করোনাকালীন অমানবিকতা

  • ড. মো. কামাল উদ্দিন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

করোনাভাইরাস হয়তো দীর্ঘস্থায়ী হবে না। কিন্তু এই ভাইরাসের প্রভাব আমাদের সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রে কত দিন থাকে, সেটিই ভাবনার বিষয়।

করোনার মহামারি ছাড়াও আমাদের সমাজে কত ধরনের মহামারি বিদ্যমান তা করোনা মহামারি সকলের কাছে পরিষ্কার করে দিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই মুরুব্বিদের কাছে শুনে এসেছি বিপদে পড়লে বন্ধু চেনা যায়। সেই কথাটি সত্যি হলো এ করোনাকালে।

বিজ্ঞাপন

করোনার ফলে সত্যিকারের মানুষ ও অমানুষ চেনা যায়। এ মহামারিতে মানবিক মানুষের যেরকম আবির্ভাব হয়েছে, ঠিক সেরকমই অমানবিক মানুষের মুখোশেরও উন্মোচন হয়েছে। সন্তান মায়ের সর্দি কাশি হলে রাস্তায় ফেলে দেয়া ও জঙ্গলে রেখে আসার ঘটনাও ঘটেছে আমাদের এই তথাকথিত মানবিক সমাজে। করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির লাশ দাফনে বাধা, করোনা সন্দেহ হলে বাসস্ট্যান্ডে ফেলে দেয়া, দেখেও কেউ কাছে না ঘেঁষা, করোনা সন্দেহে চিকিৎসা না দেয়া, অ্যাম্বুলেন্সে ১৬ ঘণ্টায় ৬ হাসপাতালে ছোটাছুটি, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু, প্রবাসী সন্দেহে গ্রামবাসীর আক্রমণ, এমন অনেক সংবাদ জাতীয় দৈনিকে পরিলক্ষিত হয়।

এ ধরনের সংবাদ সত্যিকার অর্থে আমাদের ব্যথিত করেছে এবং ভাবিয়ে তুলেছে। একটু ভেবে দেখুন, একজন মানুষ ঘরে কাতরাচ্ছে, অক্সিজেনের অভাবে ঘুরে ঘুরে মরছে, সারাদিন এম্বুলেন্সে অমানবিক কষ্ট করছে, সামাজিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছে, পাশে নেই সমাজের কেউ, বন্ধু-বান্ধব, পরিবার-পরিজন, ছেলে সন্তান। ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবুন, চিন্তা করলে কেমন লাগে।

যে মানুষটি তাদের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য সারা জীবন কষ্ট করেছেন আজ তারাই বিপদে পাশে নেই। এ কেমন পরিবার, এ কেমন সমাজ, এ কেমন রাষ্ট্র আমরা নির্মাণ করেছি। করোনাভাইরাস নিয়ে এই ধরনের অমানবিকতার কোনো যৌক্তিকতা আছে কি?

আমরা সমাজের যে অমানবিক চিত্র দেখেছি তা আমাদেরকে নতুন করে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। যে সমাজে নিজের আপনজনকে হাসপাতালে নেয়ার সময় অ্যাম্বুলেন্স থেকে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে, মানুষকে সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসকের বাড়িঘর আক্রমণ করার ঘটনা ঘটে, ডাক্তার, পুলিশ সাংবাদিককে বাসা থেকে বের করে দেয়ার নোটিশ দেয়ার মতো ঘটনা ঘটে, করোনাকালে ত্রাণের হরিলুটের ঘটনা ঘটে, সামান্য পরিমাণ ত্রাণ দিয়ে সেলফি বাজির হিড়িক পড়ে, সেখানে সমাজের মানবিকতা নিয়ে নতুন করে ভাববার অবকাশ রয়েছে বৈকি।

তবে বিপরীত চিত্রও আছে। আছে মানবিকতার চিত্রও। বেসরকারিভাবে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ত্রাণ দেয়ার প্রবণতা যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তা আমাদেরকে আশান্বিত করেছে। লাশ দাফন করে, নানাভাবে সাহায্য করে নজিরও স্থাপন করেছেন অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।


আবার করোনাকালে থেমে নেই হত্যা, মারামারি, নারী-শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের মতো ঘটনা। এমন এক অস্বাভাবিক অবস্থায় যেখানে মানুষ বাঁচা-মরার লড়াইয়ে ব্যস্ত, সেই সময়ে ধর্ষণ বিশেষ করে শিশু ধর্ষণের মতো ঘটনা আমাদের জাতি হিসেবে লজ্জিত করেছে। সমাজ ও সামাজিক বন্ধন নিয়ে আমরা গর্ববোধ করতাম তা এখন প্রায় বিলীন হওয়ার পথে।

আমরা কত অমানবিক হতে পারি তা এ সময়ে সুস্পষ্ট হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সমাজবিজ্ঞানীদের ওপর দায়িত্ব বেড়েছে। গবেষণা করে খুঁজে দেখতে হবে আমাদের এই অমানবিকতার অন্তর্নিহিত কারণ। আর সেই অনুযায়ী আমাদেরকে এখনই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে, সমাজকে বাঁচাতে হবে। নইলে বর্তমান সমাজ ও মানবিকতা দিয়ে ভবিষ্যৎ আরও ভয়ানক রূপ লাভ করবে, আমরা আবার ফিরে যাবো হবসের প্রকৃতির রাজ্যে, যেখানে থাকবে না কোনো মূল্যবোধ ও মানবিকতা।

ড. মো. কামাল উদ্দিন, প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।