ঈদের ছুটি নয়, পেটের তাগিদে বাড়ি ফেরা

  • শাহজাহান মোল্লা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

সারা বিশ্ব করোনার তাণ্ডবে বিপর্যস্ত। বিশ্বের ছোট-বড়, উন্নত-অনুন্নত সব দেশই এ ভাইরাসে পর্যুদস্ত। এ মুহূর্তে কয়েকশ' কোটি মানুষ ঘরবন্দী বা সঙ্গরোধে রয়েছেন।

দিন যত যাচ্ছে সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। যদিও গত দুই দিন বাংলাদেশে নতুন করে কোনো করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি। তাই বলে আমাদের নাকে তেল দিয়ে ঘুমানো চলবে না। থাকতে হবে সতর্ক, অন্যদেরও সতর্ক করতে হবে। সঙ্গরোধ বা ঘরে অবস্থানই এইভাইরাস থেকে মুক্তির উপায়।

বিজ্ঞাপন

করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার ২৯ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে। মূলত মধ্য মার্চ থেকেই অনেক অফিস তাদের কর্মীদের ঘরে বসে অফিস করার অনুমতি ও উৎসাহ দিয়েছে। ধীরে ধীরে শুধু ব্যাংক ও জরুরি সেবা ছাড়া মোটামুটি সবাই ঘরে বসে অফিস করার আদেশ জারি করেছে। শুধু জরুরি সেবাগুলোই এর বাইরে ছিল। এমনকি ব্যাংক ও কিছু জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠানও কর্মীদের জন্য বিকল্প রোস্টার করে তাদের অফিস গমন সীমিত করেছে। তার ওপর ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার।

পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল এ নগরের রাস্তাঘাট ধীরে ধীরে জনশূন্য হয়ে পড়েছে। সরকারি-বেসরকারি অফিসের কার্যক্রম সীমিত করার ফলে রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচলও সীমিত হয়ে পড়েছে। এদিকে ঢাকা শহরের বিপুল সংখ্যক মানুষ কোনো না কোনোভাবে দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। এসব মানুষের বিরাট অংশই কোনো সুনির্দিষ্ট কাজ করে না। আজ এ কাজ তো, কাল ও কাজ। তাদের কেউ কেউ সুনির্দিষ্ট কাজ করলেও সেটা দিন হিসেবে করে, মাস হিসেবে নয়। মাস গেলে কাজ কম হোক বেশি হোক বেতন হবে এমন ভাগ্য অনেকেরই নেই।

ফলে সবকিছু ছুটি হওয়ায় ধীরে ধীরে এই শ্রেণির মানুষ কর্মহীন হয়ে যায়। এদিকে লকডাউন হবে হবে এমন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পুরো রাজধানী হয়ে যায় জন ও যানশূন্য। যানজটের রাজধানী, রিকশার নগরী এখন যেন এক ভুতুরে শহর। সারাদিনে সড়কে নেই কোনো বাহন। যাও দুই-একজনকে মোটরসাইকেল বা রিকশা চালাতে দেখা যাচ্ছে, তাদের ভেতরেও এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে।

মানুষের কোয়ারেন্টাইন বা সঙ্গরোধ নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোরভাবে কাজ করছে মাঠে। যদিও পুলিশের কিছু ভূমিকায় চারদিকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। তবুও কোটি মানুষকে বাঁচাতে কতিপয় মানুষের শাস্তিতে অনেকেই মৃদু স্বস্তিতে।

প্রযুক্তির যুগে সব কিছু যেন বাতাসের গতিতে পুরো দুনিয়া ছড়িয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়াতেই শুরু হয় প্রতিবাদ। তার কোনোটির প্রতিকার হয়, আবার কোনোটি অগোচরেই রয়ে যায়। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি শুরু হওয়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি বিষয় নিয়ে খুব সরব ছিলেন কিছু দেশপ্রেমিক মানুষেরা।

ছুটি শুরু হওয়ার পর লঞ্চ, বাস, ট্রেনে মানুষর উপচে পড়া ভিড় দেখে অনেকেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। মানুষের বাড়ি ফেরা দেখে অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একে ঈদে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা সঙ্গে তুলনা করে ব্যঙ্গ করেছেন। অনেকে প্রশ্ন করেছেন, এই যে লাখো মানুষের গ্রামে ছুটে চলা, এতে করোনা ছড়িয়ে পড়বে না তো? গ্রামের সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষগুলো বাঁচবে তো? এ রকম হাজারো প্রশ্ন জনমনে। অন্য অনেকের মতো আমারও শেকড় গ্রামে। প্রশ্নগুলো আমার মনেও আসেনি তা নয়।

অনেকেই ঘরে ফেরা মানুষদের গালমন্দ করছেন। কেউ কেউ বলেছেন, আরে পাগলা এটা ঈদের ছুটি না! ঘরে থাকার জন্য ছুটি দিয়েছে। এখানে একটু দ্বিমত পোষণ করতে চাই। যারা গেছে, তাদের অধিকাংশই ছুটি উপভোগ করার জন্য যায়নি। এই ঢাকা শহরে প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ কাজের জন্য এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে চলে। কাজ নেই তো এ মানুষগুলোর রুটি-রুজিও নেই।

এই শহরে এমন অনেক লোক রয়েছে, যাদের ঘর থেকে বের না হলে পেটে খাবার জোটে না। উপোস থাকতে হয়। রাস্তায় যে ভিক্ষুক ভিক্ষা করে, তারও চাওয়া রাস্তায় মানুষ বের হোক। যে ফেরিওলা, তারও চাওয়া রাস্তায় মানুষ বের হোক। আর যে ছোট্ট ছেলেটি হোটেল বা রেস্তোরাঁয় কাজ করছিল, সেও চায় হোটেলে কাস্টমার আসুক। বেতন হবে, দুপুরে হোটেলে খেতে পারব। আর কাস্টমার বকশিশ দিলে তা মায়ের হাতে তুলে দেব। রাস্তায় লোক না থাকলে এ শহরের লাখ লাখ রিকশাচালক কীভাবে ঢাকায় টিকে থাকবে? সবাইকে ঘর ভাড়া দিতে হবে, দিন শেষে তাকে খাবারের টাকা দিতে হবে। রিকশা না চললে সে কী খাবে, কোথায় থাকবে? এই রিকশাচালক বা দিনমজুররা আসলে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যায়নি। পকেটে যা আছে, তা নিয়েই বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন গুজরানোর জন্য বাড়িতে গেছে। আমরা নিজেরা নিজেদের বিবি-বাচ্চাদের সঙ্গে খিচুড়ি গরুর মাংস খেয়ে সেলফি তুললে দোষ নেই, আর ওরা ওদের প্রিয়জনের সঙ্গে সংকটের সময় একসঙ্গে থাকতে গেলে দোষ!

আবার অনেক মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান আছে, যারা মেস ভাড়া করে ঢাকায় থাকে। টিউশনি করে নিজের পড়া লেখার পাশাপাশি বাড়িতে মা-বাবার জন্য কিছু সঞ্চয় করে। মেসে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এই শ্রেণি চিন্তা করে, একটা মিল অর্থাৎ এক বেলা কম খাওয়া হলে তার বেশ কয়েকটা টাকা বেঁচে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ; ছাত্ররা কোথায় উঠবে? অনেকের মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম আছে, ওদের তো এই ঢাকা শহরে সেকেন্ড হোমও নেই। সরকারি মেহমান খানা বন্ধ তো ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও। ওরা তাই করেছে।

এই যে এতোগুলো হিসেব দাঁড় করালাম। আমরা যারা ওই লঞ্চের যাত্রী, ট্রেনের যাত্রী বা বাসের যাত্রীদের গালি দিচ্ছিলাম, তারা কি একবারও ভেবে দেখেছি, ওদের এই শহরে থাকতে হলেও মরতে হবে। করোনা পরিস্থিতি এই লকডাউন কত দিন চলবে তা কে বলবে? সরকারি বেসরকারি কোনো সংস্থা কি বলতে পারছে ৪ এপ্রিলের মধ্যেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে? আবার শহর প্রাণ ফিরে পাবে?

বিশ্বের অন্যান্য দেশ লকডাউনের দিনক্ষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। যেহেতু ভাইরাসটি বৈশ্বিক সমস্যা, তাই বাংলাদেশও সেই পথেই হাঁটবে- এটাই স্বাভাবিক। তাহলে ওই মানুষগুলো যদি ঢাকায় থাকত, তাহলে তাদের মাসের পর মাস খরচ কে চালাত? আমাদের মতো ওরা তো আর মাসের চাল-ডাল-মাছ একসঙ্গে ঘরে মজুদ করতে পারেনা। সে সমর্থ ও পয়সাও নেই তাদের। তাই ওরা আসলে ঈদের ছুটিতে নয়, পেটের টানেই ঝুঁকি নিয়ে বাড়িতে গেছে।

প্রশ্ন আসতে পারে, তাই বলে কোটি মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলবে? এখানে হয়তো কিছু করার ছিল। যেমন নিরাপদ দূরত্ব মেনে গাড়িতে ওঠার ব্যবস্থ, পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যেত। দরকার ছিলো সঠিক মনিটরিং। তাই গোড়ায় গলদ রেখে শুধু শুধু আমার ভাই, আপনার ভাই, স্বজনদের দোষছি কেন?

অনেকে বলছেন, ঢাকা থেকে ওরা করোনাভাইরাস নিয়ে পুরো দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে। যদি তাই হয়, তবে ঢাকায় অনেক আগেই লকডাউন করা উচিত ছিল যাতে কোনোভাবেই ভাইরাস ঢাকা থেকে গ্রামে বা অন্য জেলায় ছড়িয় পড়তে না পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, করোনাভাইরাস চীনে ছড়িয়েছে আরও প্রায় তিন মাস আগে। ইতালির অবস্থা ভয়াবহ হয়েছে তাও বহুদিন হয়। চীন ও ইতালির সঙ্গে আমাদের যাতায়াত প্রতিদিনের। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ এই দুই দেশ থেকে ঢাকায় আসেন। দেশের অনেকে ইতালিতে কাজ করেন। চীনেও রয়েছে আমাদের অনেক নাগরিক। এছাড়া চাকরি ও ব্যবসাসূত্রে অনেক চীনা নাগরিক ঢাকায় আসেন নিয়মিত। আমরা গত তিন মাসে আমাদের বিমান বন্দের করোনার ব্যাপারে কোনো সতর্কতা অবলম্বন করিনি। ইতালি থেকে অনেক বাংলাদেশি গত তিন মাস আগে থেকেই ঢাকায় এসেছেন। তারা নিজ নিজ গ্রামে গিয়েছেন। গামে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছেন। অনেক চীনা নাগরিকও ঢাকায় এসেছেন এর মধ্যে। যদি ভাইরাস ঢাকার বাইরে যেয়েই থাকেই তবে এতদিন কেন এসব বিষয়ের দিকে নজর দেয়া হয়নি?

জানি, এর পেছনে হাজারটা যুক্তি থাকবে। থাকবে পাল্টা যুক্তিও। কিন্তু এ শহর তাদেরও যারা বাড়ি গিয়েছে। যেমন আমার। আমরা থেকে যেতে পেরেছি ওরা পারেনি। ওদের থাকার নিশ্চয়তাও আমরা দিতে পারিনি। কেউ তো বলেনি, তোরা যাসনে ভাই, যা আছে আয় খেয়ে পড়ে একসঙ্গে থাকি। তাই ওদের চিন্তা ওদেরই। ওরা তাই আমাদের মতো সচেতন নাগরিকদের গালমন্দ শুনেও বাড়ি গেছে।

শাহজাহান মোল্লা: সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম