আমার বন্ধু জামিলুর রেজা চৌধুরী

  • মুহাম্মদ ইউনূস
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

জামিলুর রেজা চৌধুরী ও মুহাম্মদ ইউনূস

জামিলুর রেজা চৌধুরী ও মুহাম্মদ ইউনূস

অনেক ব্যস্ততার মধ্যে দিন শুরু হয়েছিল। আগামীকাল আমাদের নির্মাণ সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির মিটিং। দেশের নামকরা অনেক স্থপতি ও প্রকৌশলী এই কমিটির সদস্য। তাদের সবাইকে একত্রে পাওয়া আমাদের সৌভাগ্যের ব্যাপার। প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী এদের সকলের শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তিনি কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি মিটিংয়ের সকল নথিপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন। এটা তার সারাজীবনের অভ্যাস। খুঁটিনাটি কোনো বিষয়ই তার চোখ এড়ানোর উপায় নেই। গতকাল আশরাফকে (আশরাফুল হাসান), যিনি আমাদের সকল নির্মাণ প্রকল্পের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি, তিনি ডাকিয়ে নিয়েছিলেন নথিপত্রের আরও কিছু ব্যাখ্যা নেবার জন্য।

সকল ব্যস্ততা হঠাৎ থেমে গেলো। অবিশ্বাস্য এক খবর এসে সবাইকে চুরমার করে দিলো। জামিলুর রেজা আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। আমাদের কর্মকাণ্ডে তিনি এমন এক ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত ছিলেন যে তাঁকে ছাড়া আমরা আমাদেরকে ভাবতেই পারছিলাম না। এরকম একটা সংবাদ কীভাবে সম্ভব! এটা আমরা কীভাবে গ্রহণ করবো। মাথায় কিছুই কাজ করছিল না।

বিজ্ঞাপন

তাঁর সম্বন্ধে অনেক কথাই শুনেছিলাম ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি আমেরিকায় শিক্ষকতার পেশায় ইস্তফা দিয়ে দেশে ফিরে আসছিলাম। ১৯৭২ সালের জুন মাস। ফেরার পথে আমার ভাই ইব্রাহীমের সঙ্গে দেখা করে যাবো বলে সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। সেখানে সবার কাছে জামিলুর রেজার নানা গল্প শুনেছিলাম। কয়েক বছর আগে তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে দেশে ফিরে গেছেন। কে জানতো এই ব্যক্তির প্রতি আমার অনুভূতি একদিন গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হবে— সারা জীবন ধরে এই বন্ধুত্ব গভীরতর হবে।

গ্রামীণ ব্যাংকের ষোলো সিদ্ধান্তের একটা সিদ্ধান্ত ছিল ‘ভাঙা ঘরে থাকবো না, ভাঙা ঘর তাড়াতাড়ি মেরামত করবো। এবং যত শিগগিরই সম্ভব নতুন ঘর তুলবো।’ বিরাট এক সিদ্ধান্ত। ১৯৮৭ সালে প্রথমে চারটি খুঁটি তৈরি করার জন্য ঋণ দিলাম। আমরা ছোট প্রতিষ্ঠান। সদ্য পাশ করা একজন ইঞ্জিনিয়ার নিয়েছিলাম আমাদের প্রযুক্তিগত বিষয়গুলির দিকে নজর রাখার জন্য। সেই হলো আশরাফ। প্রথমে নানারকম খুঁটিনাটি কাজে তাকে ব্যস্ত রাখা হতো। খুঁটি বানানোর কাজে তার ডাক পড়লো। আমাদের সকল শর্ত পূরণ করে একটি মজবুত সস্তা খুঁটি বানানোর জন্য সোৎসাহে আশরাফ কাজে লেগে গেলো। একাজে আশরাফ জামিলুর রেজার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। ক্রমে ক্রমে আশরাফেরও কাজ বাড়লো আর জামিলুর রেজাও আমাদের সকল কর্মে জড়িয়ে গেলেন। খুঁটি থেকে আমরা পূর্ণাঙ্গ গৃহঋণ দেবার কাজে অগ্রসর হলাম। বারো হাজার টাকার গৃহঋণ। ১৯৮৯ সালে আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার পেলো গ্রামীণ ব্যাংক এই গৃহঋণ কর্মসূচি ও গৃহঋণের ডিজাইনের জন্য। আমরা মহাখুশি।

বিজ্ঞাপন

জামিলুর রেজার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ল ১৯৯৩ সালে বুয়েটের সমাবর্তন বক্তৃতাকে কেন্দ্র করে। সে বছর বুয়েট আমাকে আমন্ত্রণ জানাল তাদের সমাবর্তন বক্তৃতা দেবার জন্য। সেই সমাবর্তন বক্তৃতায় আমাদের গৃহঋণ কর্মসূচির কথাও বললাম। সেখানে এবং অন্যান্য অনেক কাজে প্রকৌশলীদের ভূমিকার কথা বললাম। বক্তৃতার শিরোনাম দিলাম ‘পথের বাধা সরিয়ে দিন, মানুষকে এগুতে দিন’। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে সরকারের সমালোচনা করায় কেউ কেউ উষ্মা প্রকাশ করলেন। কিন্তু শিক্ষক-ছাত্ররা আমার বক্তব্য পছন্দ করল। জামিলুর রেজা আমার বক্তব্যগুলোকে গভীরভাবে সমর্থন করলেন।

গ্রামীণ ব্যাংকের শুরু থেকে এতে কম্পিউটার ব্যবহারের চেষ্টা চালাচ্ছিলাম। জামিলুর রেজার কাছে সবসময় পরামর্শ নিচ্ছিলাম কী করা যায়। ইন্টারনেট চালু করার ব্যাপারে প্রযুক্তিগত কাঠামো ছিল না। ঢাকা থেকে কোথাও ই-মেইল করতে হলে তখন ই-মেইলগুলো একত্র করে সিঙ্গাপুরে পাঠাতে হতো। তাৎক্ষণিকভাবে পাঠাবার ব্যবস্থা তখনো সৃষ্টি হয়নি। সব মেইল একত্র করে এক এক দফায় সিঙ্গাপুরে পাঠাতাম। সারাদিনে দুবার পাঠানো যেতো। কম্পিউটার কিনতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হতো। অনুমতি নেওয়াটাও একটা জটিল ব্যাপার ছিল। ফ্যাক্স মেশিন কিনতে হলে সরকারের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। আমরা সরকারের অনুমতি নেওয়ার ব্যাপারটাতে ঘোরতর আপত্তি জানিয়ে আসছিলাম। জামিলুর রেজা সরকারের সমস্ত ব্যাখ্যাকে যুক্তিহীন প্রমাণ করলেন। সরকার নিয়ম পাল্টাল না, তবে নিয়মগুলো পালনের ব্যাপারে কড়াকড়ি করা থেকে বিরত হলো।

১৯৯৬ সালে তত্বাবধায়ক সরকার হলো। আমি এবং জামিলুর রেজা একই সঙ্গে এই সরকারে কাজ করার সুযোগ পেলাম। আমরা ভাবলাম যে এই সুযোগে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট বাবদ যত প্রতিবন্ধকতা সরকার সৃষ্টি করে রেখেছে সেগুলি বাতিল করে তার জায়গায় কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের ব্যবহার সহজ করার আইনি কাঠামো তৈরি করে ফেলতে হবে।

১৯৯৭ সালে গ্রামীণ কমিউনিকেশনস প্রতিষ্ঠা করলাম- কম্পিউটারাইজেশন, ইন্টারনেটকে বহুলভাবে সম্প্রসারিত করার জন্য। শুরু থেকেই জামিলুর রেজা এর বোর্ডের সদস্য থাকলেন। ধরে নিয়েছিলাম যে, তার হাজারো ব্যস্ততার মাঝে তাকে হয়তো কখনো-সখনো বোর্ড মিটিংয়ে উপস্থিত পাব। আশ্চর্য হলাম- তিনি প্রতিটি মিটিংয়ে শুধু উপস্থিত থাকলেনই নয়, প্রতিটি বিষয়ের খুঁটিনাটি বিষয়ে তার মতামত ও পরামর্শ দিচ্ছেন। আমাদের ছোট ছোট কর্মসূচির সঙ্গে তিনি বিশেষ আগ্রহ নিয়ে যুক্ত হয়ে যাচ্ছেন। একটা উদাহরণ দেই: আমরা ঢাকার সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ইন্টারনেট সংযোগ করতে পারলেও দেশের ভেতর কোথাও ইন্টারনেট সংযোগ করতে পারছিলাম না। গ্রামীণ কমিউনিকেশনসের এমডি নাজনীন প্রস্তাব দিল আমরা পরীক্ষামূলক একটা প্রকল্প নিতে পারি। জামিলুর রেজা সোৎসাহে এতে মেতে গেলেন। ১৯৯৮ সালে আমাদের এই উদ্যোগ শুরু হলো। ঢাকার সঙ্গে কানেক্টিভিটি স্থাপন করতেই হবে। জামিলুর রেজা বিভিন্ন পরিকল্পনা দিতে থাকলেন। সিদ্ধান্ত হলো টাঙ্গাইলের মির্জাপুর ও মধুপুরে ভিলেজ ইন্টারনেট ও কম্পিউটার সেন্টার স্থাপন করা হবে এবং এই সেন্টারগুলোর সঙ্গে ঢাকার ইন্টারনেট সংযোগ থাকবে। এই প্রকল্পের কাজ নিয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে গেলেন। এর অগ্রগতি দেখার জন্য তিনি মির্জাপুর ও মধুপুর গেলেন। শেষ পর্যন্ত ইন্টারনেট সংযোগ সফল হলো। স্থানীয় লোক এই সেন্টারে এসে ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ করা আরম্ভ করল। তিনি রাড্ডা বারননের বোর্ডে ছিলেন। তাদের পরামর্শ দিলেন তাদের আউটডোর রোগী ব্যবস্থাপনার উন্নতির জন্য একটা সফটওয়্যার তৈরি করতে। পরামর্শ দিয়েই তার কাজ শেষ করেননি। তিনি গ্রামীণ কমিউনিকেশনসকে দায়িত্ব দিলেন সেই সফটওয়্যার তৈরি করার জন্য। তার সঙ্গে পরামর্শ দিলেন এই সফটওয়্যার কীভাবে তৈরি করতে হবে। শেষ পর্যন্ত একটি চমৎকার সফটওয়্যার তৈরি করিয়ে দিয়েছেন।

প্রযুক্তির ব্যাপারে তাঁর আগ্রহের কোনো সীমা ছিল না। ১৯৯৭ সালে গ্রামীণফোন কার্যক্রম শুরু হবার পর থেকে মোবাইল ফোনের সম্ভাবনা নিয়ে অত্যন্ত উৎসাহী হয়ে পড়লেন। প্রতিনিয়ত আমাদের পরামর্শ দিচ্ছিলেন এর সাম্প্রতিক ব্যবহার কী হতে পারে। আমরা যখন তাঁকে গ্রামীণফোনের বোর্ড মেম্বার হবার জন্য অনুরোধ করলাম তিনি সোৎসাহে রাজি হয়ে গেলেন। বরাবরের মত এই বিশাল প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় নথি অতি সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা না-করে তিনি কোনোদিন বোর্ড মিটিং-এ উপস্থিত হননি। গ্রামীণফোনের মত প্রযুক্তি ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় তিনি তাঁর মেধার অসামান্য পরিচয় রেখে গেছেন। শুধু মৃত্যু এসে তাঁর এই একনিষ্ট ভূমিকায় ছেদ টেনে দিয়ে গেলো।

ক্রমে ক্রমে আশরাফের কাজের পরিধি বাড়ল। আশরাফকে কেন্দ্র করে প্রকৌশল বিভাগ সৃষ্টি হলো। গ্রামীণ ব্যাংক খুঁটি নির্মাণ থেকে টয়লেট নির্মাণ, শাখা অফিস নির্মাণের কর্মকাণ্ড থেকে আরও বড় রকমের নির্মাণ কাজে নেমে গেল। অন্যদিকে, জামিলুর রেজাও দেশব্যাপী জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের মধ্যমণি হয়ে পড়লেন। কিন্তু সবকিছু সত্ত্বেও জামিলুর রেজা আমাদের থেকে দূরে সরে যাননি বরং আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করেছেন।

আমাদের অবকাঠামো নির্মাণ ক্রমেই বড় হতে থাকল। গাইড করার জন্য জামিলুর রেজা সবসময় সঙ্গে থাকলেন। অবকাঠামো নির্মাণকে সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য তাকে নিয়ে আমরা কমিটি করলাম। নাম দিলাম ‘উচ্চ পর্যায়ের কমিটি’। সে কমিটি অবকাঠামো নির্মাণের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কমিটি হিসেবে কাজ করতে থাকল।

প্রথমে শাখা অফিস ও এরিয়া অফিস নির্মাণের কাজ দিয়ে শুরু হলো এর কর্মকাণ্ড। পরে আসলো প্রধান কার্যালয় নির্মাণের কাজ। প্রথম পর্বে তিনটি পাঁচতলা ভবন নির্মাণের কাজ। দ্বিতীয় পর্বে একটি ২২তলা ভবন নির্মাণ। বাইশ তলা ভবন নির্মাণে তিনি গভীরভাবে যুক্ত হয়ে গেলেন- বহুতল ভবন নির্মাণের ব্যাপারে তার ব্যক্তিগত ইন্টেলেকচুয়াল আগ্রহের কারণে। সেটা আরও গভীরতর হলো একটা প্রযুক্তিগত বিতর্ককে কেন্দ্র করে। ২২তলা ভবনের ডিজাইনকে নিয়ে। কনসালটেন্ট কোনোভাবেই ভবনটি পাইল ফাউন্ডেশন ছাড়া নির্মাণ করতে দেবেন না। আর আমাদের প্রকৌশল বিভাগের তরুণ প্রকৌশলীরা মত দিচ্ছে এটা ম্যাট ফাউন্ডেশনের ওপর অবশ্যই করা যায় এবং এতে নির্মাণ ব্যয় অনেক কম হবে। এই দ্বন্দ্ব গড়াল দু’বছর ধরে। নানা যুক্তি, পাল্টা যুক্তি আসলো। জামিলুর রেজার নেতৃত্বে নানাভাবে সয়েল টেস্ট করা হলো। অবশেষে তার দৃঢ় সমর্থনে সিদ্ধান্ত হলো এটা ম্যাট ফাউন্ডেশনের ওপর নির্মাণ করা হবে। এর জন্য ম্যাট ফাউন্ডেশনের নতুন একটি প্রযুক্তি ব্যবহার হলো, যেটা এর আগে বাংলাদেশে কেউ ব্যবহার করে দেখেনি। জামিলুর রেজা প্রতিনিয়ত এই নির্মাণের তদারক করেছেন যেন কোথাও এর কোনো ত্রুটি না থাকে। এই ভবন নির্মাণে প্রতিষ্ঠানের বিপুল অংকের অর্থ সাশ্রয় হয়েছে। এই ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে নির্মাণ ব্যয় হয়েছে মাত্র ৮০০ টাকা! এত কম খরচে এ পর্যন্ত কেউ বহুতল ভবন বাংলাদেশে নির্মাণ করতে পারেনি।

আমাদের কর্মসূচি বিস্তৃত হয়েছে। বহুরকমের নির্মাণ কাজ আমরা হাতে নিয়েছি। জামিলুর রেজার সমর্থন ও পরামর্শের আওতা তার সঙ্গে বিস্তৃত হয়েছে। তার মৃত্যুর আগের দিনও তিনি আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন এবং পরের দিন মিটিংয়ে থাকা নিশ্চিত করেছেন। এগুলোর মধ্যে ছিল ১৩তলা টেলিকম ভবন নির্মাণ। চিড়িয়াখানা রোডে অবস্থিত এটি একটি অত্যাধুনিক ভবন। তিনি এই ভবনের স্থপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত জুরি বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। ভবন নির্মাণের সকল পর্যায়ে উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে প্রতিনিয়ত এর নির্মাণ কাজে পরামর্শ দিয়ে গেছেন।

আমাদের সর্ববৃহৎ নির্মাণ কাজটি তার হাতে শুরু হয়েছে। প্রথম পর্বে এক হাজার ছাত্র-ছাত্রীর জন্য একটি আধুনিক নার্সিং কলেজ নির্মাণ (গ্রামীণ ক্যালিডোনিয়ান কলেজ অব নার্সিং)। একাডেমিক ভবনের সঙ্গে সাতশ ছাত্রীর জন্য ডরমিটরি নির্মাণ। প্রথম পর্বের সমগ্র প্রকল্পের পূর্ণাঙ্গ মাস্টার প্ল্যান ও ভবনের ডিজাইন- ডিজাইন কম্পিটিশন IAB-এর মাধ্যমে আয়োজন করা হয়। যথারীতি জামিলুর রেজা গভীর নিষ্ঠা নিয়ে, প্রচুর সময় দিয়ে, সকলের পূর্ণ আস্থা নিয়ে জুরি বোর্ডের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথম পর্বের কাজ শেষ হয়েছে। নার্সিং কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। এই এপ্রিল মাসে নার্সিং কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা এবং অধ্যাপকবৃন্দ এই নতুন ভবনে প্রবেশ করবে। জামিলুর রেজার মৃত্যুর এক বছর পর তার বিরামহীন পরামর্শে নির্মিত ভবনে তারা শিক্ষা গ্রহণ শুরু করবে। অন্যান্য স্থানে নির্মিত সব ভবনে আমরা তাকে নিয়ে প্রবেশ করেছি। আমাদের দুর্ভাগ্য নার্সিং কলেজে আমরা তাকে নিয়ে ঢুকতে পারলাম না।

নার্সিং কলেজের পাশে দ্বিতীয় পর্বের কাজটিও অগ্রসর হচ্ছে। এই পর্বে থাকছে পাঁচশ বেডের হাসপাতাল, ৫০০ সিটের মেডিকেল কলেজ এবং হেলথ টেকনোলজি ইনস্টিটিউট। এই পর্বের ডিজাইনের জন্য দেশি-বিদেশি কনসালটেন্টদের মধ্য থেকে কনসালটেন্ট বাছাই চূড়ান্ত করা ও নিয়োগ করার প্রক্রিয়ায় তিনি তার মেধা ও ধৈর্য্যের অপূর্ব পরিচয় দিয়েছেন। ডিজাইন ডেভেলপমেন্টের খুঁটিনাটি নিয়ে তার সভাপতিত্বে উপদেষ্টা কমিটি নিয়মিত বৈঠক করে যাচ্ছিল। এই কমিটির মিটিং যে তারিখে অনুষ্ঠিত করার জন্য সকল প্রস্তুতি শেষ হয়েছিল, তার আগের দিন তিনি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেলেন আমাদের না জানিয়ে!

২০১৬ সালে আশুলিয়ার জিরাবোতে ঢাকার সর্ববৃহৎ কনভেনশন সেন্টার নির্মাণের সকল পর্যায়ে জামিলুর রেজা পরামর্শ দিয়ে গেছেন। এরপর আসলো আরেকটি বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ। চিড়িয়াখানা রোডে ১৩তলাবিশিষ্ট অত্যাধুনিক টেলিকম ভবন নির্মাণ।

আমাদের কাজের সঙ্গে কত গভীরভাবে তিনি জড়িত ছিলেন সেটা সবার জানার কথা নয়। তেমনি আরও কত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি একই গভীর মনোযোগ দিয়ে কাজ করেছেন, সেটা তারা ছাড়া হয়তো আর কেউ কোনোদিন জানতে পারবে না। আমাদের নির্মাণ কাজে তার যে অবদান, সেটা আমারও পুরোপুরি জানার কথা নয়। আমাদের প্রকৌশল বিভাগই ভালো করে জানবে। আমি জানি আমাদের প্রকৌশল বিভাগ তারই হাতে তৈরি। তারই আদর্শে উজ্জীবিত।

আমার ভারী মজা লাগতো যখন দেখতাম কিছুক্ষণ আগে যে জামিলুর রেজা আন্তর্জাতিক পরামর্শক বেষ্টিত হয়ে তাদের জন্য রচিত আলোচ্যসূচির মধ্যে ডুবে ছিলেন- তিনি সে মিটিং সেরে এসে অবলীলাক্রমে আমাদের সঙ্গে ভিন্ন ভঙ্গীর আলোচনায় বসে গেছেন। যমুনা সেতু অথরিটি কিংবা পদ্মা সেতুর কনসালটেন্ট বা কন্ট্রাক্টরদের সঙ্গে বাদানুবাদ করে সেই মিটিং থেকে তিনি সোজা আমাদের কাছে চলে এসেছেন গ্রামীণ কমিউনিকেশনসের বোর্ড মিটিংয়ে যোগ দিতে, খুঁটিনাটি বিষয়ে পরামর্শ দিতে। কোনোদিন বলেননি- তার ওপর কাজের চাপ বেড়ে গেছে, এখন তিনি আমাদের জন্য আগের মত সময় দিতে পারবেন না। বরং তিনিই উদ্যোগী হয়ে আমাদের কর্মকর্তাদের ডাকাডাকি করে জানতে চেয়েছেন, পরামর্শ দিয়েছেন।

পদ্মা সেতু, যমুনা সেতু- বাংলার মানুষের এই দুই স্বপ্নের সেতুর সঙ্গে তার নাম যুক্ত হতে দেখে দেশের সকল মানুষ স্বস্তি পেয়েছে। তিনি সারাজীবন জাতির কাছে নির্ভাবনার প্রতীক হয়ে থেকেছেন। দেশের মধ্যে শত মত-পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তার কোনো কাজে বা কোনো মন্তব্যে জাতি তার ওপর আস্থা কখনো হারায়নি।

জামিলুর রেজা বিশ্বমাপের মানুষ। আমরা সৌভাগ্যবান যে, আমরা তাকে আমাদের মধ্যে পেয়েছি। তিনি শুধু আমাদের প্রযুক্তি এবং অবকাঠামোর জগতকে সমৃদ্ধ করেননি- তিনি তার প্রতিভার ছোঁয়ায় স্থায়ীভাবে এ দেশকে এবং এ দেশের মানুষকে সমৃদ্ধ করেছেন, এ দেশের তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেছেন।

ধন্যবাদ, জামিলুর রেজা চৌধুরী। আমরা তোমার কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম। তোমাকে আমাদের স্মৃতিতে স্থায়ীভাবে ধরে রেখে আমরা তোমার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যাব।