কিছু তর্ক হচ্ছে রাজনৈতিক পরিসরে। একটি হলো এই যে, আগে সংস্কার নাকি নির্বাচন? আরেকটি হলো, সংস্কার শেষ করবে কে? বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নাকি পরবর্তী নির্বাচিত সরকার? সরকার ও নির্বাচনের মধ্যে সমন্বয় হবে কেমন করে?
এসব তর্ক-বিতর্কের কারণ হলো, পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার ওপর বর্তমান বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে। এত বছর জনগণের কোনো অধিকার ছিল না। আমাদের লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক দেশ হওয়ার। কিন্তু আমরা তা করতে পারিনি। দেশ এখনো অস্থিরতার মধ্যে আছে। কিন্তু সম্ভাবনাও আছে। এছাড়া ২৪-এর অভ্যুত্থানের পর নতুন যাত্রার শুরু থেকে জনগণ হতাশা ও আশঙ্কায় ভুগছে। সংস্কার আগে নাকি নির্বাচন, তা নিয়ে জনগণ শঙ্কায় আছে। তবে আশার কথা হলো, আমরা এখন কিছুটা হলেও স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারি।
বলার অপেক্ষা রাখে না, জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে সংস্কারকে এড়িয়ে নিছক একটি নির্বাচন অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়। আবার নির্বাচনকে অনিশ্চিত রাখাও কাম্য নয়। ফলে সংস্কার ও নির্বাচনের মধ্যে একটি সুসমন্বিত যোগসূত্র খুবই জরুরি বিষয়। এমতাবস্থায় অন্তবর্তীকালীন সরকারকে কমপক্ষে ৩ বছর সময় দেয়া দাবি উত্থাপিত হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ‘শ্বেতপত্র প্রকাশই শেষ কথা নয়, সুপারিশ বাস্তবায়ন জরুরি’ শীর্ষক এক সেমিনার থেকে দাবিটি উচ্চারিত হয়েছে। যে সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন বিপুল সংখ্যক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। এতে, বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারকে জাতীয় সরকারে রূপান্তর করে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংষ্কারের জন্য কমপক্ষে ৩ বছর সময় দেয়ার দাবি জানান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ও চবি উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান।
মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) বেলা ১১ টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট মিলনায়তনে চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি) আয়োজিত ‘শ্বেতপত্র প্রকাশই শেষ কথা নয়, সুপারিশ বাস্তবায়ন জরুরি’ শীর্ষক মুক্ত সংলাপে উপস্থিত ছিলেন অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. এ কে এনামুল হক। সভাপতিত্ব করেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি ও সিসিআরএসবিডির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ।
অন্তবর্তীকালীন সরকারকে জাতীয় সরকারে রূপান্তরের দাবি নতুন নয়। কারণ, রাজনৈতিক সরকার বহু কমিশন কমিশন গঠন করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলোর রিপোর্ট আলোর মুখ দেখেনি এবং বাস্তবায়নও হয়নি। সরকার বা দায়িত্বশীলরা শুধু দিন গোনে, কখন সময় শেষ হবে, রিপোর্ট জমা দিবে এবং তা বস্তাবন্দি করবে। আসলে এ দেশটাকে কিছু দেওয়ার জন্য সহজে কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। একটি জাতীয় সরকারকে এই দায়িত্ব নিতে হবে। এজন্য, সকল দুর্নীতি তদন্তে ও সুপারিশমালা বাস্তবায়নে সৎ, সাহসী ও দেশপ্রেমিক মানুষ দরকার।
তাছাড়া, অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির রিপোর্টে উল্লিখিত সুপারিশসমূহ জনসম্মুখে প্রকাশ ও বাস্তায়নের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দুদককে শক্তিশালী করার বিষয়টি রাজনৈতিক সরকারের চেয়ে অন্তর্বর্তীকালীন বা জাতীয় সরকার অধিকতর সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারবে।
বিগত অতীতে দেশের ব্যাংকিং সেক্টর ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের হাতে চলে গিয়েছিল, যার কারণে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। কেউই আর ব্যাংক লুট দেখতে চায় না, দুর্নীতি দমনে শুদ্ধাচার চায়, চায় যথাযথভাবে সংস্কার কার্যকর করার মাধ্যমে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে।
শুধু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন না দেখে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে অংশগ্রহণমূলক জাতীয় সরকার গঠন করার বিষয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। এ ব্যাপারে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধানকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্তবর্তীকালীন সরকারকে ৩ বছর ক্ষমতায় থেকে সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার পর নির্বাচন আয়োজনের যে আহবান জানানো হয়েছে, তা নতুন বাংলাদেশকে সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারবে বলে আশা করা যায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির সদস্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. এ কে এনামুল হক বলেন, শ্বেতপত্র প্রস্তুত করতে গিয়ে ২৮ ধরনের দুর্নীতির চিত্র পাওয়া গেছে। তিনি পেশকৃত রিপোর্টের দ্রুত বাস্তবায়ন ও জাতিকে জানাতে পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করার জন্য বর্তমান সরকারকে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, ২০২২ সালে সরকারের বিভিন্ন আর্থিক খাতে ২২ হাজারেরও অধিক অডিট আপত্তি দেয়া হয়েছে। দেশ অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হয়েছে। সবাই দুর্নীতির কৌশল শিখে গেছে। পাবলিক ফান্ডের দায়ভার না নেয়া, আগে তথ্য দেয়া, তথ্য লুকানো ও হঠাৎ ডকুমেন্ট লাগবে বলে বিনিয়োগকারীদের বিপদে ফেলা ইত্যাদি নানা উপায় দুর্নীতি করা হয়ে থাকে। অধিকাংশ দুর্নীতিতে সরকারি কর্মকর্তারা জড়িত। তারপরই রাজনীতিবিদদের অবস্থান।
প্রফেসর এনামুল হক বলেন, কৃষি খামার করে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। যারা প্রকৃত হকদার, সে সকল কৃষক ও গরীব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক সময় মাস্টার প্লানও বদলানো হয়েছে। পণ্যের দাম বাড়িয়ে কমিশন বাণিজ্য করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, দেশটাকে বদলাতে চাইলে সবাইকে নিয়েই বদলাতে হবে। সিস্টেম সংশোধন করতে হবে। ডাইরেক্ট ট্যাক্স বাড়ালেও দুর্নীতি কমানো যায়।
তিনি আরও বলেন, ৫০ হাজার ট্রাক্টর আনা হয়েছে। কিন্তু যাদের জন্য এ ট্রাক্টর আনা হয়েছিল সে দরিদ্র চাষীরা তা পায়নি। দেশের এমপি, মন্ত্রীরা চাষী নাম দিয়ে তা নামে-বেনামে গ্রহণ করেছে। টাকা লোপাটের ৪৫ শতাংশ সামরিক ও বেসামরিক আমলাদের পকেটে গেছে। আইসিটিতে প্রচুর দুর্নীতি হয়েছে কিন্তু তা দেখা যায়নি। দুর্নীতি দমন করতে নিচ থেকে ধরতে হবে। দুর্নীতি দমনের ব্যাপারে গবেষকরা যত চিন্তা করবেন, দেশের জন্য তত মঙ্গল হবে।
শ্বেতপত্র নিয়ে আজকের সংলাপ যথেষ্ট নয় উল্লেখ করে চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ এর নির্বাহী পরিচালক ও রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মাহফুজ পারভেজ বলেন, শ্বেতপত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর সুপারিশমালার দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। তিনি বলেন, বিগত সরকারের দলীয় নেতারা বিভিন্ন সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে চাঁদাবাজি করেছে। এখন শুধুমাত্র সাইনবোর্ড পাল্টানো হয়েছে কিন্তু চাঁদাবাজি রয়েই গেছে। এর পেছনে জড়িতদের খুঁজে বের করতে হবে। তিনি রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকদের সম্পর্ক বাড়ানোর পরামর্শ দেন। তিনি বৈষম্যবিরোধী চেতনা ধরে রাখতে রাজনৈতিক, আইনগত এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করতে শিক্ষার্থীদের যথাযথভাবে কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে দুদক'কে শক্তিশালী ও স্বাধীনভাবে কাজ করার বিষয়ে তাগিদ দেন তিন।
প্যানেল আলোচক চবি রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা একটা সুন্দর স্বপ্নের মাঝে বেঁচে আছি। দীর্ঘ ১৫ বছর দেশে দমন-নিপীড়ন করেছিল বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার। এ ফ্যাসিবাদী দানব যেন আর ফিরে না আসে, সেজন্য আমাদের সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। ফ্যাসিবাদমুক্ত রাষ্ট্র উপহার দেওয়ার জন্য ছাত্রসহ যারা রক্ত দিয়েছেন, সংগ্রাম করেছেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিবাদী শক্তি পালানোর পর এদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি রেখে গেছেন। তিনি বলেন, দুর্নীতি অনেক ধরনের হয়েছে কিন্তু বিদেশে নিজের ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালানোর দুর্নীতি শুনে আশ্চর্য্য হয়ে গেলাম। এমন দুর্নীতি কি মানুষ করতে পারে?
এসময় তিনি দশটি পয়েন্ট উল্লেখ করে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং বর্তমান সরকারকে তাড়াহুড়া না করে সংস্কার কাজ শেষ করে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরীর আহ্বান জানান। এজন্য তিনি কমপক্ষে তিন বছর সময় দেয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন বিগত সরকারের আমলে দেশের শেয়ার বাজারসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়ে বিদেশে কোটি কোটি টাকা পাচার করেছে। এটা জাতির কাছে একদিন জবাবদিহি করতে হবে। তিনি আরও বলেন বিগত ফ্যাসিবাদী সরকার শেষ পর্যন্ত এদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে এ দেশ থেকে পালিয়ে গেছে।
প্যানেল আলোচক চবি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোঃ এনায়েত উল্যা পাটওয়ারী বলেন, 'এ সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। সরকারের বিভিন্ন সংস্কার কমিশনগুলো যে রিপোর্ট এবং সুপারিশ প্রদান করছে তার দ্রুত বাস্তবায়ন চান তিনি। তিনি বলেন, এখনো অনেক বড় বড় কর্মকর্তা পদ ধরে আছেন, তাদেরকেও ধরতে হবে। তিনি বর্তমান সরকারকে সময় দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিপ্লবী সরকার ছাড়া এত সংস্কার করা খুবই কঠিন হবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় সনদে স্বাক্ষর করে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের বিবেককে জাগ্রত করতে হবে এবং আল্লাহর ভয় অন্তরে ধারণ করতে হবে। তিনি সকল দুর্নীতির তথ্য পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান। একইসাথে বিপ্লবের মূল চেতনা বৈষম্যবিরোধী নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।
প্যানেল আলোচক ও প্রভোস্ট প্রফেসর ড. বেগম ইসমত আরা হক বলেন, নতুন বাংলাদেশ অর্জনের পর ৪০০ পৃষ্ঠায় ২৮টি বিষয়ে বিগত সরকারের দুর্নীতির চিত্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। তিনি অর্থনীতি বিষয়ক শ্বেতপত্র জাতির সম্মুখে প্রকাশের জন্য সরকারের নিকট দাবি জানান। তিনি বলেন, বিভিন্ন সংষ্কার কমিটির সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারলে দেশ আরও সংকটে পড়বে। বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় লুটপাট, চাঁদাবাজি হচ্ছে। সরকারকে অতিসত্বর কঠোর হস্তে এগুলো বন্ধ করতে হবে।
বিগত সরকার ডাটা ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়কে আড়াল করেছে। সরকার প্রদত্ত ডাটা এক, কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম বলে মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর। আরেকজন শিক্ষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত দুর্নীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ ও দোষীদের শাস্তি দাবি করেন। কয়েকজন শিক্ষার্থী সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
সংলাপে বলা হয়, এ দেশে ব্রিটিশরা জনপ্রশাসন তৈরি করেছে। সেখানে দক্ষ লোক নিয়োগ দেওয়া হতো। তাদের কাজ ছিল ব্রিটিশদের রাজত্ব স্থায়ী করা। তাদের উত্তরাধিকার এখনো আমরা দেখতে পাই। আমাদের দেশে যে উদ্দেশ্য নিয়ে জনপ্রশাসন তৈরি করা হয়েছে, তা এখনো পূরণ করতে পারেনি। কারণ, আমাদের প্রশাসনে এখনো দালালি স্বভাব আছে। আমাদের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতা থাকতে হবে। এটি কেবল প্রশাসনের মধ্যে থাকবে না। কেন্দ্রীভূতকরণ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করা যাবে না।
এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রশাসনে মেধাভিত্তিক নিয়োগ বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের পচন সেখান থেকেই শুরু। কখনো এটি একটু ঠিক করা হলেও পরে তা আবার নষ্ট করে দেয়। আসলে জনপ্রশাসনের ইতিহাসে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। সময়ের সঙ্গে জনগণের সব জায়গায় প্রশাসন যুক্ত। সরকারি প্রশাসনের কাজগুলো ঠিক করে দিতে হবে। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। এই দেশে প্রতিটি সরকার প্রশাসনের পরিবর্তনের জন্য কমিশন করেছে; কিন্তু এর প্রয়োগ কখনো হয়নি। এজন্য, জনপ্রশাসনের পুনর্গঠন দরকার। কারণ, আমদের ঔপনিবেশিকব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এর বিরুদ্ধে গণ-ঐকমত্য তৈরি করতে হবে। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত হলো জনপ্রশাসন, এরপর রাজনীতিকরা। তথ্য বলছে, একজন আমলা একটি সই দিয়ে যেই পরিমাণ সম্পদের মালিক হতে পারেন, একজন কৃষকের চৌদ্দ পূর্বপুরুষ একটি টিপসই দিলেও এত সম্পদের মালিক হতে পারবে না। আমলার সীমাবদ্ধতা আছে, কারণ সে মানুষ। কিন্তু আমলাতন্ত্রের সীমাবদ্ধতা নেই।
অনেকে রাজনীতিবিদদের দাপট, দখলধারী এবং আমলাতন্ত্রের বাড়-বাড়ন্ত দেখে বলছেন, যেই স্পিরিট নিয়ে জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছে, তা আমরা ধরে রাখতে পারিনি। এখানে সুযোগ ছিল অভ্যুত্থানকে বিপ্লবে পরিণত করার। সচিব ও জনপ্রশাসনদের জিজ্ঞাসা করা দরকার স্বৈরাচারকে এত বছর ক্ষমতায় কেন রেখেছেন তারা। জনপ্রশাসনে যারা ফ্যাসিবাদীকে ক্ষমতায় রাখার জন্য সাহায্য করেছেন, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা, যেন ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদ আর তৈরি না হয়।
অতএব, দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের আহ্বান বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। কর্তৃত্ববাদী শক্তির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে একটি সুশাসিত, অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যমুক্ত স্বদেশ বিনির্মাণের যে সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সেই সুযোগকে বাস্তবে রূপ দিতে সরকার, রাজনৈতিক দল, জনসাধারণ ও তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে শিক্ষার্থীসহ সকলের দায়িত্ব রয়েছে। দেশের স্বাধিকার থেকে শুরু করে সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র দেশ যেভাবে একসঙ্গে লড়েছে, একটি সুশাসিত ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সেই বন্ধন যেন সুদৃঢ় ও অটুট থাকে, সেই প্রত্যাশা সমগ্র জাতির।
চরম স্বেচ্ছাচারী শাসন কাঠামোতে সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতিতে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছিল। দুদকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে দুর্নীতির সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে, সাধারণ জনগণ জিম্মি হয়ে দুর্নীতিকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এরকম বাস্তবতায়, সম্প্রতি দুদকে নতুন চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। তাই শুধু নেতৃত্বের পরিবর্তন নয়, বরং প্রতিষ্ঠানটিকে জনবান্ধব ও দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য সম্পূর্ণরূপে ঢেলে সাজাতে হবে।
তা অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হলো, কর্তৃত্ববাদের বিদায়ের মধ্য দিয়ে জনমনে মুক্ত গণমাধ্যম এবং স্বাধীন ও অসংকোচ মত প্রকাশের যে প্রত্যাশার সঞ্চার হয়েছে, তা পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সকলেই যাতে চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা করতে পারে, তার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ। বিগত কর্তৃত্ববাদী শাসন কাঠামোর ন্যায় স্বাধীন মত ও সাংবাদিকতার কারণে কেউ যেন হয়রানি, দোসর আখ্যায়িত বা ট্যাগিং এর শিকার না হয়, সে ব্যাপারে সকলকে উদার ও সহিষ্ণু আচরণ করার আহ্বান জানান তারা।
কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ বিনির্মাণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ খাতসমূহ সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১১টি কমিশন গঠন করেছে। তবে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা চিরস্থায়ী করণের অপপ্রয়াস থেকে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, বহুমুখী দুর্বৃত্তায়ন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির যেভাবে বিস্তার ঘটানো হয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে সকল সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনভাবে কাজ করার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সদস্যদের নিয়োগে দলীয়করণ বন্ধ করতে সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও অযোগ্যতার শর্ত অন্তর্ভুক্ত ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংস্কার করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষায় বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ ক্ষমতায়িত নিজস্ব সচিবালয় স্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে যুগোপযোগী শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করাও জরুরি।
এজন্য, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষায় সকল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে হবে। সর্বোপরি সার্বিক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ প্রণয়ন করা দরকার, যাতে করে পরবর্তী সময়েও সংস্কার কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে না পড়ে এবং এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলসমূহকেও অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া অপরিহার্য। আমরা বিশ্বাস করি, শুধু রাজনৈতিক চাপ দেশ শাসনের শেষ কথা হতে পারে না। এতে নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, শিক্ষার্থী সমাজের আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলনও জরুরি।
লেখক ও কলামিস্ট।