বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক খাতে কোভিড-১৯ এর প্রভাব
অতি সম্প্রতি গণমানুষের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তাঁর ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ শীর্ষক মাস্টারপিসগ্রন্থে বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক খাত এবং এ খাতে কোভিড-১৯ এর প্রভাব সম্পর্কে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এবং শোভন সমাজ বিনির্মাণে বাংলাদেশের অনানুষ্ঠানিক খাতের পুনরুদ্ধারের জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন।
অধ্যাপক বারকাত তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশে মোট সক্রিয় শ্রমশক্তির তথা শ্রমবাজারের ৮০-৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে বা ইনফর্মাল মার্কেটে কর্মরত। কোভিড-১৯-এ যারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের অধিকাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত মানুষ। যেমন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ফেরিওয়ালা, হকার, ভ্যানে পণ্য বিক্রেতা, চা-পান স্টল; ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী-মুদি দোকানদার; অণু-ক্ষুদ্র হোটেল-রেস্তোরাঁ; ক্ষুদ্র মাঝারি পাইকার; নির্মাণ শিল্পের শ্রমিক; পরিবহন শ্রমিক; রিকশা-ভ্যানচালক; কৃষিমজুর ইত্যাদি।
গবেষক ড. বারকাত-এর হিসেবে (২০২০ সালের মে মাসে) বাংলাদেশে অণু ব্যবসায়ী (ভ্রাম্যমাণ ও স্থায়ী), ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী-মুদিখানা/মনিহারি দোকান, মাঝারি পাইকারি ব্যবসা এবং অণু-ক্ষুদ্র হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীর মোট সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৮৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮৯৪, যার মধ্যে গ্রামে ছিল ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার ৯২০ (৪০.৩ শতাংশ); আর শহরে ৫১ লাখ ৬৪ হাজার ৯৭৪টি (৫৯.৭ শতাংশ)। ব্যবসার ধরন অনুযায়ী গ্রাম-শহরে এসব ব্যবসা যেভাবে বিস্তৃত তা নিম্নরূপ:
ভ্রাম্যমাণ অণু-ব্যবসা (ফেরিওয়ালা, হকার, ভ্যানে পণ্য বিক্রেতা): মোট ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ৭১৯, যার মধ্যে গ্রামে ৬ লাখ ১০ হাজার ৫৬১ (২২.২ শতাংশ) আর শহরে ২১ লাখ ৪৩ হাজার ১৫৮ (৭৭.৮ শতাংশ)। এরা মোট অণু ব্যবসায়ীদের ৫৮.৬ শতাংশ, আর মোট পাঁচ ধরনের ব্যবসায়ীদের মধ্যে ৩১.৮ শতাংশ (পাঁচ ধরনের মধ্যে অণু-ব্যবসার দুটি ধরন আলাদা ধরলে)।
(২) স্থায়ী অণু-ব্যবসা (চা-পান বিক্রেতা): মোট আনুমানিক ১৯ লাখ ৪৫ হাজার ৬৮৫, যার মধ্যে গ্রামে ৯ লাখ ৫৯ হাজার ৪৫৩ (৪৯.৩ শতাংশ), আর শহরে ৯ লাখ ৮৬ হাজার ২৩২ জন (৫০.৭ শতাংশ)। এরা মোট অণু-ব্যবসায়ীদের ৪১.৪ শতাংশ, আর মোট পাঁচ ধরনের ব্যবসায়ীদের ২২.৪ শতাংশ।
(৩)মোট অণু-ব্যবসায়ী (ভ্রাম্যমাণ ও স্থায়ী): মোট আনুমানিক ৪৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪০৪, যার মধ্যে গ্রামে ১৫ লাখ ৭০ হাজার ১৪ (মোট অণু-ব্যবসায়ীর ৩৩.৪ শতাংশ) আর শহরে ৩১ লাখ ২৯ হাজার ৩৯০ জন (মোট অণু-ব্যবসায়ীর ৬৬.৬ শতাংশ)। অণু-ব্যবসায়ের মোট সংখ্যা হবে দেশের মোট ৪ ধরনের ব্যবসার (যেসব ব্যবসা নিয়ে আমরা এখানে বলছি) ৫৪.৩ শতাংশ। তথ্যটি গুরুত্বপূর্ণ এ জন্য যে দেশে অণু-ব্যবসায়ের সংখ্যা তুলনামূলক অনেক এবং মানুষ স্বল্প মূলধনে নিজ উদ্যোগে কিছু না কিছু করেন। এ ধরনের আত্মকর্মসংস্থান অর্থনীতির জন্য এবং মানুষের জীবিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের আত্মকর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রণোদণা দেওয়া জরুরি।
(৪) ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী (মুদিখানা/মনোহারি দোকান এবং অনুরূপ): মোট ৩১ লাখ ১৫ হাজার ৫২, যার মধ্যে গ্রামে ১৩ লাখ ৯৫ হাজার ৫৬৮ (মোট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ৪৪.৮ শতাংশ) আর শহরে ১৭ লাখ ১৯ হাজার ৪৮৪ জন (মোট ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর ৫৫.২ শতাংশ)। এরা দেশের মোট পাঁচ ধরনের ব্যবসায়ের একক সর্বোচ্চ গ্রুপ, ৩৬ শতাংশ।
(৫) মাঝারি পাইকারি: মোট ৩ লাখ ১৯ হাজার ৮৫২, যার মধ্যে গ্রামে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৪৪৬ (মোট মাঝারি পাইকারিদের ৫৪.৫ শতাংশ) আর শহরে ১ লাখ ৪৫ হাজার ৪০৬ (মোট মাঝারি পাইকারিদের ৪৫.৪ শতাংশ)।
(৬) অণু-ক্ষুদ্র হোটেল-রেস্তোরাঁ: মোট ৫ লাখ ১৯ হাজার ৫৮৬, যার মধ্যে গ্রামে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৮৯২ (মোট এ গ্রুপের ৬৭.১ শতাংশ) আর শহরে ১ লাখ ৭০ হাজার ৬৯৪ (মোট গ্রুপের ৩২.৯ শতাংশ)। এরা দেশের মোট চার ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ৬ শতাংশ।
অধ্যাপক বারকাতের মতে, কোভিড-১৯-এ লকডাউনের ফলে এসব অণু-ক্ষুদ্র ব্যবসা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সমগ্র দেশে অণু ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালা, চা-পান স্টল, মুদি দোকান, মাঝারি পাইকারি দোকান ও অণু-ক্ষুদ্র হোটেল রেস্তোরাঁর মোট সংখ্যা ৮৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮৯৪। প্রতিটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গড়ে কর্মচারীর সংখ্যা (মালিকসহ) ১.৮৩ জন। সে হিসেবে ওইসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কোভিড-১৯-এ লকডাউনের আগে মোট নিযুক্ত ছিলেন ১ কোটি ৫৮ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৬ জন। আবার প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে গড়ে ১.২৩ জন পাওয়া গেছে, যাদের আয়ে তাদের খানার মূল ব্যয় নির্বাহ হয় (যেখানে খানার সদস্য গড়ে ৪.০৭ জন)।
খ্যাতিমান গবেষক আবুল বারকাত-এর হিসেবে ওই ৮৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮৯৪ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর নির্ভর করে মোট ৪ কোটি ৩৩ লাখ ২২ হাজার ২৫৯ জন মানুষের জীবিকা (যা দেশের মোট ১৭ কোটি জনসংখ্যার ২৫.৪৮ শতাংশ)। অর্থাৎ এরা হলেন দেশের প্রতি ৪ জনের ১ জন। এদের মধ্যে প্রথম দুই ক্যাটাগরির (অর্থাৎ অণু-ব্যবসায়ী: ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা ও চা-পান বিক্রেতা) প্রায় সবাই কোভিড-১৯-এর কারণে নিঃস্ব হয়েছেন। অন্য কথায়, ব্যবসা-বাণিজ্য বিবেচনা করলে দেশের উল্লিখিত মোট ৮৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮৯৪ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৪৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪০৪টি (এরা মোট ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের ৫৪.২ শতাংশ) অণু ব্যবসায়ী কোভিড-১৯-এ লকডাউনের কারণে সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়েছেন। এদের খানার মোট সদস্য সংখ্যা হবে ১ কোটি ৯১ লাখ ২৬ হাজার ৫৭৪ জন। আর ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং অণু-ক্ষুদ্র হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিক অর্থাৎ ৩৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬৩৮টি প্রতিষ্ঠান। এদের কমপক্ষে ৫০ শতাংশ (১৮,১৭,৩১৯) কোভিড-১৯-এর কারণে হয়েছেন ‘নব-দরিদ্র’। এ গ্রুপে ‘নব-দরিদ্রদের’ খানার মোট সদস্য সংখ্যা হবে আনুমানিক ৭৩ লাখ ৯৬ হাজার ৬৪৯ জন।
তাঁর হিসেবে কোভিড-১৯-এ লকডাউনের কারণে মোট ৬৫ লাখ ১৬ হাজার ৭২৩টি অণু-ব্যবসা ও অণু-ক্ষুদ্র হোটেল-রেস্তোরাঁ সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়েছে, তারা হয়েছে ‘নব-দরিদ্র’ আর এদের খানার সদস্য সংখ্যা হবে মোট ২ কোটি ৬৫ লাখ । কোভিড-১৯-এ লকডাউনের কারণে অণু ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের মধ্যে সৃষ্ট এই ২ কোটি ৬৫ লাখ ‘নব-দরিদ্র’ মানুষ হচ্ছেন দেশের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশ। এসব ‘নব-দরিদ্রকে’ উদ্ধার করতেই হবে।
তিনি উল্লেখ করেছেন, কোভিড-১৯-এর লকডাউনে ব্যবসা-বাণিজ্য লেনদেন স্থবির হয়ে পড়ার কারণে অণু ব্যবসায়ীদের (ভ্রাম্যমাণ এবং স্থায়ী) প্রায় সবাই নিঃস্ব হয়েছেন, অণু-ক্ষুদ্র হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসার কমপক্ষে অর্ধেকটাই নিঃস্ব; চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী (মুদি/মনোহারি দোকান এবং সমজাতীয় ব্যবসা-বাণিজ্য), ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ক্ষুদ্র-মাঝারি পাইকার। আর এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চলমান থাকার সাথে জীবন-জীবিকা সরাসরি নির্ভর করে এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানপ্রতি গড়ে ১.৩ জন কর্মচারীর (যাদের আয়ে ওদের পরিবারের জীবিকা নির্ভর করে)।
অধ্যাপক আবুল বারকাত হিসেব করে দেখিয়েছেন যে, মোট ৮৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮৯৪টি অণু-ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালু থাকার সাথে জীবন-জীবিকা সরাসরি নির্ভর করছে ৭ কোটি ৮০ লাখ মানুষের (যারা দেশের মোট জনসংখ্যার ৪৫.৯ শতাংশ)। কোভিড -১৯ এর কারণে এসব ব্যবসার যে বেহাল দশা হয়েছে তাতে এদের বেশির ভাগই রাষ্ট্রীয়-সরকারি সহায়তা ছাড়া কোনোদিনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। এদের যোগ্যতা-দক্ষতা-অভিজ্ঞতা সবই আছে, কিন্তু আর্থিক ভিত ভেঙে গেছে।
প্রস্তাবনা:
এসব বিবেচনা থেকে এসব ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান পুনরুজ্জীবিত করতে অধ্যাপক বারকাত তাঁর বইয়ে কতিপয় সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন। যথা:
(১)অণু ব্যবসায়ী: মোট ৪৬ লাখ ৯৯ হাজার ৪০৪ জন ভ্রাম্যমাণ ব্যবসা ও (স্থায়ী) চা-পান দোকানদারকে ব্যবসা পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা এককালীন অনুদান (ঋণ নয়) বাবদ মোট ৯,৩৯৯ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ করা। এ অনুদান স্থানীয় সরকারের সহযোগিতায় ব্যাংক ব্যবস্থাপনা করবে।
(২) ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী (মুদি, মনোহারি দোকান এবং সমগোত্রীয়, মোট ৩১,১৫,০৫২) এবং অণু-ক্ষুদ্র হোটেল-রোস্তোরাঁ (মোট ৫,১৯,৫৮৬): মোট ৩৬ লাখ ৩৪ হাজার ৬৩৮টি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা শুরু ও স্বাভাবিকভাবে পরিচালনার জন্য প্রত্যেককে স্বল্প সুদে (২.৫% সরল সুদে) ১ বছর মেয়াদি ২ লাখ টাকা চলতি মূলধন ঋণ, যে ঋণ ফেরত দেওয়া শুরু হবে ঋণ প্রাপ্তির ৬ মাস পরে; আর এদের মধ্যে কারো ইতিমধ্যে ব্যাংক ঋণ থাকলে কিস্তি পরিশোধ কমপক্ষে ৬ মাস পেছানো। এখানে ব্যবস্থাপনা করবে ব্যাংক। এই প্রস্তাবনানুযায়ী মোট ঋণ-ফান্ড হতে হবে ৭২,৬৯৫ কোটি টাকা।
(৩) মাঝারি পাইকারি ব্যবসা (মোট ৩,১৯,৮৫২): এ গ্রুপের জন্য প্রস্তাব হলো ব্যবসা শুরু ও স্বাভাবিক পরিচালনের জন্য প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানকে স্বল্প সুদে (২.৫% সরল সুদে) ১ বছর মেয়াদি ৩ লাখ টাকা চলতি মূলধন ঋণ, যে ঋণ তারা ফেরত দেবে ঋণ প্রাপ্তির ৬ মাস পর থেকে; আর এদের মধ্যে কারো ইতিমধ্যে ব্যাংক ঋণ থাকলে কিস্তি পরিশোধ কমপক্ষে ৬ মাস পেছানো। এ ঋণ ব্যবস্থাপনায় থাকবে ব্যাংক। এই প্রস্তাবনানুযায়ী মোট ঋণ-ফান্ডের আকার হবে ৯,৫৯৬ কোটি টাকা।
ড. মতিউর রহমান, গবেষণা পরামর্শক, হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (এইচডিআরসি) ঢাকা ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সহযোগী সদস্য শিশির রেজা