মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধী রাজনীতি আর চলবে না

  • মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব:)
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষের অবসান ঘটিয়ে আদতেই দুর্নীতিমুক্ত এবং প্রকৃত অর্থেই একটা সোনার বাংলা আমরা প্রতিষ্ঠিত করতে পারব এমন প্রত্যাশাই এখন মানুষের মুখে মুখে। কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে সারা বিশ্বে যখন টালমাটাল অবস্থা এবং পুঁজিবাদের নগ্ন প্রতিযোগিতায় পুঁজি লুণ্ঠনের মহোৎসব চলছে তখন বাংলাদেশের মতো একটা উন্নয়নশীল উঠতি পুঁজিবাদি রাষ্ট্রে দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণে এনে জনপ্রত্যাশা পূরণ খুব সহজ কাজ হবে তা কিন্তু নয়। অত্যন্ত কঠিক কাজ এবং অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যখন বৃহত্তর জনগণ রাষ্ট্রের নেতৃত্বের প্রতি প্রশ্নহীন আস্থা রাখে তখন অনেক কঠিন কাজও আর তত কঠিন থাকে না। সেরকমই একটা আস্থার উদাহরণ সম্প্রতি সৃষ্টি হয়েছে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। নির্বাচনের ফলের দিকে তাকালেই এটা বুঝা যায়। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের মানুষ এ রকমই একটা আস্থা রেখেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর।

বিজ্ঞাপন

সেই পথ ধরে আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। এই আইনের পথ ধরে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাবার পূর্বেই এ। সব অর্জন ও সমস্ত সংগ্রাম বৃথা হয়ে গেল।

বাংলাদেশের নামের খোলসে এ দেশ হয়ে গেল উপমহাদেশের দ্বিতীয় পাকিস্তান। ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতি আবার বিভক্ত হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এর পক্ষ আর বিপক্ষ। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হওয়া নতুন রাজনৈতিক দল বিএনপি একাত্তরের পরাজিত ও পাকিস্তানের একান্ত সহযোগী জামায়াত, মুসলিম লীগসহ ধর্মাশ্রয়ী রাজনৈতিক দলগুলোকে পুনরুত্থানের সুযোগ করে দেয়। তারপর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ওই পাকিস্তান পন্থী দলগুলোর সঙ্গে একত্রিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় এবং রাষ্ট্র শক্তিকে ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন বহনকারী সব কিছু সংবিধান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সব জায়গা থেকে মুছে ফেলে।

সামরিক শাসনের ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে তিনি রাজনীতিতে নেমে পড়েন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক একটা জনসমর্থন অতি সহজেই জিয়াউর রহমান পেয়ে যান। জনসংখ্যার এই অংশটি তারাই, যারা সত্তর সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং স্বাধীনতা অর্জনের অনুঘটক ছয় দফার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। তখনকার জনসংখ্যার হিসেবে প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ ছিল ওই পক্ষে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এরাই ছিল পাকিস্তানের সহযোগী, কেউ সরবে, আবার কেউ নীরবে। অর্থাৎ শতকরা ২৫ ভাগ মানুষ পাকিস্তানি মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিল।

এটা কিন্তু খুব অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতার যুদ্ধ বা দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় এরকম বা এর থেকেও বেশি সংখ্যক মানুষ স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এবং দখলদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু দেশ স্বাধীন ও দখলদার বাহিনীর মুক্ত হওয়ার পর ওইসব বিরোধিতাকারী সকলেই পরাজয় মেনে নিয়ে বৃহত্তর স্বাধীনতাকামী জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে, একাত্মতা ঘোষণা করেছে। পিছনের ভুল সিদ্ধান্ত ও অপকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়েছে, জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছে। পরবর্তীতে আর কখনো সেই পুরনো রাজনীতি ও মতাদর্শের পুনরুত্থান ঘটাননি। সঙ্গত কারণে বিজয়ী পক্ষ মহত্বের পরিচয় দিয়েছে। যারা বড় ধরনের অপরাধ করেনি, তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন।

তবে দখলদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছে এমন সব দলকে চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যারা যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদেরকে অতি দ্রুত বিশেষ ট্রাইব্যুনাল করে কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ যেন আর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজ না করে। দখলদার বাহিনীর সহযোগী বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের নাগরিকত্ব চিরদিনের জন্য বাতিল করা হয়েছে। এভাবেই স্বাধীনতা উত্তর সময়ে আবার সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নতুন ভাবে দেশকে গড়ে তুলেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান বাহিনী ফ্রান্স দখল করে নিলে ফ্রান্সের জনসংখ্যার বড় একটা অংশ জার্মানের সঙ্গে সহযোগিতা করে এবং দখলদারি প্রশাসনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করে।

ফ্রান্সের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল মার্শাল পেতো জার্মানিকে সহযোগিতার পক্ষে নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মার্শাল পেতোসহ অনেককেই শাস্তি দেওয়া হয়, নাগরিকত্ব বাতিল করা হয় এবং বাকি সাধারণ সহযোগীদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি ফ্রান্সে চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ভিয়েতনাম, আলজেরিয়ার স্বাধীনতা উত্তর ইতিহাস ঘাঁটলে একই চিত্র পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ইতিহাস ও এরকমই হতে পারত। কিন্তু স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড এবং তারপর বিএনপি'র প্রতিষ্ঠাতা সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান কর্তৃক পাকিস্তানি মতাদর্শের রাজনীতি ফিরিয়ে আনার কারণে সেটি আর হতে পারিনি।

বঙ্গবন্ধু যদি আর দশটি বছর বেঁচে থাকেন তাহলে রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শের বিভাজনের যে অভিশপ্ত রাজনীতি তার থেকে আমরা মুক্ত থাকতাম। এতদিনে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গুলো অনেক শক্তিশালী হয়ে যেত। জনসংখ্যার যে অংশটি আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল তাদেরকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার কাজ বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন। তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। সেই ঘোষণায় বলা হয়েছিল চারটি বড় অপরাধ অর্থাৎ হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুট যারা করেনি তারা সাধারণ ক্ষমার মধ্যে পড়বে।  আর এই চারটি অপরাধ যারা করেছে তাদের ক্ষমা নেই, তাদের বিচার হবে।

কারণ এগুলো মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধের শামিল, এগুলোর ক্ষমা হয় না। এদের বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধু দুটি আইন করেছিলেন। একটি দালাল আইন, অন্যটি যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন। সারাদেশে আদালত বসিয়ে দালাল আইনে অনেকের বিচার শুরু হয়েছিল।  আর দুটি বছর বিচার অব্যাহত থাকলে বেশির ভাগ বিচার সম্পন্ন হয়ে যেত। গোলাম আযমসহ কয়েকজন দালালের নাগরিকত্ব বঙ্গবন্ধু বাতিল করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর রিকনসিলিয়েশন এই ধারাটি অব্যাহত থাকলে অন্যান্য দেশের মতোই আমাদের দেশে যারা স্বাধীনতা বিরোধী ছিল তারাও অতীত কলঙ্ককে পিছনে ফেলে মূল স্রোতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেত, হতে বাধ্য হত।

কিন্তু জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে দালাল আইন বাতিল করেছিলেন আটকদের জেল থেকে মুক্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয় তারা যাতে পুরনো পাকিস্তান পন্থী রাজনীতি করতে পারে তার সুযোগ করে দিলেন এবং তাদেরকে ডেকে ডেকে নিজের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপিতে নিয়ে এলেন। তাদের পাকিস্তান পন্থী রাজনীতির পথ সুগম করার জন্য জিয়াউর রহমান সামরিক আদেশ দ্বারা ৭২ এর সংবিধান সংশোধন করে ফেললেন। জামায়াত শহর নিষিদ্ধ দলগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করলেন জিয়া। সুতরাং জামায়াত-মুসলিম লীগ ও তাদের সমর্থক সেই প্রায় শতকরা ২৫ ভাগ জনগোষ্ঠীকে একাত্তরের পর যা দেখতে পাবে সেটাই তারা ফিরে পেলেন জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। শাহ আজিজ,আব্দুল আলিম মাওলানা মান্নান,  মশিউর রহমান যাদু মিয়া কাজী জাফর ক্যাপ্টেন হালিম ইত্যাদি গংদের তালিকা ধরে হিসাব করলে দেখা যাবে একাত্তরের পাকিস্তানের সব বড় বড় দালালগণ এসে জিয়ার সঙ্গে যোগ দিলেন জিয়াও তাদের সাদরে গ্রহণ করলেন।

তারপর এই গোষ্ঠী সম্মিলিত ভাবে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক আদর্শকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করলেনই তার সঙ্গে রাষ্ট্র যন্ত্র কে ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করলেন।

পাকিস্তানের ভাষায়ই বলতে থাকলেন ওইসব ছিল হিন্দু ভারতের ষড়যন্ত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে। তাতে ওই সময় তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ বিভ্রান্তিতে পড়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। জিয়া নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং তাঁর সঙ্গে আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা যোগ দেওয়ায় তরুণ প্রজন্মকে বিভ্রান্তিতে ফেলার কাজ সহজ হয়ে যায়। কিন্তু কথায় আছে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ৩০ লাখ জীবন বিসর্জন এর কাছে আলাদা সহজাত শক্তি আছে। তাছাড়া সেই সময়ের সারে সাত কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষা থেকে জন্ম নেওয়া আদর্শের একটা লুকায়িত জীবন শক্তি আছে। সেটাকে বলা যায় ফিনিক্স পাখির শক্তি। বারবার আগুনের ভস্ম থেকে আবার জ্বলে ওঠে জীবন্ত হয়।

গত ১০ বছর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ওপর দেশ পরিচালিত হওয়ায় এবং তথ্য বিপ্লবের সুযোগে বিএনপি'র সব জারিজুরি তরুণ প্রজন্মের কাছে ধরা পড়ে গেছে। ৩০ ডিসেম্বর ভোটের ফলাফলের তারিখ প্রতিফলন দেখা গেছে। সুতরাং সুযোগ এসেছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধী রাজনীতি বাংলাদেশ থেকে বিদায় করতে হবে। বিএনপিকে উপলব্ধি করতে হবে, আত্ম বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করতে হবে। সেটা যদি তারা করেন তাহলে দেখবেন জিয়াউর রহমান কর্তৃক প্রণীত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধী রাজনীতি বাংলাদেশ আর চলবে না। সময়ের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলাতে ব্যর্থ হলে বিএনপি নামক দলটি বাংলাদেশ আর থাকবে না। যেমনটি ঘটেছে বিশ্বের সব সামরিক শাসকদের সৃষ্ট দলের বেলায়। প্রকৃতির নিয়মে সময়ের টানে তখন বিএনপি'র শূন্যস্থানে সহজাত রাজনৈতিক ক্রিয়া প্রক্রিয়ায় নতুন মেরুকরণের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ এর বিপরীতে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ বিপক্ষ রাজনীতির অবসান ঘটবে। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিরোধী রাজনীতি বাংলাদেশে আর চলবে না। 

লেখক: রাজনৈতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক।