ইশতেহারে জামায়াত প্রসঙ্গ

  • এরশাদুল আলম প্রিন্স
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ছবি: বার্তা২৪.কম

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ছবি: বার্তা২৪.কম

জামায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ বিরোধীতা যে শুধু তাদের একটি রাজনৈতিক অবস্থান ছিল তা নয়, বরং বাংলাদেশের বিরোধীতা করতে গিয়ে জামায়াত নেতা-কর্মীরা যুদ্ধাপরাধ তথা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে সম্পৃক্ত হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন, জামায়াতের অবস্থান ছিল তাদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে জামায়াত তার অস্তিত্বের সবটুকু শক্তি দিয়েই লড়াই চালিয়েছে স্বাধীনতা লাভের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতা লাভের পরও তারা নানাভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। কাজেই যৌক্তিকভাবেই বাংলাদেশে জামায়াতের রাজনীতি করার অধিকার থাকার কথা নয়।নৈতিকভাবেতো নয়ই।

কিন্তু তারপরও এ দলটি বাংলাদেশে এখনও রাজনীতি করছে। শুধু তাই নয়, ক্ষমতার ভাগীদারও হয়েছে। জামায়াত নেতারা সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেছে ও সেই গাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা লাগানো হয়েছে। তাদের বাসভবনেও জাতীয় পতাকা উড়েছে। এটি মুক্তিযুদ্ধ তথা শহীদদের প্রতি এক চরম অবমাননা ছাড়া আর কী হতে পারে? কিন্তু এই দায়ভার কার?

বিজ্ঞাপন

স্বাধীনতার পর বিএনপি জামায়াতকে রাজনীতিতে পুনবার্সিত করেছে। এটি বিএনপির প্রথম সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভুল। প্রাথমিকভাবে হয়তো বিএনপি কিছু তাৎক্ষনিক ফায়দা হাসিল করতে পেরেছে। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী ফল বিএনপির জন্য ভালো কিছু নিয়ে আসতে পারেনি। উপরন্তু, জামায়াত বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে বশীভূত করেছে। তাই আজও আমরা দেখি বিএনপির কাধে জামায়াতে বোঝা। তবে এটাও ঠিক, স্বাধীনতার পরে জামায়াতের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক অর্জন আওয়ামী লীগের সাথে যুগপথ আন্দোলন করা। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে বাঙালী মু্ক্তিসংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি পক্ষের শক্তির সাথে যুগপথ রাজনৈতিক সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়া জামায়াতের জন্য এক বড় অর্জনই বটে। তবে আওয়ামী লীগ সে দায় থেকে অনেকটাই মুক্ত হতে পেরেছে। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছে। শুধু জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার কাজটি এখনও বাকি। হয়তো আরেকবার ক্ষমতায় এলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের দল জামায়াতকে নিষিদ্ধ করবে। এটাই যৌক্তিক।

ঐতিহাসিক কারণেই জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার প্রশ্নে বিএনপির চেয়ে আওয়ামী লীগের কাছেই জনগণের প্রত্যাশাটা বেশি। সে ঐতিহাসিক ম্যান্ডেট আওয়ামী লীগের আছে। কাজেই জামায়াত নিষিদ্ধ করা সময়ের দাবি।

বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলেই তারা দাবি করে। এবং তাদের দলে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কম নয়। জিয়াউর রহমান একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রেখেছেন। তিনি একজন বীর উত্তম। কাজেই জামায়াতকে রাজনীতিতে আশ্রয় দিয়ে জিয়াউর রহমান যে পাপ করেছেন, বিএনপির উত্তর প্রজন্মের উচিত ছিল জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে তওবা পড়ে সে পাপ থেকে মুক্ত হওয়া। কিন্তু বিএনপির মধ্যে সেই ভাব-লক্ষণ নেই। উপরন্তু জামায়াত ছদ্মবেশে এখন বিএনপির মধ্যে ঢুকে পড়ছে। এ প্রবণতা শুধু বিএনপিতে নয়। অন্যান্য দলেও তারা ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে এবং সফলও হচ্ছে।

জামায়াতের নেতাদের বিচার হওয়ার পরে জামায়াত এখন অনেকটাই বেশামাল। এর সাংগঠনিক ভিত্তিও আর আগের মতো নেই। জামায়াত এখন নখ-দন্তহীন কাগুজে বিড়াল। এছাড়া জামায়াতের অঞ্চল বিশেষে কিছু ভোট থাকলেও দেশব্যাপী তাদের উল্লেখযোগ্য তেমন ভোটব্যাংক নেই। উপরন্তু জামায়াতের নিবন্ধনও বাতিল করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। ফলে জামায়াত পরিচয়ে বা দাঁড়িপাল্লা নিয়ে জামায়াতের আর নির্বাচন করার সুযোগ নেই। বিএনপির জন্য জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার জন্য এটি ছিল এক মহাসুযোগ। কারণ, জামায়াতের নিবন্ধন নেই। সেই সাথে তাদের ভোট ব্যাংক যা-ই থাকুক না কেন নির্বাচনে জয়-পরাজয় জামায়াতের ভোটের ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে সুইং ভোটারদের ওপর।

জোটের শরীক সংখ্যার একটা তাৎপর্য আছে বটে। কিন্তু জোটে কোনো দলের অংশীদারিত্বের ফলে যদি নামের চেয়ে বদনামই বেশি জোটে তবে সে দল থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। কিন্তু তারপরও বিএনপি কোনো এক অজানা জুজুর ভয়ে ও আশঙ্কায় জামায়াতকে নিয়েই নির্বাচনী বৈতরণি পার করতে চায়। তাই জামায়াত নেতারা দাঁড়িপাল্লা ছেড়ে এখন ধানের শীষ নিয়েই নির্বাচন করবে। এবারের নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপির জামায়াতকে ছাড়তে না পারা জামায়াতকে নিয়ে তাদের তৃতীয় ভুল। আর দ্বিতীয় ভুলটি ছিল জামায়াত নেতাদের মন্ত্রী করা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দেয়া, যে রাষ্ট্রের বিরোধীতা তার করেছে।

আওয়ামী লীগ জামায়াতকে আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করেনি সত্য। কিন্তু বাস্তবে জামায়াতকে অস্তিত্বহীন করতে বিএনপি এবার বড় একটি ভূমিকা পালন করতে পারতো। নিবন্ধন ও বিতর্কিত একটি দলকে জোট থেকে বাদ দিয়ে ভোটের সারথী না করলে বিএনপির ক্ষতির চাইতে লাভই বেশি হতো। কিন্তু বিএনপি সেই সুদূরপ্রসারী লাভের চেয়ে নগদেই বেশি বিশ্বাস করেছে।

এর কারণও আছে। গত এক দশকে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে অনেক দূর্বল হয়ে পড়েছে। এর পেছনে সরকারের কঠোরতা যতোটা দায়ী তার চেয়ে বিএনপির নিজের ব্যর্থতা কম দায়ী নয়। এ দূর্বলতা মাথায় রেখেই নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি যুগান্তকারী বা জামায়াত প্রশ্নে নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে সাহস পারেনি। হয়তো খালেদা ও তারেকহীন সমসাময়িক বিএনপিনেতৃত্ব এরকম একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে নিজেরাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না।

মনে রাখতে হবে সময়টি বিএনপি ও জামায়াত দুই দলের জন্যই অত্যন্ত খারাপ সময়। জামায়াতকে বাদ দিয়ে বিএনপি ভোটের মাঠ তথা রাজনীতির মাঠে কোনো রকম শক্তি খোয়াতে চায় না। জামায়াতকে ছাড়া বিএনপি ভোটে জিতলেও আওয়ামী লীগ যে তলে তলে জামায়াতের সাথে আতাত করবে না সেই আস্থা বিএনপির নেই। এছাড়া বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত যৌথভাবে যে বিএনপির জন্য কতবড় হুমকি তা তারা ভালো করেই জানে। ১৯৯৬ সালের আন্দোলনের কথা বিএনপির ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ফলে এ দুই বিরোধী শক্তিকে সামাল দেয়া বিএনপির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সেটা সরকারে থেকে হোক বা বাইরে হোক। আবার এখন বিএনপি যদি জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে ক্ষমতায় যেতে না পারে, সেটি বিএনপির জন্য আম-ছালা দুই-ই খোয়ানোর শামিল। কারণ, আন্দোলন ও জ্বালাও পোড়াও করতে জামায়াতের জুড়ি নেই। ফলে বিএনপিকে যদি বিরোধী দলেই থাকতে হয় তবে তার রাজনৈতিক রক্ত সঞ্চালন ঠিক-ঠাক রাখার জন্য জামায়াতের রক্তদান জরুরি। বিএনপির নামে মাঠে আসলে জামায়াতই আন্দোলন করে আসছে। কারণ, জামায়াতের আসল শত্রু আওয়ামী লীগ। বিএনপির কাছে আওয়ামী লীগ হচ্ছে রাজনৈতিক শত্রু, কিন্তু জামায়াতের কাছে আওয়ামী লীগ হচ্ছে জানি-দুশমন। শত্রুর শত্রু আমার বন্ধু; কাজেই বিএনপির কাছে জামায়াত হচ্ছে দুশমন দরদী। কাজেই দুই দলই এমন দু:সময়ে যদি একজন আরেকজনকে ছেড়ে যায় তবে তা চিরস্থায়ী ছাড়াছাড়িতে রূপ নিতে পারে। মনে রাখতে হবে, রাজনীতিতে শেষ বলে যেমন কিছু নেই এটা যেমন সত্য, কিন্তু অবিশ্বাস বাড়তে বাড়তে একসময় কেউ কাউকে আর বিশ্বাস করতে পারে না, সেটিও সত্য। যেকারণের এরশাদকে এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না। হয়তো তিনি নিজেও নিজেকে আর বিশ্বাস করেন না।

ইতিহাস বলে, বিএনপি প্রথমে জামায়াতকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে, পরে আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে তাদের প্রশ্রয় দিয়েছে।পরে বিএনপি জামায়াতকে আবার ক্ষমতার অংশীদারী করেছে। কিন্তু যা নাপাক তা নাপাকই। প্যান্টের পকেটে রাখলেও নাপাক, বুক পকেটে রাখলেও নাপাক। কিন্তু আমরা এভাবেই জামায়াতের মতো স্বাধীনতাবিরোধী ও সাম্প্রদায়িক শক্তির ক্ষমতায়নে পাপের ভাগীদার হয়েছি; কেউ কম, কেউ বেশি। একজন আরেকজনকে দায়ী করেছি, কিন্তু গোকুলে বেড়েছে জামায়াত।

সামনে নির্বাচন। ইতোমধ্যে সব দলই তাদের নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে। আওয়ামী লীগ বলেছে, তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করেছে। কিন্তু দেশে কি আর যুদ্ধাপরাধী নেই? সেটা গবেষণার বিষয়। যেহেতু তারা বলছে, সম্পন্ন হয়েছে তার মানে যুদ্ধাপরাধী আরও থাকলেও তাদের আর বিচার করবে না। ফলে, আগামীতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার এজেন্ডা এবারের আওয়ামী লীগের ইশতেহারে নেই।

বিএনপি বরাবরই বলে আসছিল যে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অব্যাহত রাখবে। মান নিয়ে তাদের প্রশ্ন ছিল। তারা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী বিচার করার কথা বারবারই বলেছে। কিন্তু এসবই ছিল তাদের রাজনৈতিক বক্তব্যমাত্র; কোনো প্রতিশ্রুতি নয়। তাই আমরা দেখি, এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে বিএনপি কোনো কথা বলেনি। হয়তো এখানেও জামায়াতকে তারা আর চটাতে চাননি।

ঐক্যফ্রন্ট বলেছে, তারা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচার করবে। এর ভালো-মন্দ দুটি দিকই আছে। যুদ্ধাপরাধীরা আসলে বিদ্যমান আইনানুযায়ী মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীই। বিদ্যামান আইনটিও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ আইন। কিন্তু মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের ব্যাপ্তি আরো ব্যাপক। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা থেকে উৎসারিত হত্যাকাণ্ডসহ আরো নানা হত্যাকাণ্ড এর অন্তর্ভূক্ত। ফলে ব্যাপকতা বাড়াতে গিয়ে আসল যুদ্ধাপরাধীদের যাতে আড়াল করা না হয় সেটিই দেখার বিষয়। কারণ, একাত্তরের অপরাধীদের বিচার করা এক জিনিস আর একাত্তরের পরের রাজনৈতিক অপরাধীদের বিচার আরেক জিনিস। দুটিই ভালো; কিন্তু একটা বাদ দিয়ে আরেকটা না। শুরুতেই গলদ থাকলে পরে তা ঠিক করা আর না করা সমান কথা। গোড়া কেটে আগায় জল ঢেলে লাভ নেই।

আসলে জামায়াত একটি রোগের নাম। এই রোগে জামায়াত রোগী হলেও অসুখ অনেকেরই। এই অসুখ সারাতে হলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব শক্তিকে এক হতে হবে। রাজনৈতিক সুবিধাবাদীতা দিয়ে এটি হবে না; প্রয়োজন আদর্শিক ও নৈতিক অবস্থান।

এরশাদুল আলম প্রিন্স: কন্ট্রিবিউটিং এডিটর বার্তা২৪, আইনজীবী ও কলামিস্ট