করোনাভাইরাসের আন্তর্জাতিক রাজনীতি

  • ড. মো. কামাল উদ্দিন
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দুটি ডাইমেনশনে নিরাপত্তা প্রত্যয়টিকে বিশ্লেষণ করে- গতানুগতিক ও অগতানুগতিক নিরাপত্তা। গতানুগতিক নিরাপত্তা সামরিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যুদ্ধ ও আক্রমণের মতো বাহ্যিক হুমকি থেকে সামরিক শক্তির মাধ্যমে এর সুরক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত। এর মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে রাষ্ট্র। আর অগতানুগতিক নিরাপত্তা বলতে মানবিক নিরাপত্তাকে বোঝায় যার সঙ্গে সংযুক্ত মানবিক সুরক্ষা।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে অগতানুগতিক নিরাপত্তার অনুষঙ্গ হিসেবে করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কীভাবে কাজ করছে বা করোনাভাইরাসের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর এ নিবন্ধে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।

বিজ্ঞাপন

বর্তমান প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এক মারাত্মক সংকটকাল অতিক্রম করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কীভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবে এ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। যার মূলে রয়েছে মানবিক নিরাপত্তার বিষয়টি।

আজ মানবিক নিরাপত্তা অত্যন্ত হুমকির মুখে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রায় শূন্য! রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের, সংগঠনের সঙ্গে সংগঠনের এবং ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির বাহ্যিক কোনো সম্পর্ক নেই বললেই চলে। যার মূলে রয়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। পৃথিবীর সকল স্বাধীন দেশে করোনাভাইরাসের সরব উপস্থিতি। কি উন্নত কি অনুন্নত কোনো দেশই করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত নয়। করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা বিশ্বযুদ্ধগুলো থেকেও বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। পৃথিবী যেখানে ছিল পারস্পারিক সম্পর্কের নাম, সেই জায়গা থেকে আজকে পৃথিবীর ভেতরে নতুন এক আইসোলেশন তৈরি হয়েছে। আর এই বিচ্ছিন্নতা রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের, সমাজের সঙ্গে সমাজের, ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে গ্লোবাল অর্ডার অনেকবার পরিবর্তন হয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ও সর্বশেষ নাইন ইলেভেনের পরও বৈশ্বিক ব্যবস্থার পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। করোনাভাইরাসের ফলেও কি গ্লোবাল অর্ডারের কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে? করোনাভাইরাসের ফলে নতুন শক্তির আবির্ভাব হবে বলে অনেকে মনে করছেন। বর্তমান ক্ষমতাসীন ও শক্তিশালী দেশগুলো করোনাভাইরাসের ফলে প্রায়ই কাবু! এ ক্ষেত্রে এশিয়ার ছোট ছোট কিছু দেশ করোনাভাইরাস মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে সফলতা দেখিয়েছে। কী পরিমাণ সামরিক শক্তি আছে, ব্যাংকে কী পরিমাণ রিজার্ভ আছে বা কী পরিমাণ পারমাণবিক ক্ষমতা আছে অথবা বৈশ্বিক অন্যান্য দেশের ওপর কত বেশি নিয়ন্ত্রণ আছে এগুলোর ওপর বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা কার্যকর হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মূলেই রয়েছে কোন দেশ এ ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে রেখে নিজেদের রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনা করতে পারছে।

এ করোনাভাইরাসকে নিয়ে পৃথিবীর ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নতুন ধরনের দ্বান্দ্বিক অবস্থা তৈরি হতে যাচ্ছে। কেউ এটিকে একটি সচরাচর ভাইরাস হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ করোনাভাইরাসকে জীবাণু অস্ত্র হিসেবেও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছেন। যদি এটি একটি সচরাচর ভাইরাস হয় তাহলে বাঁচা গেল। এর প্রতিকার আসবে। মেডিকেল সাইন্স এর প্রতিকার বের করবেই। সে পর্যন্ত আমাদেরকে সচেতন থেকে পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে। নির্ভরশীল হতে হবে মহান স্রষ্টার উপর।

যদি এ করোনাভাইরাস সত্যিই জীবাণু অস্ত্র হয় তাহলে প্রশ্ন জাগে এই জীবাণু অস্ত্র কে তৈরি করেছে? কার শখ জেগেছে পৃথিবীকে ধ্বংস করতে! কেউ কেউ মনে করছেন, এই অস্ত্র চীন তৈরি করে নিজেদের ওপর প্রথম ব্যবহার করে পরবর্তীতে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে বিশ্বব্যবস্থাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। অনেকে এ দাবিও করছেন যে চীনের কাছে এর প্রতিষেধকও রয়েছে। চীন বৈশ্বিক অর্থনীতি ও রাজনীতি এই অস্ত্র ব্যবহার করে পরিপূর্ণভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে। এও দাবি করা হচ্ছে যে করোনাভাইরাসের ফলে চীনের অর্থনীতিতে যে ধরনের সংকট তৈরি হয়েছিল ইতোমধ্যে চীন সেই সংকট মোকাবেলা করেছে বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। বৈশ্বিক শেয়ারবাজারের বৃহৎ অংশ চীন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাচ্ছে বলে অনেকেই দাবী করছেন। অনেকে মনে করছেন পৃথিবীতে আইসোলেশন তৈরি করে বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ধ্বংস করে চীন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং এই জীবাণু ব্যবহার করে পুরা পৃথিবীর নেতৃত্ব নিয়ে বিশ্ব ব্যবস্থার মোড় ঘুরিয়ে দিবে, চীন কেন্দ্রিক এক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা তৈরি হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে চীন এই কাজ করতে গেলে তাদের কি ক্ষতি হবে না? পৃথিবীকে ধ্বংস করে তারা কীভাবে টিকে থাকবে?

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বাস্তববাদীরা ভাইরাল সংক্রমণ, মহামারী, জনস্বাস্থ্যের সর্বোত্তম অনুশীলনগুলো সম্পর্কে খুব কমই চিন্তা করে। তারা গতানুগতিক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে। কিন্তু এটিও সত্য এবং স্পষ্ট- কোনো ভাইরাসের কারণে সৃষ্ট জটিলতা নিরসন করার জন্য রাষ্ট্রই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। উদারবাদীরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা দিন দিন কমে যাচ্ছে বলে দাবি করেন। এবং একসময় রাষ্ট্রের ভূমিকা এত কমে যাবে যে আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি, বেসরকারি সংস্থা, বহুজাতিক করপোরেশন এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনের যেসকল বিধি-বিধান সেগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পরিচালিত হবে। কিন্তু করোনাভাইরাস নির্মূলের ক্ষেত্রে বা বর্তমান সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে সে দাবি অনেকটা অকার্যকর।

আন্তর্জাতিক সংগঠন ও অন্যান্য নিয়ম-নীতিগুলো COVID-19 নির্মূলের ক্ষেত্রে তেমন ভূমিকা পালন করতে পারছে না। যতটুকু ভূমিকা পালন করছে রাষ্ট্র। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায় সবই করছে মৌলিকভাবে রাষ্ট্র।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের তাত্ত্বিকরা চিন্তা করতে শুরু করেছেন যে এই মহামারী রাষ্ট্রকে আরো বেশি শক্তিশালী করবে। জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করবে। সব ধরনের সরকারগুলো সংকট পরিচালনার জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অনেকেই ধারণা করছেন প্রাচ্যের ক্ষমতার পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করবে। অনেকে চিন্তা করে যাচ্ছেন যে দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর সেরা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এটাকে পশ্চিম থেকে প্রাচ্যের দিকে ক্ষমতা পরিবর্তনের ইঙ্গিত মনে করছেন অনেক।

আবার অনেকে দাবি করছেন যে এই ধরনের মহামারী পূর্বে ক্ষমতা পরিবর্তন বা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা পরিবর্তনের তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। তবে অন্য কোনো মহামারী থেকে COVID-19 একেবারে আলাদা। COVID-19 এমন একটি বিশ্ব তৈরি করেছে যা সবচেয়ে কম উন্মুক্ত, কম সমৃদ্ধ ! এমন একটি ভাইরাস যা অপর্যাপ্ত পরিকল্পনা এবং অযোগ্য নেতৃত্বের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে মানবতাকে সুনিশ্চিতভাবে চরম বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলেছে।

বিশ্ব মানবতা আজ এই মহামারীর সম্মুখীন। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতির নেতারা তাদের আন্তর্জাতিক এজেন্ডায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে পারেননি। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক নেতারা অন্য রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আচরণের পরিবর্তন করেননি এবং মানবিক আচরণ করছেন তা বলা যায় না। উদাহরণস্বরূপ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ফলে সিরিয়ার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। লিবিয়ার যুদ্ধবিরতি চুক্তি সংকটের মধ্যে আছে, ওয়াশিংটন তেহরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেনি, ওপেক+ আলোচনার সময় রাশিয়া এবং সৌদি আরবের মধ্যে পারস্পরিক ছাড়ের জন্য এ মহামারী কোনো প্রভাব ফেলেনি। এখন পর্যন্তও কোনো রাষ্ট্র তাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সুবিধা এবং স্বার্থের ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র নমনীয় হয়নি।

বিশ্বরাজনীতির স্বার্থবাদী নেতারা তাদের আচরণ পরিবর্তন না করলেও তদুপরি করোনাভাইরাস নিজেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় কারো অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে এবং কারো অবস্থানকে দুর্বল করার একটি সুযোগ তৈরি করতে শুরু করেছে। অনেকেই বলতে শুরু করেছে পশ্চিমা যুগের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে করোনা ভাইরাসের ফলে। আবার আমেরিকার অনেক তাত্ত্বিকগণ চীন যুগের সমাপ্তির কথা বলেছিলেন যখন করোনাভাইরাস শুরু হয়েছিল চিনে। কিন্তু এখন অনেকেই আবার দাবি করছেন আমেরিকার যুগের সমাপ্তি হতে যাচ্ছে এ ভাইরাসের কারণে।

এক পক্ষ শুধুমাত্র এটিকে নিতান্তই একটি ভাইরাস হিসেবে উপস্থাপন করলেও অন্যপক্ষ এটি একটি বায়োলজিক্যাল উইপন হিসেবে চীন নিজেই তৈরি করছে বলে দাবি করছে। অনেকে আবার চীনের বিরুদ্ধে এজন্য আন্তর্জাতিক আদালতে মানবাধিকার লঙ্ঘন মামলার হুমকি দিচ্ছেন। আমেরিকার অনেকেই এবং অনেক মার্কিন কর্মকর্তা চীনকে দায়ী করে এটি চীনা ভাইরাস হিসেবে উল্লেখ করেন। চীন আবার এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করে। অনেক কর্মকর্তা অনুমান করছেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা যিনি গত অক্টোবরে অনুষ্ঠিত মিলিটারি অনুষ্ঠানে চীনে অংশ নিয়েছিলেন এবং আমেরিকা গোপনে এই ধরনের ভাইরাস পাঠিয়ে চীনকে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। এভাবেই চলছে দোষারোপের রাজনীতি।

আমাদেরকে চেষ্টা করতে হবে এ মহাসংকট থেকে মুক্তির। যদি তা করা না যায় বন্ধ হয়ে যাবে সব আন্তর্জাতিক যোগাযোগ। আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা আর কাজ করবে না। বিশ্বমোড়লরা তাদের ক্ষমতা দেখাতে পারবে না। করোনাভাইরাসের গতি যদি রোধ করা না যায়, এটি যদি বন্ধ না হয় তাহলে পৃথিবী থাকবে না। আর পৃথিবী ধ্বংস করে তাদের লাভ কী? পৃথিবী ধ্বংস করে চীনের কী লাভ বা আমেরিকা পৃথিবীকে ধ্বংস করে আমেরিকার কী লাভ? বস্তুত বিশ্বের ক্ষমতাধররা তাদের নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্যই পৃথিবীকে পরিপূর্ণভাবে ধ্বংস করবে না। পৃথিবী যদি ধ্বংস হয়ে যায় বা ধ্বংস করা হয় তাহলে কেউ পরাশক্তি হয়ে বা কোনো দেশ শক্তিশালী হয়ে লাভ কী? পৃথিবী ধ্বংস কোনো মানুষের হাতে হবে না। একদিন যেদিন পৃথিবীকে যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনিই ধ্বংস করেন।

তাই এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য সবাইকে পথ খুঁজতে হবে। হয়তো একদিন এই সমস্যার সমাধান হবে, কিন্তু সে সমাধান কতদূর! ততদিন আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।

ড. মো. কামাল উদ্দিন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়