ভারতের নাগরিকত্ব বিল: কেন, কারা করছে বিরোধিতা

  • শরিফুল ইসলাম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

শরিফুল ইসলাম, ছবি: বার্তা২৪.কম

শরিফুল ইসলাম, ছবি: বার্তা২৪.কম

৯ ডিসেম্বর ভারতের লোকসভায় পাস হয়েছে ভারতের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল-২০১৯। ১১ ডিসেম্বর রাজ্যসভায় বিলটি উত্থাপন হওয়ার কথা রয়েছে। ১৯৫৫ সালের একটি আইনের সংশোধনী আনতে এ বিলটি নিয়ে এসেছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সরকার। প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্রাদি ছাড়া যেসব হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, পার্সি ও জৈন সম্প্রদায়ের লোকেরা অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছে বা অনুমোদিত মেয়াদ পার হওয়ার পরও এসব সম্প্রদায়ের যারা অবস্থান করছে তাদেরকে ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯৫৫ সালের আইনে তারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।

বিলটিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে আসা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের নাগরিকত্ব দেবে ভারত। এসব ব্যক্তি ভারতে বৈধ বা অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি রয়েছে কিনা সেটির চেয়ে দরকার হবে, তারা ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে প্রবেশ করেছে কি না। দেশ ছাড়ার কারণ যা-ই হোক না কেন, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নিজ থেকেই ভাবছে, এসব মানুষ নিজ দেশে সংখ্যালঘু। তাই তারা বিভিন্নভাবে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার। জীবন বাঁচানোর জন্য তারা ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে। শরণার্থী বিবেচনায় আশ্রয় দেয়া এবং নাগরিকত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিজেপি সরকার।

বিজ্ঞাপন

এ বিলটি যে বিজেপির রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা যে কেউ সহজে অনুমান করতে পারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। মালদ্বীপ তাহলে কেন নয়? মালদ্বীপেরও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। মালদ্বীপে কী মানুষ নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয় না? মালদ্বীপের নাম নেই, কারণটা সোজা। মালদ্বীপেতো একই ধর্মের মানুষের বসবাস। নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা নেই তালিকায়। সংখ্যালঘুদেরই যদি আশ্রয় দেয়া উদ্দেশ্য হয়, তাহলে এসব দেশের সংখ্যালঘুদের কেন নয়? কেননা এসব দেশের সংখ্যালঘুরা মুসলিম ধর্মের।

বিলটি লোকসভায় ৩১১-৮০ ভোটে বিলটি পাস হলেও রাজ্যসভায় বিজেপি নিশ্চিতভাবে পাস করাতে পারবে কিনা সেটি বলা মুশকিল। কেননা প্রত্যেক মিত্রের ভোটের প্রয়োজন হবে বিলটি পাস করাতে। রাজ্যসভায় বিলটি পাস হতে লাগবে ১২১ ভোটের। রাজসভায় বিজেপির রয়েছে ৮৩ জন সদস্য। জোটের মিত্র বিজেডির ৭, এআইএডিএমকের ১১, আকালি দলের ৩, শিবসেনার ৩, জেডিইউর ৬, ওয়াইএসআর কংগ্রেসের ২, এলজেপি ও আরপিআইয়ের ১ জন করে সদস্য রয়েছে। এছাড়াও বিজেপি সরকার মনোনীত সদস্য রয়েছে চারজন। প্রত্যেকেই বিলের পক্ষে রায় দিলে তবেই পাস হবে এটি। মিত্রদের কেউ পাশ কাটলে, বিজেপিকে রাজি করাতে হবে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ছোট কিছু দলের সদস্যকে। তবে, সিদ্ধান্তে পরিবর্তনকারী হিসেবে যেসব দলের প্রতিনিধিদের মনে করা হচ্ছে, সেসব রাজ্যে এরইমধ্যে নাগরিকত্ব বিলের প্রতিবাদে বিক্ষোভ চলছে।

এরই মধ্যে যারা লোকসভায় বিলটির পক্ষে রায় দিয়েছেন, তাদের কেউ কেউ দ্বিতীয়বার ভাবছেন রাজ্যসভার বিলের ওপর তাদের রায় দেয়ার ব্যাপারে। হিন্দুত্ববাদী দল শিবসেনার প্রধান উদ্ধব ঠাকরে বলেছেন, তারা লোকসভায় বিলের পক্ষে ভোট দিয়েছেন, তবে রাজ্যসভায় যে তারা একই আচরণ করবে-এমনটি নাও হতে পারে। দলটি বলেছে, বিলটিতে অনেক বিষয় নিয়ে তাদের প্রশ্ন রয়েছে। সেসব প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাবের ওপর নির্ভর করবে শিবসেনার সিদ্ধান্ত। এমনকি শিবসেনার মুখপত্র সামানায় লেখা হয়েছে, ‘বিলটি ভারতে অদৃশ্যনীয় বিভক্তি‘ তৈরি করবে।

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড (জেডিইউ) লোকসভায় বিলটিতে সমর্থন দেয়া দলের ভেতর থেকে সমালোচনা শুরু হয়েছে। দলের শীর্ষ দুই নেতা পবন ভার্মা ও প্রশান্ত কিশোর জেডিইউ প্রধানকে রাজ্যসভায় বিলটিকে সমর্থন না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, বিলটি দলীয় গঠনতন্ত্র ও দেশের সংবিধান পরিপন্থী। আগামী রাজ্য নির্বাচনকে লক্ষ্য করে বিজেপির কথায় নিতিশের সিদ্ধান্ত নেয়াকেও ভালোভাবে দেখছেন না তারা। এ দুই নেতা সাফ জানিয়েছেন, জেডিইউ একই অনেক বিষয়ে নিজের মতো করে চলতে পারে।

বিলটি ৯ ডিসেম্বর লোকসভায় উত্থাপনের আগে থেকেই পার্লামেন্টের ভেতরে বাইরে চলছে প্রতিবাদ, রাস্তায় রাস্তায় হচ্ছে বিক্ষোভ। তবে, বিরোধীদের সবপক্ষই কিন্তু একই উদ্দেশ্যে বিক্ষোভ করছে না। একেক পক্ষের অবস্থান আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস বিরোধিতা করছে, এই বলে যে, এই বিলের মাধ্যমে সংবিধানকে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। ধর্মের ভিত্তিতে আইন বানিয়ে ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্র পাল্টে দেয়ার চেষ্টা চলছে। শশী থারুরসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা একে বলেছে, এ বিল আইনে রূপান্তরিত হলে ভারত হবে ‘হিন্দু পাকিস্তান’।

অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুলের প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসিও বলছেন, এ বিলের মাধ্যমে ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষ চরিত্র হনন করা হচ্ছে। দেশভাগের সময় গান্ধীর ডাকে সারা দিয়ে নিজের পূর্ব পুরুষ ভারতকে বেছে নিয়েছিলেন, সেটিও উল্লেখ করেছেন লোকসভায় বিলটি নিয়ে দেয়া বক্তব্যে। বিলের কপি লোকসভায় ছিঁড়ে জানিয়েছেন নিন্দা। তৃণমূল কংগ্রেস, ডিএমকে, সমাজবাদী পার্টি, বহুজন সমাজ পার্টিসহ বিভিন্ন একই সুর তুলে বিরোধিতা করছে। সংসদ সদস্যদের পাশাপাশি শিল্পী, শিক্ষক, লেখক, আমলা, সাংবাদিক, সাবেক বিচারকসহ সুশীল সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি সরকারের এ পদক্ষেপর বিরুদ্ধে বলছেন, লিখছেন ও বিক্ষোভ করছেন।

মুসলিমরাও করছে বিক্ষোভ। তাদের শঙ্কা, এ বিলটি আইনে পরিণত হলে তাদের ওপর নেমে আসতে পারে বিভিন্ন বৈষম্যমূলক আইন। তিন দেশের মুসলিমকে ‘নিপীড়নকারী’ বা ‘নির্যাতনকারী’ হিসেবে উপস্থাপন করে অমুসলিমদের আশ্রয় দেয়া, নিজ দেশের মুসলিমদের ওপর ‘অত্যাচার‘ বাড়ার সম্ভাবনাকে তারা উড়িয়ে দিতে পারছে না।

অন্যদিকে, বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় চলছে বিলবিরোধী আন্দোলন। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে, ১০ ডিসেম্বর আসামে ১২ ঘণ্টার হরতাল পালন করেছে বিভিন্ন আসামি ছাত্রসংগঠন ও বামপন্থী রাজনৈতিক দল। বিক্ষোভ প্রতিবাদ ও ধর্মঘট হয়েছে ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও মেঘালয়ও। দিল্লিতেও আসামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন গোষ্ঠী করছে বিক্ষোভ। তাদের অনেকে কেন্দ্রীয় সরকারের সমর্থকও। তাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য, আসামের এনসিআর (ন্যাশনাল সিটিজেন রেজিস্টার) করার উদ্দেশ্যের মতো। তারা চান, ‘অবৈধ অভিবাসীদের' তাড়াতে। কিন্তু নাগরিকত্ব বিল আইনে পরিণত হলে এনসিআর থেকে বাদ পড়া অমুসলিমরা পেয়ে যেতে পারেন নাগরিকত্ব। কেন্দ্রীয় সরকার বিলটি নিয়ে আসায় ফুটবলার থেকে রাজনীতিক বনে যাওয়া বাইচুং ভুটিয়াও সিকিম রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলকে আহ্বান করেছে বিজেপির সঙ্গে মিত্রতার ছেদ করতে।

নাগরিকত্ব বিল আইনে পরিণত হলে এর প্রতিক্রিয়া কী হবে তা এখনই পুরোটা অনুমেয় না হলেও কিছুটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে বিলবিরোধী বিক্ষোভে। ১১ ডিসেম্বরের রাজ্যসভার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে বিলবিরোধীদের কর্মকাণ্ডের অনেকাংশ।

রাজ্যসভায় বিলটি টিকে গেলে বিজেপির জন্য বিলটি রাজনৈতিক মুনাফা অর্জনে কতটা সহায়ক হবে সেটি ভাবার বিষয়। বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতারা ভোট ব্যাংক বাড়াতে এই বিলটি নিয়ে আসলেও, আইন হওয়ায় নিজেদের হাতে থাকা ভোট যে হারাবে না তার নিশ্চয়তা দেয়াটা কঠিন। অনেক রাজ্যের স্থানীয়রা ‘অবৈধ অভিবাসী’ বা ‘অনুপ্রবেশকারী’ তাড়াতে চাওয়া ব্যক্তিরা বিজেপিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনার পর এ বিলের কারণে তাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে কিনা সেটিই প্রশ্ন। আর এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে বিজেপি কীভাবে ইস্যুভিত্তিক কৌশল এঁটে জোট টিকে রাখে। জনগণের রায় বুঝতে হলে চোখ রাখতে হবে বিলবিরোধী বিভিন্ন রাজ্যের বিধান সভা নির্বাচন ও ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের ওপর। এর মধ্যে বিলটি নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতেও যেতে পারে অনেকে।


শরিফুল ইসলাম: পিএইচডি শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, সাউথ এশিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়, নিউদিল্লি।