ইউজিসি শক্ত ভূমিকা নিতে পারে না কেন?

  • ড. সুলতান মাহমুদ রানা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তাদের ৪৫তম বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানসম্মত উচ্চশিক্ষার জন্য অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিক্ষকের ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এমনকি তাদের প্রয়োজনীয় সংখ্যক অধ্যাপক নেই। যারা আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই খণ্ডকালীন। মূলত প্রভাষক দিয়েই চলছে বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এর ৩৫(৩) ধারা অনুযায়ী, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগ বা প্রোগ্রামে খণ্ডকালীন শিক্ষক সংখ্যা পূর্ণকালীন শিক্ষকের এক-তৃতীয়াংশের বেশি হতে পারবে না। কিন্তু বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয় সেগুলো মানছে না যথাযথভাবে। এমনকি অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীণ শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

এছাড়াও লক্ষ করা গেছে যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক কোনো ধরনের ছুটি কিংবা অনুমতি ছাড়াই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান কিংবা সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। নিচ্ছেন মোটা অংকের বেতন। ইউজিসি বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের প্রতিবেদনে এসব সমস্যার কথা উল্লেখ করলেও সেগুলোর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি আজও।

এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসা খুব স্বাভাবিক যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইন না মানলে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ কেন করা যাচ্ছে না? এমনকি সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের নির্দেশ দিলেও কখনোই সেগুলো বন্ধ হতে দেখা যায় নি। সম্প্রতি ইউজিসি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্তও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানবে কিনা সেটি নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে একের পর এক নির্দেশ প্রদান করে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হিমশিম খেয়ে যায় ইউজিসি। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্তটি চাপিয়ে দিতে পারবে কিনা সেটি নিয়ে কিছুটা অবাক হচ্ছি।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সান্ধ্যকোর্স চালু থাকার সমালোচনায় রাষ্ট্রপতি যখন নিজেই মুখ খুলেছেন তখন বিশ্ববিদ্যালয় ইউজিসি কর্তৃক ১১টি নির্দেশনা সম্বলিত একটি চিঠি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠায়। ইউজিসির দেয়া সান্ধ্যকোর্স বন্ধসহ বিভিন্ন নির্দেশনা পাওয়ার সাথে সাথেই বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যেই সান্ধ্যকোর্স বন্ধের পদক্ষেপ এবং সেগুলোর যৌক্তিকতা বিবেচনায় কমিটি করেছে। কিন্তু বাকি অন্যান্য ১০টি নির্দেশনার বিষয়ে কোনো উদ্যোগের প্রসঙ্গ এখনো শুনতে পাইনি।

বিভিন্ন সময়ে ইউজিসিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা দিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধের নির্দেশনা দিতে দেখেছি। কিন্তু কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ করেছে সেটি খতিয়ে দেখে ইউজিসি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে কিনা সেটি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মালিকেরা সরকারের ঘনিষ্ঠতা আর ইউজিসির ব্যর্থতার সুযোগে মানহীন সনদ দিচ্ছে।

শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকোর্সের আদলেই সপ্তাহে একদিন কিংবা দু’দিন ক্লাসের ভিত্তিতে দূরশিক্ষণ প্রোগ্রামের সার্টিফিকেট ব্যবসা চলছে। শিক্ষার্থীরা কিছু বুঝলো কি না, তার চেয়ে বড় কথা তারা ভালো ফলাফল নিয়ে যাবে কি না। এমনকি অভিযোগ রয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় খাতায় নাম লিখেই বাগিয়ে নিচ্ছে প্রথম শ্রেণি মানের আকর্ষণীয় ফলাফল।

গত ১৩ ডিসেম্বর একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা সূত্রে জানতে পারলাম যে, ফের বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস চালুর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পাঁচ বছর আগে করা বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার পরিচালনা বিধিমালা’ সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়েও যে রমরমা সার্টিফিকেট বাণিজ্য শুরু হবে না- সেটি নিশ্চিত করে বলা যায় না।

দেশে এখন ৫১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আর ইউজিসির বর্তমান চেয়ারম্যানের দেয়া তথ্যমতে ১৬৫টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। এই বিশাল সংখ্যার বেশির ভাগই উন্নত কোচিং সেন্টার ছাড়া আর কিছু নয়। এমনকি কোচিং সেন্টারের সাইনবোর্ড নামিয়ে রাতারাতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড ঝুলতে দেখা গেছে অনেক ক্ষেত্রে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৫ থেকে ২০টি বাদে বাকি সবই কোনো না কোনোভাবেই আইনের শর্ত ভঙ্গ করছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই ভর্তি হলে পড়ালেখা ছাড়াই ভালো ফলাফলের সনদ দেওয়ার গ্যারান্টি দেয়।

এ ছাড়া অবৈধভাবে কিছু বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমও নানা কৌশলে চলছে। ইউজিসি বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে চলা ৫৬টি বিদেশি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছিল। কিন্তু কোনোভাবেই ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করাতে পারছে না ইউজিসি। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ইস্যুটি সামনে আসলে কোনোভাবেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই তালিকার বাইরে নয়। এক্ষেত্রে শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই বাস্তবতা যে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের জন্য সরকার লাইসেন্স দিচ্ছে। উচ্চশিক্ষার প্রথম এবং মূল ধারাটি হচ্ছে গণ’ বা পাবলিক (অর্থাৎ যার অর্থায়ন হয় জনগণের পয়সায়) এবং দ্বিতীয় ধারাটি বেসরকারি বা প্রাইভেট, যার পেছনে বিনিয়োগ করেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা এবং কাগজে-কলমে সেই বিনিয়োগ হওয়ার কথা অলাভজনক। কিন্তু সমস্যা হলো, সিংহভাগ ক্ষেত্রেই আজ এই অলাভজনক বিষয়টি লাভজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ড. সুলতান মাহমুদ রানা: সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়