বন্যা

বেঁচে ছিল না কিশোর, বেঁচে ছিল হাঁস

  • তুহিন ওয়াদুদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

তুহিন ওয়াদুদ, ছবি: বার্তা২৪.কম

তুহিন ওয়াদুদ, ছবি: বার্তা২৪.কম

কিছুদিন আগে কুড়িগ্রাম জেলার সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের সন্ন্যাসী গ্রামে গিয়েছিলাম। সন্ন্যাসী গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ধরলা নদী। ধরলা নদীর একটি শাখা নদী অর্জুনের ডারা। অর্জুনের ডারা নদীটি স্থানভেদে সন্ন্যাসীর ডারা, হাজীর নদী, দয়ার কুড়া, শিয়ালডুবি, গর্ভের দোলা নামে পরিচিত। অর্জুনের ডারা নদীটির উৎসমুখ ২৫-৩০ বছর আগে সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। আমি সরেজমিন দেখার জন্য গিয়েছিলাম সেই স্থান। নদীর মুখ বন্ধ করলে যে নদী তার পুরনো পথ খুঁজে নিয়ে আবার প্রবাহিত হয় তারই দৃষ্টান্ত এই নদীটি। ২০১৭ সালে ভয়াবহ বন্যায় এই বাঁধ ভেঙে নদী পুরনো পথে প্রবাহিত হয়েছিল।

ওই স্থানেই ২০১৭ সালের ভয়াবহ বন্যার করুণ আর ভয়াবহ রূপের বর্ণনা দিচ্ছিলেন ৬৫ বছর বয়সী বাহাদুর আলী এবং তার স্ত্রী নাজমুন। নাম বাহাদুর আলী হলেও ২০১৭ সালে ভয়াবহ বন্যায় তার কোনো বাহাদুরি খাটেনি। বন্যার কাছে সর্বস্ব বিলিয়েছেন। যখন তার বাড়ি-ঘর ডুবে গেছে তখন একটি দরজা আর দু-তিনটি পুরনো টিন ছাড়া আর কিছুই রক্ষা করতে পারেননি। তিলে তিলে তারা সারাজীবন ধরে যা কিছু করেছিলেন তার সবটাই বন্যা নিয়ে গেছে। এর আগেও একবার বাড়ি ভেঙেছিল। তখনও বসত ভিটা আর গাছ-ফসলের সর্বনাশ ঠেকাতে পারেননি। ২০১৭ সালের বন্যায় পানির স্রোতে নিজের ভিটা-বাড়ি ৩০-৪০ ফিট নিচে দেবে গিয়েছিল। সরকারিভাবে কয়েকদিনের তৎপরতায় সেই দেবে যাওয়া জায়গাটি সমতল করা সম্ভব হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

বাহাদুর আলী দম্পতি কল্পনাও করতে পারেননি ধরলা নদীর বাঁধ ভাঙতে পারে। প্রথমেই ভেঙেছিল ধরলার যে স্থান ভরাট করে শাখা নদীর মুখ বন্ধ করা হয়েছে সেখানে। এরপর আরও কয়েকটি স্থানে ভেঙেছিল এ নদী। বাহাদুর আলী বলছিলেন- ‘হামার বাড়ি মাটির নিচে ডাবি গেইছে। পানির স্রোতে যখন টিন ভাসি ওঠে আর তলে যায়, তখন কয়খান টিন ধরছি।’ বলতে বলতে বাহাদুর আলী আমার হাত ধরে তার বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। ঘরের একটি শক্ত দরজা দেখিয়ে দিয়ে বললেন- ‘কয়খান টিন আর খালি এই দরজাখ্যান পাছি। আর কিচ্ছু পাই নাই।’ তদের বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখলাম কোনো কিছুই পুরনো নয়। সবকিছুই নতুন। তিনি খাট, টেবিল, চেয়ার ট্রাংকসহ ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেখাচ্ছিলেন আর বলছিলেন সবই নতুন।

তাদের গরুগুলো মারা যায়নি। পাশের একটি উঁচু বাড়িতে গরুগুলো বেঁধে রাখা ছিল। সেখানেও পানি উঠেছিল। বাহাদুর আলীর বর্ণনা মতে পানির মধ্যে গরুগুলোর শরীরে অর্ধেক সাত দিন ডুবে ছিল। গরুর ডুবে থাকা অংশের গায়ের রঙ বদলে গিয়েছিল। তার স্ত্রী নাজমুন দুঃখ করে বলছিলেন- ‘এই বুড়া বয়সোত আর কতকোনা (কতটুকু) কইরবার পমো, সোগে (সব) শ্যাষ।’

যেদিন বন্যা হয় সেদিন তারা জীবন বাঁচানোর তাগিদে একেকজন একেক দিকে ছুটেছেন। বড় ছেলে বাড়ি থেকে তিন-চার কিলোমিটার দূরে কাজ করতে গিয়েছিলেন। ছেলের বউ, সন্তান গেছে আরেক দিকে। বাহাদুর আলী বাড়ির এই অবস্থা দেখে পাগলপ্রায় হয়ে কয়েকদিন বাধের রাস্তায় পড়ে ছিলেন। সাতদিন পর ছেলে-বাবা-মা একসাথে হয়েছিলেন। এই কদিনে কে বেঁচে আছে নেই, তারা জানতেন না।

নাজমুন বন্যার সময়ে এক কিশোরের মৃত্যুর বর্ণনা দিচ্ছিলেন। তার ভাষ্যে ছেলেটির বয়স আনুমানিক ১০-১২ বছর হবে। তার হাতে দড়ি দিয়ে কয়েকটি হাঁস বাঁধা ছিল। ভয়াবহ বন্যায় পানির স্রোতে মৃত কিশোর ভেসে এসেছে। তার হাতে বাঁধা হাঁস বেঁচেছিল। স্থানীয়রা লক্ষ্য করেন কয়েকটি হাঁস সবসময় পানিতে ভেসে থাকে একটি গাছের ডালে বসে থাকে। তখন সেই হাঁস ধরতে গিয়ে তারা পানিতে ভেসে থাকা মৃত কিশোরকে দেখতে পান। বেঁচে আছে হাঁস, বেঁচে নেই কিশোরটি। তারা জানেন না কতদূর থেকে, কোন গ্রামের কিশোর পানিতে ভাসতে ভাসতে এসেছে। কিশোরের বাড়ি বাংলাদেশ না ভারত তা বোঝারও উপায় ছিল না। তার বাবা মাকেও তারা খুঁজে পাননি। বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করেছে। মৃত কিশোরের বাবা-মা, স্বজন হয়তো আর কোনদিন জানতে পারবেন না কিশোরের খবর। তারা অপেক্ষায় থাকবেন একদিন কিশোর ফিরবে।

২০১৭ সালে যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল সেই বন্যায় বন্যার্তদের নিরাপদে আনার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এখনো সেই ব্যবস্থা নেই। বন্যা মোকাবিলা করার জন্য যে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন তা না থাকার কারণে প্রতিবছর প্রচুর জানমালের ক্ষতি হয়। ওই বন্যায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার এখনো সংস্কারের কাজই বাকি আছে। কুড়িগ্রামের টগরাইহাটে যে সেতু ভেঙেছে তা এখনো ভাঙাই আছে। রেল লাইন এখনো জোড়াতালি দিয়েই চলছে। এমনও হয়েছে সেতু ভেঙে গেছে, সেই সেতু নতুন করে নির্মাণ না করে মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়ির উত্তর পাশে একটি সেতু ভেঙে গিয়েছিল। সেখানে সেতু না বানিয়ে মাটি দিয়ে ভরাট করে দেওয়া হয়েছে।

বন্যা কয়েকটি জেলায় প্রতিবছর হয়। এই বন্যা সম্পূর্ণ রোধ করা সম্ভব না হলেও বন্যার ক্ষতি অনেকটাই রোধ করা সম্ভব। প্রতিবছর আমরা বন্যায় ক্ষতি দেখি, ক্ষতিপূরণ কিংবা ক্ষতি প্রতিরোধক কোনো ব্যবস্থা দেখি না। ২০১৭ সালে কুড়িগ্রাম-দিনাজপুরে দু’শো বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার নেপথ্যে মনুষ্য সৃষ্ট কারণও কম নয়।

২০১৮ এবং ২০১৯ সালেও বন্যায় ক্ষয়-ক্ষতি কম হয়নি। আমরা প্রতিবছর বন্যার পরে ক্ষতির কথা ভুলে যাই। ফির বছর বন্যাই আমাদের বন্যার কথা মনে করিয়ে দেয়। এখন বন্যার মৌসুম নেই। প্রকৃত অর্থে এখনি সময় বন্যা প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা জরুরি। যদিও জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের কতখানি জনপ্রতিনিধি মনে করেন তা নিয়ে সংশয় আছে। মৃত কিশোরের হাতে বেঁচে থাকা হাঁসবিষয়ক আর কোনো শোকগাথা রচিত হোক কিংবা বাহাদুর আলীদের জীবনে করুণ বাস্তবতা নেমে আসুক তা আমরা কিছুতেই চাই না। উন্নয়নের চাপে পড়ে নদীগুলো হাঁসফাঁস করতে থাকবে, তীরবর্তী মানুষ প্রতি বছর হারাবে তাদের জীবন-ফসলি জমি-আবাস তা বন্ধ হওয়া জরুরি।

 

তুহিন ওয়াদুদ: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক, ইউজিসি পোস্ট ডক্টোরাল ফেলো এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক।