বিশ্ব অর্থনীতিতে উদীয়মান শহরের পাশে ঢাকায় দূষণের বিপদ

  • ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

একবিংশ শতকের প্রথমাংশে বিশ্বের প্রধান শহরগুলো আধুনিক অর্থনীতির ইঞ্জিন স্বরূপ কাজ করে চলেছে। বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যা এখন শহুরে এলাকায় বাস করে। মানুষ, প্রযুক্তি ও নগরায়নের অভূতপূর্ব সমাবেশ নিয়ে শহরসমূহ বিশ্বব্যাপী আর্থিক বৃদ্ধির গতিপথকে বিরাট আকার দিতে প্রস্তুত। এই ধারায় আজকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেওয়া শহরগুলোর থেকে বেশ আলাদা হতে পারে।

২০৩৫ সালে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) দ্বারা শীর্ষ ১০টি শহর মোটামুটি বিস্তৃত হবে। তিনটি শহর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হবে বলে আশা করা হচ্ছে - নিউ ইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস এবং শিকাগো। বিগ অ্যাপলের পূর্বাভাস ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপি সম্ভবত তার শক্তিশালী ব্যাংকিং এবং অর্থ খাত থেকে উদ্ভূত হবে। চারটি শহর চীনে পাওয়া যাবে, যেখানে লন্ডন, প্যারিস এবং টোকিও শেষ তিনটিতে রাউন্ড আউট করতে প্রস্তুত।

বিজ্ঞাপন

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের পরিসংখ্যানে ১.৬ ট্রিলিয়ন ডলার জিডিপি সহ টোকিও ছিল বিশ্বের ১ নম্বর শহর, যা তার পুরনো গৌরব হারাবে। আর্থিক শক্তির পাশাপাশি জনসংখ্যা অনুসারে শীর্ষ শহরগুলো একটি স্বতন্ত্র বৈশ্বিক বন্টন অনুসরণ করবে। ২০৩৫ সাল নাগাদ, এশিয়ায় অবস্থিত সাতটি শহর সহ সর্বাধিক উচ্চ-জনসংখ্যার শহরগুলো পূর্ব দিকে স্থানান্তরিত হবে। তবে, জাকার্তার ৩৮ মিলিয়ন-শক্তিশালী জনসংখ্যা প্রথম স্থানে আবির্ভূত হবে বলে আশা করা হলেও শহরটি ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী হিসাবে তার মর্যাদা বেশিদিন ধরে রাখতে পারবে না। কারণ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং পানির দুর্বল অবকাঠামো ব্যবস্থাপনার জন্য জাকার্তা দ্রুত ডুবে যাচ্ছে—এবং সরকার এখন রাজধানীকে বোর্নিও দ্বীপে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।

আফ্রিকা মহাদেশের কিনশাসা এবং লাগোস ইতিমধ্যেই বিশ্বের বৃহত্তম মেগাসিটিগুলোর তালিকার মধ্যে রয়েছে (১০ মিলিয়নেরও বেশি লোকের বাসস্থান) এবং শতাব্দীর শেষের দিকে শীর্ষস্থান ধরে রাখবে। দক্ষিণ আফ্রিকার শহরগুলো বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিযোগিতার সামনের কাতারে চলে আসবে শক্তিশালী নগর কাঠামোর কারণে।

বিজ্ঞাপন

আগামীর শহরগুলোর ক্ষেত্রে জনসংখ্যা যে একটি দেশের বৃদ্ধির প্রধান সম্পদ হতে পারে, তার উদাহরণ দেখা যাবে ভারতে। ভারতের ক্রমবর্ধমান কর্ম-বয়স জনসংখ্যা একটি অনন্য সুবিধা উপস্থাপন করবে। বিশেষত দক্ষিণ ভারতের শহরগুলো এক্ষেত্রে এগিয়ে আসবে সামনের সারিতে। অন্যদিকে উত্তরের প্রধান শহরগুলো (রাজধানী দিল্লি সহ আরও কয়েকটি শহর) দূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বৈশ্বিক গুরুত্ব হারাবে আর পশ্চিমের মুম্বাই প্রভৃতি শহর প্রাকৃতিক বিপদ, বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে নিজের অবস্থান হারাবে।

তারপরেও আগামীর পৃথিবীতে নেতৃত্ব প্রদানকারী শহরগুলোর অধিকাংশেরই অবস্থান হবে এশিয়ায়। কারণ, বর্তমান বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল শহরগুলোর মধ্যে চারটি মূল ভূখণ্ড চীনে, আরও চারটি ভারতে এবং শেষ দুটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবস্থিত হবে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, ২০২৫ সালের মধ্যে ব্যাঙ্গালোর ৮.৫% প্রত্যাশিত বৃদ্ধির পূর্বাভাস সহ এক নম্বরের স্থান দখল করবে। এই শহরটিতে রয়েছে—এর উচ্চ-মানের প্রতিভা, দক্ষ জনশক্তি, সুন্দর পরিবেশ, মসৃণ যোগাযোগ ব্যবস্থা। এজন্যই শহরটি প্রযুক্তিগত স্টার্টআপগুলোর জন্য একটি নিরাপদ প্রজনন ক্ষেত্র রূপে সমাদৃত।

ভারতের ক্ষেত্রে মাত্র একটি শহর বৈশ্বিক অর্থনীতির নেতৃত্বে আসবে বলে ধারণা করা হলেও চীন থাকবে সামনের দিকে। চীনের সাংহাই এমন একটি পথ খুঁজে পেয়েছে, যা শহরটিকে শুধু এশিয়াই নয়, বিশ্বের আর্থিক রাজধানীর মর্যাদা দেবে। । চীনের বাণিজ্যিক রাজধানী, বিশ্বের ব্যস্ততম বন্দর এবং চীনের দুটি প্রধান স্টক এক্সচেঞ্জের একটি সাংহাই শহরে অবস্থিত হওয়ায় সাংহাইয়ের বার্ষিক জিডিপি বৃদ্ধিকে ২০৩৫ সালে ৫%-এ উন্নীত করতে সাহায্য করতে পারে।

অবশ্যই, বিশ্বের উদীয়মান আর্থিক নেতৃত্ব প্রদানকারী শহরগুলো নানা কারণে অগ্রগতির পথে পিছিয়ে যেতে পারে যদি আর্থিক মন্দা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, প্রাকৃতিক দুযোগ ও দূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, দ্রুত নগরায়ন এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি সম্পন্ন করার সময় দূষণের ক্ষতি অনেক শহরই সামলাতে পারছে না। বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো রয়েছে চরম বিপদের মধ্যে।

দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোর ক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণের কোনও সুযোগ ছিল না। কেননা, শহরগুলো মুঘল ঐতিহ্য অনুসরণ করে বৃক্ষ ও উদ্যানের সমন্বয়ে নগরায়নের পথে অগ্রসর হয়েছিল। পরবর্তীতে ইংরেজরাও এই সবুজায়নের ধারা অব্যাহত রাখে। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রধান দেশগুলোর রাজধানীসমূহ পরিবেশ দূষণের কারণে মারাত্মক বিপদের মুখোমুখি।

ঢাকা, লাহোর, দিল্লির দূষণ এখন আন্তর্জাতিক সংবাদ শিরোনাম। সারা বছর কমবেশি দূষণে আক্রান্ত শহরগুলো শীতের কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়তে না পড়তেই দূষণের দাপট আরও বাড়তে থাকে। দূষণ নিয়ন্ত্রণে সরকার নিয়মমাফিক পদক্ষেপ কতটুকু নেয়, তা স্পষ্ট নয়। কখনও কিছুকিছু নিষেধাজ্ঞা জারি হলেও সামগ্রিক পদক্ষেপ নেই বললেই চলে। কখনও যান নিয়ন্ত্রণ বা বিনামূল্যে বিতরিত দূষণ প্রতিরোধক মাস্ক কিংবা তারপরেও দূষণের তীব্রতা আরও বেড়ে গেলে স্কুলে ছুটি ঘোষণা করা হয়। তাতে স্থায়ী সুফল কমই পাওয়া যায়। দিল্লিতে আদালতে হাজির হয়ে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সরকারের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপের আবেদন করতে বাধ্য হয়। রীতিমতো ওকালতনামা দিয়ে সরকার কবুল করে দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে চব্বিশ ঘণ্টা কাজ চলছে। একই সঙ্গে পেশ করা হয় কাজের তালিকা। দিনের শেষে কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন হয় না। দিল্লির মতো ঢাকাতেই দূষণের পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকে।

আবাসন শিল্পে যতই ভাটার টান আসুক, গৃহনির্মাণ দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং লাভজনক শিল্প। বৈধ এবং অবৈধ পন্থায় নতুন বাড়িঘর তৈরি, পুরনো বাড়ি ভেঙে আবার নতুন করে নির্মাণ এবং বাড়িঘরের আধুনিকীকরণ সারা বছর চলতে থাকে। ফলে সর্বত্রই সারা ক্ষণ ধুলো উড়ছে।

এর সাথে যানবাহন ও হাল্কা বা মাঝারী শিল্প থেকে আসা ধোঁয়াশায় মিশে গিয়ে এই সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা আবহাওয়াকে আরও দূষিত করছে। ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকা শহরে আকাশছোঁয়া বাড়ির সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। অভিজাত এলাকা হোক বা গরিব মহল্লা— চূড়ান্ত বিচারে পুরোটাই কংক্রিটের জঙ্গল। ধোঁয়া বেরিয়ে যাওয়ার পথ নেই। এমন দূষিত আবহাওয়া, যা নিয়ে আসে শ্বাসরোধের পরিস্থিতি। তার উপর গণপরিবহণগুলো ও ব্যক্তিগত গাড়িও দূষণ বাড়াচ্ছে। মেট্রোর পরিধি বৃদ্ধি করে বাস ও অন্যান্য যানবাহন কমালে বায়ু দূষণের হার কিছুটা হলেও কমানো সম্ভব হতো।

এইসব দূষণের কারণে দিনের শেষে শ্বাসকষ্টে জর্জরিত নাগরিকদের ডাক্তার-হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া অন্য পথ খোলা থাকে না। অথচ, এর স্থায়ী প্রতিকার কী করে করা যায় সে বিষয়ে সকলেই থাকে নীরব। ঢাকা যে বসবাসের জন্য অনুপযোগী ও বিপদজনক হয়ে যাচ্ছে এবং এর ফলে মানবিক বিপদ আর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক গুরুত্ব কাজে লাগাতে পারছে না, তার প্রতি কবে মনোযোগ দেওয়া হবে?

ড. মাহফুজ পারভেজ: অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; প্রফেসর ও চেয়ারম্যান, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।