বাসায় থাকুন, সন্তানকে সময় দিন

  • সফিউল আযম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

করোনাভাইরাসের কারণে সবাই বাসায় অবস্থান করছি। এখন সন্তানকে সময় দেয়ার অফুরন্ত সময় আমাদের হাতে আছে। চাকরিজীবী বাবা মা’র পক্ষে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সন্তানকে বেশি সময় দেয়া হয়ে ওঠে না। সরকার ইতোমধ্যে ছুটির মেয়াদ আরও বাড়িয়েছে। তাই এই সময়ে সন্তানকে নীতি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের পাঠ দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

আমরা জানি সন্তানের নৈতিক ও মানবিক বিকাশের প্রথম শিক্ষক হলো পরিবার। সঠিক পরিচালনা ও পরিকল্পনার মাধ্যমে সন্তানকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পিতা-মাতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মনে রাখতে হবে, শুধু একাডেমিক শিক্ষায় শিক্ষিত করলেই হবে না, সুশিক্ষিত করতে হবে। এজন্য শিশুদের মধ্যে যে সুপ্ত প্রতিভা আছে, মানবিক গুণাবলী আছে, সেগুলোকে জাগ্রত করতে হবে। সৃষ্টিশীল চিন্তার প্রসার ঘটাতে উজ্জীবিত করতে হবে।

আবার অনেক সময় সুযোগ পেয়েছি বলেই একবারে সব শেখানোর চেষ্টা করি বা করবো, তা হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা। বয়স ও ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী আস্তে আস্তে অল্প অল্প করে শেখানোর চেষ্টা করতে হবে। আগে বুঝতে হবে, সন্তান কতটুকু নিতে পারবে। খুব বেশি চাপ প্রয়োগ করলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। সন্তানকে প্রথমেই বুঝাতে বাবা মা ওর কাছে কি চায়, তার কাছেও জানতে হবে সে কি চায়। শিশুর মতামতকেও প্রাধান্য দিতে হবে। আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে চাই না, ফলে শিশুরা অনেক ক্ষেত্রেই অভিভাবককে শুনতে চায় না।  

ছোট্ট শিশুরা কিংবা আদরের সন্তানরা সাধারণত বড়দের অনুকরণ করে। বড়দের কাছ থেকে শেখে। তাই এই অবসর সময়ে এমন কিছু ব্যতিক্রমী ও শিক্ষণীয় সেরা কাজটা সন্তানকে দেয়ার উপযুক্ত সময়। সন্তানকে নীতি নৈতিকতা, শাসন ও অনুশাসনের বিষয়গুলো শেখাতে হবে। ভদ্রতা ও সৌজন্যতা শেখানোর এখনই মোক্ষম সময়। কখন, কোথায়, কীভাবে সৌজন্যতা দেখাতে হয় কিংবা প্রয়োগ করতে হয় সেগুলো সন্তানের মধ্যে বপন করতে হবে। বড় ও ছোটদের সাথে কীভাবে আচরণ করতে হয় সেগুলো সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে।

সন্তান ভুল করলে বাবা মা রেগে যান অনেকক্ষেত্রেই। অনেক বকাও দেন। এটা কখনোই করা যাবে না। মনে রাখতে হবে শিশুরা প্রশংসা শুনতে চায়। ভালো কাজে তাদের উৎসাহ দিলে কাজের প্রতি ওদের গতিও বেড়ে যায়। যদি কোনো ভুল করেই ফেলে তাদের বুঝাতে হবে। সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে। ছোট ছোট পুরস্কারও দেয়া যেতে পারে। একটা বিষয় মনে রাখতে হবে নেতিবাচক শব্দ ব্যবহারে শিশুকে নিয়মানুবর্তিতা শেখানো যায় না। শিশুদের অবজ্ঞা কিংবা উপহাস করলে তাদের ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগে। ফলে তারা আরও একরোখা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এখন স্কুল কিংবা কোচিং সবই বন্ধ। বাসায় প্রাইভেট টিউটরও নেই। শিশুদের হাতে অনেক সময়। ফলে শিশুরা কম্পিউটার গেমস কিংবা মোবাইলে বেশি সময় দেয়ার চেষ্টা করবে। খুব কৌশলে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শিশুদের উপযোগী বিভিন্ন ই-লার্নিং কোর্স আছে, সেগুলো সন্তানের জন্য বাচাই করতে পারেন। তবে এখানেও সতর্ক থাকতে হবে, কোনোভাবেই যাতে ইলেকট্রনিক ডিভাইসে বেশি সময় ব্যয় না হয়। এই সময় যেহেতু শিশুর স্কুলে যাওয়ার তাড়া নেই কিংবা খুব ভোরে ক্লাস নেই। তাই সকালের নাস্তা তৈরি হতে শুরু করে সংসারের সব কাজে সন্তানকে সম্পৃক্ত করুন। এতে পরিবারের কাজের প্রতি একটা ধারণা তৈরি হবে এবং সহায়তার মনোভাবও সৃষ্টি হবে।

ছোট বয়সেই সন্তানকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সন্তানের মনে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। দেশের মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। পরিবার ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার বিষয়টিও সামনে নিয়ে আসতে হবে। যে কাজটি ব্যস্ত সময়ে করা যায় না, এই অফুরন্ত সময়ে সন্তানকে দেশপ্রেমের দীক্ষায় উজ্জীবিত করার কাজটি করা যায় অনায়াসেই।

আমরা অনেকেই ডিজিটাল যুগে বইয়ের কথা ভুলতে বসেছি। প্রযুক্তির উৎকর্ষে শিশুরা বই পড়ার আনন্দ থেকে অনেকটাই বঞ্চিত। পাঠ্য বইয়ের বাইরে সৃজনশীল বিভিন্ন বই সন্তানকে পড়ানোর অভ্যাস করাতে হবে, যাতে একাডেমিক বইয়ের বাইরের বই সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয় এবং সাহিত্যের আনন্দ পুরোপুরি নিতে পারে। মোবাইল, কার্টুন আর কম্পিউটারের উপর থেকে চোখ সরিয়ে শিশুদের কল্পনাশক্তির আধার হিসেবে বই পড়ার অভ্যাসটা এই অবসরে করে দেয়ার সুযোগ রয়েছে।

একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, সন্তানের মন জয় করতে হবে ভালবাসা দিয়ে। কখনোই অপমান করে কিংবা উপদেশ দিয়ে কিছু আদায় করা যায় না। একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে সন্তানের মনকে বুঝতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজও আদায় করে নিতে হবে। সর্বোপরি সন্তানকে বন্ধু মনে করতে হবে। কোনা লুকোচুরি না করে শাসনের মাত্রা না বাড়িয়ে আদর ও ভালবাসায় সন্তানকে গড়ে তুলতে হবে প্রকৃত মানুষ হিসেবে।

সফিউল আযম: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক