বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে ব্যবসায়ীদের আস্থায় আনার তাগিদ
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির অগ্রগতির জন্য বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে সবার আগে ব্যবসায়ীদের আস্থায় আনতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন। একটি জাতীয় দৈনিককে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় এ মন্তব্য করেছেন তিনি।
অর্থনৈতিক মন্দায় রাজস্ব আয় বাড়ানো, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা দূর করে সবল করা এবং আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করাই অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে চিহ্নিত করছেন অর্থনীতিবিদ ও খাত সংশ্লিষ্টরা।
বিদায়ি বছরের মতো উচ্চ মূল্যস্ফীতি নতুন বছরেও ভোগাবে বলে মনে করা হচ্ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ শতাংশের বেশি। এই মূল্যস্ফীতির হিসাব নিয়ে বিতর্ক ছিল।
বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ, মাঝারি ও ছোট উদ্যোক্তাদেরও ব্যবসা-বাণিজ্যে অচলাবস্থা নেমেছে। ব্যবসায়ীদের এলসি নেই বললেই চলে। অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছেন। মুদি দোকান-ফুটপাতে বেচাকেনা নেই। ব্যবসা না থাকায় মানুষের মধ্যে অর্থের প্রবাহও নেই। দেশে নতুন বিনিয়োগ আসছে না। কর্মসংস্থান বাড়াছে না। ডলার সংকট, ঋণের উচ্চ সুদহারের প্রভাব নতুন বছরেও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই দুরবস্থার প্রভাব নতুন বছরেও থাকতে পারে।
অর্থনীতির এই নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘নীতি সুদহার বাড়া মানে ব্যাংকঋণের সুদহার বাড়া। নীতি সুদহার বাড়ানোর ফলে সেটা আরো বেড়ে গেছে। এখন নতুন বিনিয়োগ দূরের কথা, টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত ব্যবসায়ীসমাজ। যখন ব্যাংকের সুদহার বেড়ে যায় তখন সব হিসাব ওলটপালট হয়ে যায়। কারণ কিস্তির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং মুনাফার হার কমে আসে।’
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে এক ধরনের অনিশ্চয়তা চলছে। আগামী এক-দেড় বছরে রাজনীতি কোন দিকে যায়, তা নিয়ে চিন্তায় আছেন ব্যবসায়ীরা। আবার কারা ক্ষমতায় যেতে পারে, তা-ও তাঁরা বিবেচনায় রাখছেন। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে ব্যবসায়ীদের আস্থায় আনতে হবে।’
সরকার পরিবর্তনের পর এই মূল্যস্ফীতি গড়ে ১১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি সর্বশেষ ১৩.৮৮ শতাংশে পৌঁছেছে। কিন্তু জাতীয় মজুরি হার কয়েক মাস ধরেই ৮ শতাংশের ঘরে আটকে আছে। মূল্যস্ফীতির তুলনায় মানুষের আয় কম হারে বাড়ায় মানুষের কষ্ট বাড়ছে।
ক্ষমতায় নতুন সরকার আসার পর সুদের হার বাড়িয়ে, কিছু শুল্ক কমানোসহ অন্যান্য পদক্ষেপ নিলেও মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা যায়নি। পরে টাকা ছাপিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছে। নতুন বছরেও টাকা ছাপা অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতি আরো অসহনীয় হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘গত দুই-তিন বছরে অর্থনীতি যে পরিমাণ অবনমিত হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা আগামী বছরও বজায় থাকবে। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যতটা খারাপ অবস্থায় গেছে, সেটা টেনে তুলতে সময় লাগবে।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর অর্থ মন্ত্রণালয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ কমে যাওয়া, আর্থিক খাতের লুটপাট, বিনিয়োগে স্থবিরতা—সব কিছু মিলিয়ে ম্যাক্রো ইকোনমি বা সামষ্টিক অর্থনীতিটা দুর্বল হয়েছে। অভ্যুত্থানের পর নেওয়া সব পদক্ষেপই যে ফলপ্রসূ হচ্ছে তা কিন্তু নয়। নীতি সুদহার বাড়িয়ে মুদ্রা সংকোচন নীতির মাধ্যমে বাজারে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা করছে সরকার। কিন্তু সেটা সফলতা আনেনি। উল্টো মুদ্রাস্ফীতি বেড়েই চলছে। শুধু মুদ্রানীতি সংকোচনের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। মানুষের চাহিদা কিংবা বিনিয়োগ কোনোটিই বাড়েনি। দুই বছর আগে থেকেই বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ভারসাম্য নেতিবাচক ছিল। রপ্তানি ও আমদানি পার্থক্য কমিয়ে আনার লক্ষ্য ছিল।’
ফাহমিদা খাতুন আরো বলেন, এমনিতেই বিনিয়োগ কম হচ্ছে, তার ওপর সুদহারও অনেক বাড়ানো হয়েছে। ফলে বিনিয়োগ আরো কমবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে সবচেয়ে বেশি ভুগবে ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এই পরিস্থিতি সামলে উঠতে হবে। ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু এই ১০ ব্যাংক নয়, আরো অনেক ব্যাংকের অবস্থাই নাজুক। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করতে হবে।