কোভিড- ১৯: কিট নিয়ে কিত কিত

  • গওহার নঈম ওয়ারা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয় জনস হপকিনস জানিয়েছে ইতোমধ্যেই পৃথিবীর ১৮৫টি দেশে করোনাভাইরাস ঘাঁটি গেড়ে বসে গেছে। গত ২৫ এপ্রিল মধ্যরাতে বাংলাদেশ সময় রাত ১২টার দিকে সব মিলিয়ে মোট মৃতের সংখ্যা ছিল দুই লাখ ছয়শ আটানব্বই। এই লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছানোর সময় মৃতের সংখ্যা কোথাও গিয়ে দাঁড়াবে বলা মুশকিল। হিসাবের আরও ভয়ঙ্কর অংক হচ্ছে করোনায় প্রথম মৃত্যুর পর ৫০হাজার ছাড়াতে সময় লাগে ৮২দিন। আর গত ১৫ দিনে বিশ্বজুড়ে মারা গেছেন আরও একলাখ মানুষ।

এপ্রিলে গড়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ৬ হাজার মানুষ। যেন শুরু হয়েছে সংক্ষিপ্ত ক্রিকেটের পাওয়ার প্লে। ক্যাপ্টেন বল তুলে দিয়েছে ফ্রেমের বাইরে থাকা কোন এক বলারের হাতে, পিচে যখন অচেনা কিন্তু তুখোড় এক তরুণ ব্যাটসম্যান। কোন ধারাপাতে তাকে ধরা যাচ্ছে না। রানের পাহাড় গড়ে উঠছে বলে বলে। মৃতের সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। আমাদের ক্যাপ্টেন বোলার ফিল্ডার মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও তাদের পরিধেয়র পেছন দিক যে ক্রমশ ভিজে যাচ্ছে তা সবচেয়ে কম পয়সার দর্শক গ্যালারির শেষ সারিতে বসেও বিলকুল টের পাচ্ছে।

আমাদের পরম প্রতিবেশীর ঘরে এতো রাখঢাক নেই। নেই তেমন ঢাক ঢাক গুড় গুড় ভাব। তাদের হাত গলে যে খবর এসেছে সেটা এখন এখানকার জন্যও সত্য। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিঅয়াল কয়েক দিন আগে মুখ গোমড়া করে সংবাদমাধ্যমের কাছে তার দুশ্চিন্তার কথা আর লুকিয়ে না রেখে জানান, সম্প্রতি ৭৩৬ জনের লালারসের নমুনা পরীক্ষা করে ১৮৬ জনের শরীরে কোভিড-১৯ ভাইরাস ধরা পড়ে। এই আক্রান্তদের কেউই আগেভাগে কিছু টের পাননি। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর)-এর গবেষক রমণ আর গঙ্গাখেড়কর মনে করেন ‘বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক’।

প্রতিবেশীদের জবরদস্ত গণমাধ্যম এনডিটিভি’র চোস্ত সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দেওয়া সময় সাক্ষাৎকারে রমণ আর গঙ্গাখেড়কর চাকরি বাকরির তোয়াক্কা না করে প্রায় গড়গড় জানিয়ে দেন তার মহাদুশ্চিন্তার কথা, ‘‘এখনও পর্যন্ত যত জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের ৮০ শতাংশের মধ্যেই কোনও উপসর্গ দেখা যায়নি। তাই উপসর্গহীনদের কীভাবে শনাক্ত করা যাবে, তা-ই এখন আমাদের প্রধান দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ সংক্রমিত ব্যক্তি যাদের সংস্পর্শে এসেছেন, জনে জনে গিয়ে তাদের পরীক্ষা করে দেখা ছাড়া আর কোনভাবে নতুন করে কেউ সংক্রমিত হয়েছেন কিনা, তা বোঝার উপায় নেই।’’

গঙ্গাখেড়কর মনে করেন, এখন শুধু যাদের উপসর্গ আছে তাদের পরীক্ষা করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে

রাখা সম্ভব হবে না। পরীক্ষা করতে হবে উপসর্গহীনদেরও। আদতে উপসর্গহীনরাই বেশি ভয়ের। শরীরে আপাত কোন আলামত না থাকায় তারা নিজেদের সকল বিধিনিষেধের উপেক্ষা করে বেপরোয়া ঘোরাফেরায় মত্ত থাকছেন। ছড়াচ্ছেন মরণব্যাধি। লকডাউনের সময়কাল যতো বাড়ছে/বাড়বে উপসর্গহীনদের আটকিয়ে রাখা ততো অসাধ্য হয়ে উঠবে। কাজেই রোগ ছড়ানোর ঝুঁকি ততই বাড়তে থাকবে। কাজেই উপসর্গহীনদের শনাক্ত করতে চলমান পরীক্ষা পদ্ধতিতে পরিবর্তন ঘটাতে হবে বলে প্রতিবেশীদের পণ্ডিতরা একমত।

অন্য কথায় যেখানে একটু গন্ধ পাওয়া যাবে সেখানে কোন বাদ বিচার না করে সবাইকে পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ওই যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মেঘ জমার প্রথমক্ষণ থেকেই বলে আসছিল টেস্ট টেস্ট এন্ড টেস্ট। যত টেস্ট ততো তাড়াতাড়ি ছুটকারি মুক্তি। উপসর্গহীনদের জনে জনে পরীক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। ভাইরাস থেকে জামিনের উপায়।

ভূগোলের কারণে আমাদের সাথে আমাদের প্রতিবেশীর ল্যাপটা লেপটি অনেক বেশি। কোভিড-১৯ এর প্রকৃতি এবং সংক্রামণ প্রক্রিয়া প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সাযুজ্য থাকায় বাংলাদেশের হাল যে তার প্রতিবেশীর মতো হবে হচ্ছে সেটা বুঝতে জ্যোতিষী লাগে না। এদেশে পরীক্ষার সাথে সংশ্লিষ্টরা এখন উপসর্গহীন মানুষের মধ্যে সংক্রমণের আলামত পাচ্ছেন। অনুভব করছেন বাদ বিচার না করে উপসর্গহীনদের ব্যাপক পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা। বর্তমান সংক্রমণের অবস্থা বিশ্লেষণ করে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দফতর জানাচ্ছে, "বাংলাদেশ এখন সংক্রমণের হার খুব দ্রুত উপরে উঠছে। মনে হয় না যে এটা আর ক্লাস্টারের মধ্যে থাকছে।"

জাতিসংঘ এইচআইভি/এইডস সেকশনের প্রধান কর্মকর্তা ও বৈশ্বিক সমন্বয়ক ডা. মনিকা বেগ বাংলাদেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে শুরু থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন। তার মূল্যায়ন হচ্ছে সময় নষ্ট না করে বেশি বেশি টেস্ট করে আক্রান্ত সবাইকে খুঁজে বের করে আলাদা করতে হবে। না হলে চিকিৎসা ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।”

অন্য দিকে ডা. বে-নজির আহমেদ (সাবেক পরিচালক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগ) বলছেন “আমরা যেহেতু ভালোমতো কোয়ারেন্টাইনটা করতে পারেনি, এমনকি আমরা যে লকডাউনের কথা বলছি বা সোশ্যাল ডিসটেন্সিং সেখানেও যেহেতু বেশকিছু ঘাটতি থেকে যাচ্ছে, সুতরাং সামনে আমাদের একটা বড়সড় আউটব্রেক হতে থাকলে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।’’ অতএব বেশি বেশি পরীক্ষার কোন বিকল্প নেই।

বর্তমানের খরুচে আর ল্যাবরেটরি নির্ভর ‘আর টি পি সি আর’ পদ্ধতিতে ‘এ এটা সম্ভব না। দরকার ‘র‍্যাপিড ডট ব্লট’ পদ্ধতি। এই বহনযোগ্য সস্তা ও তড়িৎ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা সত্ত্বে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই পদ্ধতিকে অনুমোদন দিয়েছে। ব্যবহার ও কিট তৈরির প্রটোকল তৈরি করে দিয়েছে। সব নীতি নিয়ম মেনেই বাংলাদেশের একটি বেসরকারি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান তার বিজ্ঞানীদের দিয়ে ‘র্যাপিড ডট ব্লট’ পদ্ধতির একটা সহজ কিট উদ্ভাবন করেছেন। যুক্তিপূর্ণ ফলাফলও পেয়েছেন। এটা কোন গোপন তথ্য নয় যে উদ্ভাবক দলের নেতৃতে ছিলেন এদেশের এক আপোষহীন সন্তান ড. বিজন কুমার শীল। ভাইরাস সংক্রমণ নিয়ে পৃথিবীতে যারা কাজ করেন তাদের সবাই তাকে জানেন, চিনেন। ২০০৩ সালে যখন সার্স ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল তখন তিনি সিঙ্গাপুর গবেষণাগারে কয়েকজন সহকারীকে নিয়ে সার্স ভাইরাস দ্রুত নির্ণয়ের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। সেই ‘র্যাপিড ডট ব্লট’ পদ্ধতিটি ড. বিজন কুমার শীলের নামে প্যাটেন্ট করা। পরে এটি চীন সরকার কিনে নেয় এবং সফলভাবে সার্স মোকাবেলা করে।

চাকরি জীবনের শুরুতে একজন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে তিনি যখন বাংলাদেশ গবাদি প্রাণী গবেষণা কেন্দ্রে কাজ করতেন তখনই দেখেছি তার একনিষ্ঠতা। দেশে গোট প্লেগ দেখা দিলে তিনিই একটা দিশা দিয়েছিলেন। নিজের উদ্যোগে এগিয়ে এসেছিলেন। ছাগল পালক গরিব মানুষ আর ছাগল খামারিদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আমলাতন্ত্র সেটাকে বলেছিল “ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস” খাওয়া। শাস্তি হয়েছিলো তার। ক্যারিয়ার তার সেখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু হয়নি। হয়তো যিনি সব কিছুর মালিক তিনি চেয়েছিলেন অন্য কিছু। আজ তিনি আর তার দল তাদের উদ্ভাবিত ‘র্যাপিড ডট ব্লট’ হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। আজও আমরা শুনি, 'আমরা কেন যাব? এটা তো অ্যাপ্রুভড কোনো প্রডাক্ট না। তারা আবেদন করবে। তারপর নিবন্ধনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।'

আমাদের বর্তমান সংকটের মাত্রা আর গভীরতা বুঝলে প্রক্রিয়ার লাল ফিতা কেউ দেখাতো না। এটা প্রক্রিয়া নিয়ে ঘেট হয়ে বসে থাকার সময় নয়। সব প্রটোকল সহজ করে দেশের কাজ করাটাই এখন জরুরি। কেউ মুখ ফুটে বলুক না বলুক সমস্যা কিট নয়। সমস্যাটা হয়তো অন্য জায়গায়। সমস্যা বিজন শীল বা ‘আর টি পি সি আর’ পদ্ধতি নয়। পৃথিবীর প্রথম একটা অনুসরণীয় ওষুধনীতি তৈরি করে এদেশের মানুষের নাগালের মধ্যে মান সম্পন্ন ওষুধের যোগান ঠিক রাখতে ভূমিকা রেখেছেন। বেফজুল ওষুধ উৎপাদন আর বাজারজাত করার প্রক্রিয়া রুখে দিয়েছেন। ওষুধ কোম্পানির অসাধু ব্যবসার মুখোশ খুলে দিয়েছেন। এদেশে পেনিসিলিন উৎপাদনে গিয়েছেন। তারপর আবার কিডনি ডাইয়েলেসিস ব্যবসায়ীদের ভাত মারার পায়তারা করছেন। মানুষের অনুদানে পরিচালিত সেবামূলক প্রতিষ্ঠানও যখন কিডনি ডাইয়েলেসিসের প্রতি শিফটে তিন হাজার টাকা নিচ্ছে তখন আপনি চালু করলেন ৫০০ টাকা শিফট। এখন আবার বলছেন সারা দেশে এটা চালু করবেন। আসলে ইংল্যান্ডে থেকেও ব্রিটিশদের মত ডিপ্লোম্যাসি না শেখাটা তার ভুল। এছাড়া আরও নানা কারণে হতে পারে ডা. জাফরুল্লাহকে শিক্ষা দেওয়াটাও খুব জরুরি। তবে কিট নিয়ে কোনো পক্ষেরই বাড়াবাড়ি করার দরকার নেই। যদি কাজের হয় কাজে লাগালে ক্ষতি কি? যদি কাজের না হয়, তবে এ নিয়ে ডা. জাফরুল্লাহরও উচিত নয় বাড়াবাড়ি করার। তার বিচার করা যাবে। ডা. জাফরুল্লাহ পালাচ্ছে না, পালাতে পারবেনও না, একদিন পর পর তার কিডনি পরিষ্কার করতে হয়। বয়স হয়েছে। শেষ বিচারটা না হয় আল্লাহকেই করতে দিন। তার আগে তার কিটটার বিচার করুন।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক গবেষক