কি এই ‘নিউ নরমাল’ জীবন ব্যবস্থা?

  • মাজেদুল নয়ন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

দুনিয়াজুড়ে কোভিড-১৯ এর সঙ্গে চলছে সংগ্রাম। মরণঘাতী এই ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা এক কোটি ২০ লাখের বেশি। গত শতকের গোড়ার দিকের স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ে মানুষের তুলনা করা হয়েছে। তবে এই একবিংশ শতাব্দীতে একটি ভাইরাস যে মানবজাতির একেবাবে পাঁজরে এতো কঠিনভাবে আঘাত হানতে পারবে, তার ধারণা কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সভ্যতা করতে পারেনি। বরং বারবার অসহায় হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হচ্ছে। প্রতিনিয়তই সংবাদ মাধ্যমে ওষুধ বা ভ্যাকসিন ট্রায়ালের খবর আসলেও এখনো দুটোর একটিও যে আবিষ্কার হয়নি, সেটি জানা কথা। দুনিয়ার তাবৎ ধনী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অর্থ দান করেছেন করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারের গবেষণার জন্য। তবে এখনো তার কোনো সমাধানে পৌঁছানো যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা দিয়েছেন আরো এক গভীর আশঙ্কার বাণী। বলছেন, এই মহামারিতে রোগে ভুগে যতো মানুষ মারা যাবে, তার চেয়েও প্রকট আকারে ধরা দিতে পারে ক্ষুধা বা অভাব। সেখান থেকেই ‘নিউ নরমাল’ বা ‘নতুন স্বাভাবিকতা’ এর ধারণা দিয়েছেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ। এরই মধ্যে বাংলাদেশেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের খাঁপ খাইয়ে চলার কথা বলেছেন। জীবনের সঙ্গে জীবিকা নির্বাহের তাগিদও দিয়েছেন তিনি।

মূলত ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দুনিয়াজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য থেকেই এই ‘নিউ নরমাল’ শব্দটির প্রচলন শুরু হয়। যেটাতে ছিল মূলত ব্যবসার সঙ্গে অর্থনীতির একটি নিবিড় সম্পর্ক। মানুষ এবং রাষ্ট্রগুলোকে ব্যয় সংকোচন নীতিতে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়। ২০০৮ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে এই নিউ নরমাল বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং পরবর্তীতে বৈশ্বিক অর্থনীতি আবারও পূর্বের জৌলুশ ফিরে পায়। তবে কোভিড-১৯ ভাইরাসের আঘাত নিউ নরমাল টার্মটিকে নিয়ে এসেছে জীবন এবং জীবিকার সম্পর্কের মধ্যে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য এই নিউ নরমালকে আরও বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞাপন

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে এই ‘নিউ নরমাল’ জীবনের ওপর একটি অনলাইন গবেষণা চালিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, মহামারির সময়ে লকডাউন বা কোয়ারান্টাইনে থাকা অবস্থায় মানুষের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপস্থিতি বেড়েছে অনেক বেশি। কর্মস্থল, বাসা এবং সামাজিক জীবনে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে।

জীবন, নাকি জীবিকা? কোভিড-১৯ মহামারির এই সময়ে এই বিতর্কটি বারবার আলোচিত হচ্ছে এবং সরকার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বারবার হিসাব কষতে হচ্ছে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ এখন বলছেন, ‘জীবন’ এবং ‘জীবিকা’ দুটিই আমাদের জন্য সমান প্রয়োজন।

এখন এই বিষয়টা অনেকটা নিশ্চিত যে কোভিড-১৯ ভাইরাসটি হয়তো সহসা যাচ্ছে না। বরং এর সঙ্গে মিলিয়েই আমাদের থাকতে হবে। বাংলাদেশে কর্মজীবীদের ৮০ শতাংশেরও বেশি অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানের ওপর নির্ভরশীল এবং তারা বর্তমানে একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। আপাত দৃষ্টিতে এখন তাদের হাতে দুটি পথ খোলা রয়েছে। দারিদ্রতাকে মেনে নেওয়া অথবা কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের ঝুঁকির মধ্যে থেকেও বেঁচে থাকার জন্য জীবিকা নির্বাহ করা।

এক্ষেত্রে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন যে নিউ নরমাল জীবনের ধারণা দিয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, কোভিড নিয়ন্ত্রণে জন-শৃঙ্খলার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। বিশেষত, আমাদের দেশ এবং সমাজের ক্ষেত্রে সেটি আরো বেশি অনুধাবন করতে হবে। আচরণগত পরিবর্তনগুলো মেনে চলতে হবে- যেমন, ঘন ঘন হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা, মাস্ক পরিধান করা এবং রোগ প্রতিরোধ সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। লক্ষণ প্রদর্শনের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করেই যদি দ্রুত কোয়ারান্টাইন করা যায় এবং যারা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছিলেন তাদেরকেও সঙ্গে সঙ্গে চিহ্নিত করে চিকিৎসার আওতায় আনা যায়, তাহলেই আক্রান্তের সংখ্যা কমানোর পাশাপাশি হাজারো জীবন বাঁচানো সম্ভব। একই সঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে জীবিকা নির্বাহ।

বাইনাস ইউনিভার্সিটি ইন্টারন্যাশনালের ইনোভেশন, ডিজাইন এন্ড এন্টারপ্রেনারশিপ রিসার্চ সেন্টারের প্রধান আরি মার্জিয়োনো অবশ্য বলেছেন, এই ‘নিউ নরমাল’ টার্মে আসলে জীবনের কোনো পরিবর্তন আসবে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবং অল্প কর্মী দিয়ে যে ব্যবসা পরিচালনার কথা বলা হচ্ছে, সেখানে খরচ আরও বেড়ে যাবে। ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এছাড়াও সামাজিক দূরত্ব এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যেয়ে সরকারের পক্ষ থেকেও যে বাড়তি খরচ হবে, সেটি জনগণ থেকেই নেওয়া হবে। যার ফলে জনগণের ব্যয় বেড়ে যাবে।

এদিকে ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম বলছে, এই ‘নিউ নরমাল’ গরিবদের জন্য কোনো ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসবে না। বরং কোভিড-১৯ সংক্রমণের আগে যেমনটা ছিল, অবস্থা আরো ভয়াবহ হবে এবং তাদের জীবন কখনোই আর স্বাভাবিক বা নরমাল হবে না। বরং এই টার্মটিকে ধনীদের জন্যই বলছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে জীবন এবং জীবিকার ক্ষেত্রে অর্থনীতিতে তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন অর্থনীতিবিদেরা। সেগুলো হচ্ছে, ‘বেশি সঞ্চয়, কম খরচ,’ ‘ব্যবসায় নতুন সাপ্লাই চেইন সৃষ্টি,’ এবং ‘ক্ষুদ্র ব্যবসাকে সহায়তা’ প্রদান।

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম