দুই প্রধান দলের নির্বাচনী ইশতেহারের তুলনামূলক বিশ্লেষণ

  • ফরিদুল আলম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

একটি বিষয় গত কিছুদিন ধরে অবাক হয়ে লক্ষ করছিলাম। এবারের নির্বাচনকে ঘিরে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর নির্বাচনী ইশতেহার কী হবে সেটা নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে কিছুটা ভাবনা থাকলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোনো আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়নি। নির্বাচনের দিন ক্রমেই সন্নিকটে – এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনের মাত্র ১২ দিন আগে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ১৮ ডিসেম্বর তাদের স্ব স্ব নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে।

নবম, জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্বালে ‘দিনবদলের সনদ’ শীর্ষক যে ইশতেহার আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রদান করা হয়েছিল, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপিসহ অপরাপর কিছু রাজনৈতিক দলের দশম জাতীয় নির্বাচন বর্জনের প্রেক্ষাপটে বিগত ১০ বছরে ক্ষমতাসীন দল তাদের ইশতেহার উল্লেখযোগ্য হারে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। আর তাই বর্তমান পরিস্থিতে উন্নয়নের সকল সুচকে বাংলাদেশ ঈর্শ্বনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।

বিজ্ঞাপন

বিগত একযুগ সময়ে দেশের মাথাপিছু জিডিপি বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৭শ ৫১ ডলার, বাজেটের আকার বেড়েছে সাড়ে ৭ গুণের বেশি, দারিদ্র্যের হার ৪১ শতাংশ থেকে নেমে এসেছে ২১ শতাংশে, নিজ অর্থে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলছে। এরই মধ্যে এবছর বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি মিলেছে। এমন পরিস্থিতিতে এবার আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করা হল সেটা বর্তমান সরকারের সময়ের উন্নয়নের ধারাবাহিকতারই অংশ বলা যেতে পারে।

এই ইশতেহারের মূলে রয়েছে সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয়কে আরও বেগবান করে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত করা, এবং এই লক্ষ্যে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য সকল নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্য নিয়ে ‘আমার গ্রাম-আমার শহর’ এমন প্রত্যয়কে ধারণ করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে আগামী দিনের জন্য তাদের পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে চায়।

আওয়ামী লীগের ইশতেহারের বিপরীতে আমরা যদি বিএনপির ইশতেহারের তুলনা করতে যাই তাহলে দেখতে পাব যে তাদের ইশতেহারের পুরোটাই রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবার একধরণের দুর্বার আকাঙক্ষা থেকে তৈরি করা, যা কার্যত বাস্তবায়ন করা তাদের জন্য খুব কঠিন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কর্তৃক ঘোষিত পুরো ইশতেহার বিশ্লেষণ করলে যা বোঝা যায় তা হচ্ছে তারা এমন কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভোটারদের মধ্যে একধরণের বিভ্রান্তি তৈরি করা এবং বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের মুক্তির বিষয়কেই এর মাধ্যমে প্রাধান্য দিতে চেয়েছেন। ইতোমধ্যে দুর্নীতি এবং গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ে দোষী সাব্যস্ত এবং সাজাপ্রাপ্ত বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানের সম্মান রক্ষায় ভোট চেয়ে দেয়া ইশতেহার জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হবার সম্ভাবনাই বেশি। তারা যদি এক্ষেত্রে বেগম জিয়া এবং তারেক রহমানের নামটি উহ্য রেখে তাদের আগামী দিনে জনগণের জন্য করণীয়গুলো স্পষ্ট করে মানুষের সামনে তুলে ধরতেন, যা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে উচ্চারিত হয়নি তাহলে জনগণের কাছে এটা মনে হতে পারত যে ব্যক্তি বিশেষের মঙ্গলের চেয়ে বিএনপি জনগণের উন্নয়নের জন্য অধিক মনযোগী।

নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হলে তারা আগামী দিনগুলোতে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করাসহ নির্বাচনকালীন সরকারের অঙ্গীকার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা প্রণয়নের অঙ্গীকার করেছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে বর্তমান সময়ের সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার ক্ষমতার যে বিভাজন রয়েছে সেটা ১৯৯১ সালে বিএনপি যখন সরকার গঠন করে তখন করা। আর নির্বাচনকালীন সরকারের যে প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছেন সেটাও অস্পষ্ট, যা বর্তমান সরকারের সময় তাদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপট থেকে নেয়া হলেও এর সুনির্দিষ্ট কোনো রূপরেখা দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছেন।

আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, তাদের ইশতেহার ঘোষণার আগের ফিন ঐক্যফ্রন্টের যে ইশতেহার ঘোষণা করা হয়েছে তার আলোকে ঐক্যফ্রন্টের অংশ হিসেবে তারা এটিকে তাদের ইশতেহারের অংশ করেছেন। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রণয়ন এবং তাদের সম্মানী ভাতা বৃদ্ধিসহ অপরাপর সুবিধা বৃদ্ধির কথা বললেও চলমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে কোনো কথা উচ্চারণ করেননি। তাদের জোট ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে যুদ্ধাপরাধের কার্যক্রম চলমান থাকবে বলা হলেও তারা সম্ভবত ২০ দলীয় জোটে জামায়াতের শক্ত অবস্থা এবং চাপের কারণে এই বিষয়কে ইশতেহারের আনেননি।

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এই দুটি দল বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত প্রায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে দেশের মানুষের সমর্থন নিয়ে পথ চললেও সময়ের পরিক্রমায় ৯০ পরবর্তী সময়ে বিএনপি ১০ বছর এবং আওয়ামী লীগ ১৫ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পায়। তাদের সময়কার রাষ্ট্র পরিচালনা এবং বিভিন্ন প্রতিশ্রুতিসমূহ কতটুকু তারা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছিল- আমার ধারণা এবারের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে ভোটাররা সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই করে দেখবেন। অতীতে নির্বাচনের আগে জনগণের ভোট আকর্ষণে অনেক ধরণের প্রতিশ্রুতই উচ্চারিত হয়েছে, কিন্তু আমরা আওয়ামী লীগের বিগত ১০ বছর সময় বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই তারা প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতির পথে হেঁটেছে।

এক্ষেত্রে একটি কথা থেকে যায়, তা হল প্রতিশ্রুতির অনেক কিছুই ক্ষমতার নির্ধারিত ৫ বছর মেয়াদে পূরণ করা সম্ভব হয় না, কিন্তু এখানে জনগণ দেখতে চাইবে নির্বাচিত সরকার তাদের প্রতিশ্রুতিগুলোতে হাত দিয়েছে কি না। এইসব ক্ষেত্রে জনগণ যদি অতীতের সময়ের সরকারের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করতে চান তাহলেও দেখবেন যে এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে অগ্রগামী।

এবারের নির্বাচনে বিএনপির ইশতেহারের দিকে মনযোগ দিলে দেখা যাবে যে তারা বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান এবং তাদের কিছু দলীয় নেতা কর্মীদের মুক্তির প্রয়োজনীয়তার বিষয়কে সংযোজন করে এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চলমান কার্যক্রমকে বাদ দিয়ে বাদবাকি অংশটুকু ঐক্যফ্রন্ট প্রদত্ত ইশতেহারের অনুলিপি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাদের এধরণের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হতে পারে যে তারা উপরের নির্দেশে কেবল একটি নির্বাচনে দায়সারাভাবে অংশগ্রহণের লক্ষ হিসেবে একটি ইশতেহার দিতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের এবারের নির্বাচনে আসতে ঐক্যফ্রন্টের যে ছাতিমতলাকে তারা ব্যবহার করেছে, নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের ক্ষেত্রে সেখানে ঐক্যফ্রন্টের সাথে সমন্বয়ের ক্ষেত্রে কিছু মৌলিক জায়গায় প্রবল ঘাটতি দেখা গেছে।

এখানে ঐক্যফ্রন্ট প্রধান ড. কামাল হোসেন কর্তৃক নির্বাচনী ইশতেহারের কোনো প্রয়োজন ছিল কি না সেটা নিয়ে সঙ্গত কারণে প্রশ্ন থেকে যায়। ঐক্যফ্রন্টের দলগুলো বিএনপির পক্ষ থেকে ছাড় পাওয়া সাকুল্যে ১৯টি আসনে নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে বিএনপিকে বাদ দিলে এই ১৯টি আসনে নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে তারা কীভাবে সরকার গঠন করবে সেটা এক বিরাট প্রশ্ন। আর ঐক্যফ্রন্টের অপরাপর দলগুলো যদি একসাথে ইশতেহার প্রণয়ন এবং ঘোষণা করতে পারে তবে বৃহত্তম দল হিসেবে বিএনপি কেন ঐক্যফ্রন্টের বাইরে আলাদাভাবে তাদের নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করবে?

এর মধ্য দিয়ে যে হিসেবটি সকলের সামনে স্পষ্ট হয়ে যায় তা হচ্ছে ঐক্যফ্রন্ট আসলে একটি নির্বাচনী ফ্রন্ট। এই ফ্রন্টের ক্ষমতাসীন হওয়া বা না হওয়া বড় কথা নয়। তাদের মুল উদ্দেশ্য হচ্ছে একট ষরযন্ত্র তত্ত্বের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের অবসান ঘটানো। এই লক্ষ্যে পরবর্তী সময়ে বিএনপির হাতে ক্ষমতার চাবিকাঠি তুলে দেবার বিনিময়ে ভাগ বাটোয়ারার বিষয়টিও নিশ্চয়ই রাতের অন্ধকারে নিষ্পত্তি হয়ে রয়েছে।

একটি নির্বাচনী ইশতেহার যে নির্বাচনের পূর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য কতটা প্রয়োজন সেটা নিশ্চয়ই বিএনপি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়ে ঐক্যফ্রন্টের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছে এই ভেবে যে আগামীতে তাদের সম্মিলিত ষড়যন্ত্রতত্ত্বের ছক অনুযায়ী তারা ক্ষমতাসীন হবে। বারবার আন্দোলন কৌশল পরিবর্তন করে তারা একটি পূর্ণাঙ্গ ইশতেহার ব্যতীত নির্বাচনে বিজয়ী হবার যে সংক্ষিপ্ত পথ অন্বেষণ করছেন অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তারা আবারও অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে।

এবারও যদি তেমনটা হয় এবং দুদিনের এই ঐক্যফ্রন্টের খেলাও সাঙ্গ হয় তাহলে কি তাদের আত্মরক্ষার আর কোনো পথ অবশিষ্ট থাকবে?

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।