন্দ করতেন না। একজন গুণী শিল্পী, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক-সাধক যেমন আত্মমগ্ন থাকেন বা থাকার কথা, নিজের সুরের ভুবনে, আজাদ রহমান ছিলেন ঠিক তেমনি।    

মৃত্যুর (১৬ মে) কারণে অনেক বছর অনালোচিত থাকার পর আবার তাকে নিয়ে সবাই সরব হয়েছেন। অথচ এতবড় একজন শিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালককে এতদিন মূল্যায়ন বা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যথাযথ মর্যাদায় উপস্থাপন করতে না পারার ব্যর্থতা দেখানো হয়েছে, যা সত্যিই দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক।

আজাদ রহমান বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনে যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা যুগান্তকারী ও সুদূরপ্রসারী। সত্তর দশকে আমাদের সঙ্গীতবোধ ও গানের জন্য 'কান'কে বিনির্মাণ করেছেন তিনি। মনে রাখতে হবে, ষাটের দশকের হেমন্ত, মান্না, মানবেন্দ্র, শ্যামল, কিশোর শুনে শুনে যে 'গানের কান' আমাদের নির্মিত বা তৈরি হয়েছিল, তাকে ঢাকার সীমিত সুযোগ ও আয়োজনের মাধ্যমে বিনির্মাণ করা সহজ বিষয় ছিলনা, ছিল বিরাট বড় চ্যালেঞ্জের।   

আজাদ রহমান সে চ্যালেঞ্জ যোগ্যতার সঙ্গে অতিক্রম করে স্বাধীনতা-পরবর্তী আধুনিক বাংলা গানকে একটি সম্মানজনক ও স্রোতা-প্রিয় অবস্থানে উত্তীর্ণ করেন। নিজে খেয়াল গানের একজন অগ্রণী শিল্পী এবং সঙ্গীতের উচ্চতর শিক্ষাপ্রাপ্ত ছিলেন বলে গানকে সস্তা, চটুল, গতানুগতিকতার কবল থেকে বাঁচাতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। ফলে ব্যাকরণ সম্মত, নান্দনিক সঙ্গীত প্রবাহের একটি চমৎকার স্রোত তার সমগ্র সঙ্গীতজীবনকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। শিল্পী, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ইত্যাদি সকল পরিচয় ও অবস্থানেই তিনি তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বলতার সঙ্গে ধারণ করেছেন। এমনকি, সিনেমার গানেও তিনি চমকপ্রদ আবহ সৃজন করে সুস্থ সঙ্গীতের সুরে ও তালে শ্রোতাদের বিমোহিত করেছেন।

মধ্য সত্তর ও আশি দশকে আজাদ রহমানের ক্যারিয়ারের উতুঙ্গ কালে 'এপার ওপার', 'অনন্ত প্রেম', 'আগুন', 'মায়ার বাঁধন'সহ অসংখ্য চলচ্চিত্রে তিনি সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তার সুরকৃত ও তার নিজেরই কণ্ঠে গাওয়া 'এপার ওপার' চলচ্চিত্রের 'ভালবাসার মূল্য কত', 'ডুমুরের ফুল' চলচ্চিত্রের 'কারো মনে ভক্তি মায়ে', 'দস্যু বনহুর' চলচ্চিত্রের 'ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়' গানগুলো সত্তর-আশি দশকে জনপ্রিয়তা লাভ করে। তিনি চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি 'জন্ম আমার ধন্য হলো মা গো'-এর মত উল্লেখযোগ্য দেশাত্মবোধক গানের সুর করে অসংখ্য শ্রোতার চিত্ত জয় করেন।         
         
১৯৭৭ সালের কথা। একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেলো ঢাকার প্রেক্ষাগৃহে, চমকপ্রদ কাহিনীর পাশাপাশি তাতে ছিল বাঁশির ঐন্দ্রজালিক সুর মূর্ছনা। ছবিটিতে দরিদ্র বিধবা মায়ের সন্তান যাদু বাঁশি বাজিয়ে গ্রামবাসীকে বিমোহিত করে। গ্রামের কিছু লোক এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে গ্রাম থেকে বের করে দেয়। নদীর তীরে ডুবতে থাকা জেলে মোহর আলীর স্ত্রীকে বাঁচায় সে। মোহর আলী তার একটা কাজের বন্দোবস্ত করে দেয়। কিন্তু সে তার মালিক তমিজ আলীর মেয়ের পাখির সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যায়। তমিজ আলী জানতে পেরে যাদু ও মোহর আলীকে শাসায়। মোহর আলী ও তার স্ত্রী আমেনার সাহায্যে তারা বিয়ে করে এবং গ্রাম ছেড়ে শহরে পালিয়ে যায়। ইতিমধ্যে যাদু অসুস্থ হয়ে পরলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে তার ক্যান্সার ধরা পরে। অন্যদিকে পাখির চাচার কুবুদ্ধিতে পাখি যাদুকে হাসপাতালে একা রেখে বাড়ি চলে যায় এবং গৃহবন্দী হয়।

এমনই এক বেদনাময় কাহিনীর সঙ্গীতমুখর 'যাদুর বাঁশি' নামের ছায়াছবিটির সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন তিনি। তাতে গীত রচনা করেন আহমদ জামান চৌধুরী খোকা ভাই। গানে কণ্ঠ দেন সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, খুরশিদ আলম। যাদুর বাঁশি বাজিয়েছেন আবদুর রহমান। সুর, সঙ্গীত, বাঁশির সমন্বয়ে নাটকীয় কাহিনীর এমন ছবি বাংলা চলচ্চিত্রে খুব বেশি নির্মিত হয়নি।

অনেক পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। কিন্তু তার সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো বাংলাদেশের শ্রোতাদের ভালোবাসা। আজো তার গানের কলি স্মৃতিকাতর করে মানুষকে।

আজাদ রহমানের 'দস্যু বনহুর' চলচ্চিত্রে 'ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়' শীর্ষক বিখ্যাত গানের একটি লাইন হলো 'মুখ ঢাকা মুখোশে এই দুনিয়া, মানুষকে কি করে চিনবো বলো'। আশ্চর্য, তিনি যখন বিদায় নিলেন, করোনার কারণে দুনিয়ার মানুষ নিজেদের লুকনো মুখোশের বদলে বাস্তবিক মুখোশই পরে আছে আর সেই সঙ্কুল পরিস্থিতিতে মুখোশের অন্তরাল ভেদ করে নানাবিধ আচরণ ও কার্যক্রমের দ্বারা মানুষ ও অমানুষ ঠিকই চেনা যাচ্ছে।

আমাদের ব্যর্থতা এটাই যে, তার মতো গুণী শিল্পী, মেধাবী সুরকার ও নেতৃত্বস্থানীয় সঙ্গীতপরিচালক আধুনিক বাংলা সঙ্গীত জগতে যে অম্লান অবদান রেখেছেন, তা পুরোটা চিনতে ও শনাক্ত করতে পারনি আমরা। সুরের নিভৃত জগতে অবস্থান করে অতি নিভৃতেই তিনি আরেক জগতে চলে গেলেন চিরদিনের জন্য। সুরের আকাশে তার গানগুলো রইলো তারকার দীপ্তিতে।