করোনাক্রান্তির যুগে অনলাইন সাংবাদিকতা

  • রাজীব নন্দী
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

অনলাইন বিশ্বের রবিনহুড খ্যাত ‘জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ’ তার ইউকিলিক্সকাণ্ডে দেখিয়ে দিয়েছেন অনলাইন সাংবাদিকতা চাইলে কী করতে পারে! অনলাইন সাংবাদিকতার চোরাগোপ্তা কাণ্ড ঘটিয়ে বিশ্বে তুলকালাম ঘটিয়েছিলেন ‘এডওয়ার্ড স্নোডেন’। যিনি গুপ্তচরবৃত্তির পরিসর ভেঙ্গে অনলাইন দুনিয়ায় নতুন চেহারা দিয়েছেন সাংবাদিকতাকে। গত দশ বছর ধরে অনলাইন সাংবাদিকতা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা-তৎপরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনলাইন সাংবাদিকতা আজ মোবাইল জার্নালিজম (মোজো), ডাটা জার্নালিজম, সাংবাদিকতায় মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহারসহ নানা মাত্রায় নতুন নতুন রূপ হয়ে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে। সাংবাদিকতার সামনে এ এক মহা চ্যালেঞ্জ। চলমান ‘করোনাক্রান্তি’তে কোভিড-১৯ ভাইরাসের পাশাপাশি ‘কাগুজে সাংবাদিকতা’র আত্মদানও দেখছি আমরা।

হ্যাঁ, করোনার প্রভাব পড়েছে সংবাদপত্র প্রকাশনাতেও। কলকাতা থেকে পরিবেশিত সাংবাদিক অমিতাভ ভট্টশালীর এক সংবাদে বিবিসি থেকে জানলাম, 'যে হকাররা বাড়ি বাড়ি কাগজ দেন, তিনিও এই লকডাউনের মধ্যে বাড়ির বাইরে বেরুতে সাহস পাচ্ছেন না। রাস্তায় লোক নেই, তাই পথ-চলতি মানুষ যে সংখ্যক কাগজ কিনতেন, সেটা অর্ধেকেরও কম হয়ে গেছে। আমরা তাই কাগজ নিয়ে এসে জমিয়ে রেখে কী করব’।

অমিতাভ ভট্টশালী লিখছেন, সংবাদপত্রের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস একেবারে ঘরে ঢুকে পড়তে পারে, এরকম একটা ভয় তৈরি হয়েছে ভারতের নানা প্রান্তে। ফলে সংবাদপত্রের বিক্রি হুহু করে কমছে। সে কারণে, মুম্বাইয়ের বেশ কিছু সংবাদপত্র যেমন তাদের মুদ্রিত সংস্করণ বন্ধ করে দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার বেশ কিছু কাগজও বের হচ্ছে না।
 
হোয়াটসঅ্যাপে আমি একটি গ্রুপ নেটওয়ার্ক চালাই। নাম ইন্দো বাংলা মিডিয়া এডুকেটর্স নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশ ও ভারতের শ' খানেক গণমাধ্যম শিক্ষক, গবেষকের মিলিত প্ল্যাটফর্ম এটি। গত কয়েকদিন ধরে ওই গ্রুপে কলকাতার প্রফেসর উমা শঙ্কর পাণ্ডেকে দেখছি নিয়মিত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সংবাদপত্রের পিডিএফ কপি আপলোড করতে। শিলিগুড়ির সাংবাদিক তমালিকা কর্মকার ওই গ্রুপে দিচ্ছে উত্তরবঙ্গ সংবাদের কপি। আনন্দবাজার পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক অনমিত্র চট্টোপাধ্যায় গত চারদিন ধরে হোয়াটসএপে নিয়মিত শেয়ার করছেন আবপ’র পিডিএফ কপি।

জানা গেছে, কলকাতার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পঠিত কাগজ বলে পরিচিত 'বর্তমানের' কোনও মুদ্রিত সংস্করণ বের হয়নি গত কয়েকদিন। বিবিসির সংবাদে জানতে পারলাম, বন্ধ হয়েছে আজকাল, এবং সিপিআইএম দলের দৈনিক মুখপাত্র গণশক্তিও। লকডাউন সমাজে সংবাদপত্রের পাঠকের তথ্যক্ষুধা থাকলেও সংবাদপত্র বিলি করার হকার্স ও ব্যবস্থাপনা অচল হওয়ার কথা। এছাড়াও সংবাদপত্রের জন্য খবর সংগ্রহকারী সাংবাদিকরাও দ্বাররুদ্ধ নিজগৃহে পরবাসী সাংবাদিকতায় মজেছেন। ফলে সংবাদপত্র শিল্প এক কথায় বাজারের অন্য দশটি প্রতিষ্ঠানের মতো মুখ থুবড়ে আছে।
 
বাংলাদেশেও নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অফিস-আদালত বন্ধ, আবার রোগটি ছোঁয়াচে হওয়ায় হকারের মাধ্যমে আসা ছাপানো সংবাদপত্রও এড়িয়ে চলছেন অনেকে। ফলে ঢাকায় সংবাদপত্রের বিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে হকারদের কাছ থেকে তথ্য মিলেছে সম্প্রতি বিডিনিউজে পরিবেশিত এক তথ্যে।

গত ১৫ দিন ধরে সংবাদপত্রের চাহিদা একটু একটু করে কমছে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমণের প্রথম ঘটনা ধরা পড়ে গত ৮ মার্চ।  তার আগের তুলনায় গত সপ্তাহেই সংবাদপত্রের বিক্রি ৬০ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছে হকার্স ইউনিয়ন। ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার পাঁচ‌টি পত্রিকার প্রিন্ট ভার্সন প্রকাশ স্থগিত ঘোষণা দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় এবং পত্রিকা বিপণনজনিত সমস্যাসহ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২৬ মার্চ থেকে সিলেটের দৈনিক পত্রিকাসমুহ প্রকাশ আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তবে, করোনা সতর্কতা মেনে মুদ্রণ থেকে শুরু করে পাঠকের বাড়িতে সংবাদপত্র পৌঁছে দেওয়ার বিশেষ প্রচারণা চালাচ্ছে আনন্দবাজার পত্রিকা ও দ্য টেলিগ্রাফ। এবিপি আনন্দ টিভির এক ওয়েব নিউজে দেখা যায়, মুদ্রণ থেকে প্যাকেজিংয়ের পর সংবাদপত্র গাড়িতে তোলা, স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা এবং ভেন্ডরদেরও দেওয়া হয়েছে দস্তানা। যাতে গোটা প্রক্রিয়ায় কোথাও সুরক্ষায় ফাঁক না থাকে! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ২৩শে মার্চ থেকে বাংলাদেশ-ভারতের সব কিছু বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এ অবস্থায় পত্রিকার পাঠক ও হকাররা বাড়ি চলে যাচ্ছেন। এতে পত্রিকা বিক্রি কমে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনদাতারা এসময় বিজ্ঞাপনও বন্ধ করে দিচ্ছেন। তাই পত্রিকা চালানো সহজ কাজ নয়। এ কারণে অনেক ছাপানোর সংখ্যা কমেছে। পত্রিকার নির্ধারিত পাতা কমিয়ে দিয়েছে কেউ কেউ। এই অবস্থা চললে, পত্রিকা ভার্সন বন্ধ করে শুধু অনলাইন ভার্সন চালানোর সিদ্ধান্ত নিতে যাবে অনেকেই। করোনাক্রান্তিতে সংবাদকর্মীরা কেবল সাময়িক বেকার হয়ে পড়েছে। কিন্তু খেয়াল করলে দেখা যায়, এটি শুধু করোনার সাথে যুদ্ধ নয়। এটি ডিজিটাল ও প্রিন্ট মিডিয়ার চলমান যুদ্ধে ডিজিটাল সাংবাদিকতার পক্ষে অব্যর্থ এক অস্ত্র।

মহাভারতের কুরুযুদ্ধে, ঘটোৎকচ নামে এক বীর ছিলো, যিনি ছিলেন রাক্ষস (ভীম ও হিড়িম্বার পুত্র)। পান্ডবের সাথে কৌরবদের যুদ্ধ বাঁধলে তিনি বংশ স্বার্থে পান্ডবদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধের চতুর্দশ দিনে কুরু-পান্ডবদের যুদ্ধ যখন ভয়ংকর হয়ে ওঠে, তখন বাধ্য হয়ে কৃষ্ণের পরামর্শে ঘটোৎকচকে নিয়ে আসে ভীম। সেদিন রাতের বেলাও যুদ্ধ চলতে থাকে। কৌরব বাহিনীর কর্ণ (আজ যেভাবে করোনা আমাদের ঘরে সেঁধিয়ে দিচ্ছে) সেদিন ভীষণ তেজে যুদ্ধ করতে থাকে। যেহেতু রাক্ষসরা নিশাচর সেহেতু কৃষ্ণ ঘটোৎকচকে ডেকে বললেন যে, এই যুদ্ধে তোমার প্রয়োজন। ব্যস, কৃষ্ণের ছলাকলার বুদ্ধিতে ঘটোৎকচের আত্মদানে সেদিন যুদ্ধে জিততে পারেনি কৌরবরা। ‘করোনাভাইরাস’ যেন আজ প্রতিবিপ্লবী কর্ণ। অবরুদ্ধ অন্ধকার কুরুযুদ্ধের মতো ‘অনলাইন সাংবাদিকতা’ যেন বীর ঘটোৎকচ। যে বীর ঘনঘোর রাতে যুদ্ধে নেমেছে। কর্ণ পরাজিত হয়, ঘটোৎকচের আত্মদানে জিতে যায় পাণ্ডব। আজকেও পৃথিবী লকডাউন, কিন্তু অনলাইন সাংবাদিকতার কিবোর্ড সমাজে ব্রহ্মাস্ত্র ছুড়ে মারছে একে একে। দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীর নানাপ্রান্তে ‘কাগজহীন সাংবাদিকতা’র প্রচারণা চলছে। এই করোনাক্রান্তি আমাদেরকে সেটিই মনে করিয়ে দিলো।

করোনার প্রভাবে ছাপা পত্রিকার কী দশা হয়, আসুন ব্যতিক্রমী একটি ঘটনা জানি। পত্রিকা কোম্পানি তার পাঠককে পত্রিকার সাথে টয়লেট পেপারও দিচ্ছে এমনটা শুনলে কি অবাক হবেন? হ্যাঁ অবশ্যই অবাক হবেন, আমিও হয়েছি। চমৎকার সব প্রথম পৃষ্ঠাগুলোর জন্য পরিচিত অস্ট্রেলিয়ার সংবাদপত্র এনটি নিউজ বৃহস্পতিবার ‘টয়লেট পেপারের ঘাটতি’ থেকে বাঁচতে আট পৃষ্ঠার একটি বিশেষ সংস্করণ ছাপিয়েছিল যা টয়লেট পেপার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। বর্তমান বিশ্বে করোনা ভাইরাস থেকে ভীত ব্যক্তিদের চাহিদা মেটাতে অস্ট্রেলিয়ার টয়লেট পেপার নির্মাতারা তাদের উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে। আর যেসব নির্মাতা খুব শিগগিরই এই বাজারে ধরা পড়েছে, তাদের সাহায্য করার জন্য একটি পত্রিকা তার সংস্করণগুলোতে অতিরিক্ত পৃষ্ঠা মুদ্রণ করে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে। রাতারাতি হ্যাশট্যাগ দিয়ে টুইট করে, শত শত মিমস সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

বিজ্ঞাপন

পত্রিকাটির সম্পাদক, ম্যাট উইলিয়ামস, গার্ডিয়ান অস্ট্রেলিয়াকে বলেছিলেন যে কাগজটি ভালো বিক্রি হচ্ছে এবং ‘এটি অবশ্যই কৃপণ সংস্করণ নয়। আমরা বিশ্বজুড়ে পরিচিত একটি সংবাদপত্র যারা পাঠকদের চাহিদা বুঝি।’ তিনি বলেছেন, ‘এখনই টয়লেট পেপারের খুব প্রয়োজন রয়েছে, তাই তাদের যা প্রয়োজন, তা আমাদের সরবরাহ করতে হয়েছিল।’ কোলস এবং উলওয়ার্থস সহ সুপারমার্কেটগুলোতে লু পেপার এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজারের তাকগুলো ক্রেতারা সাফ করে দেয়ার পর পর এই উদ্যোগ এসেছে। এমনকি দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার মিলিসেন্টেও অস্ট্রেলিয়ার টয়লেট পেপারের বেশিরভাগ সরবরাহকারী শহর, স্থানীয় দোকানগুলোকে অতিরিক্ত স্টকের অর্ডার দিতে হয়েছিল বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা এবিসি!

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ তার ইউকিলিক্স-কাণ্ডে দেখিয়ে দিয়েছেন অনলাইন সাংবাদিকতা চাইলে কী করতে পারে! এডওয়ার্ড স্নোডেন তার গুপ্তচরবৃত্তির পরিসর ভেঙ্গে অনলাইন দুনিয়ার নতুন চেহারা হাজির করেছে। অনলাইন সাংবাদিকতা তাই আজ মোবাইল জার্নালিজম (মোজো), ডাটা জার্নালিজম, সাংবাদিকতায় প্রোগ্রামিংয়ের ব্যবহারসহ নানা মাত্রায় নতুন নতুন রূপ হয়ে আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে। সাংবাদিকতার এটা এক মহা চ্যালেঞ্জ। করোনাক্রান্তিতে করোনাভাইরাসের পাশাপাশি অনলাইন সাংবাদিকতার দাপটও সমানভাবে দেখছি আমরা। সাংবাদিকতার এই আধুনিকতার সঙ্গে যুক্ত হতে না পারলে বা নিজেকে প্রশিক্ষিত না করলে গ্লোবাল চ্যালেঞ্জে টিকে থাকা অসম্ভব। কারণ, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন উড়ে গিয়েছে, বিদায় নিয়েছে রেডিও, পত্রিকাও যাই যাই করছে। সব মিডিয়া ঘরে আসবে— সব টিভি— ফুরাবে সব লেনদেন; থাকবে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার মাল্টিমিডিয়া মোবাইল ফোন।

রাজীব নন্দী: সহকারী অধ্যাপক, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কনসাল্টিং এডিটর, বার্তা২৪.কম