বাংলাদেশ-ভারত-নেপালের মধ্যে রেল ট্রানজিট এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
সারা বিশ্বে চলাচলের জন্য প্রধানত চার ধরনের যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করা হয়। মাধ্যমগুলোর ভেতর রেল যোগাযোগ তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। এছাড়াও খুব কম খরচে রেলপথের মাধ্যমে পণ্য আনা নেওয়া করা যায়। এখানে উল্লেখ করা দরকার, উন্নত দেশগুলো রেল যোগাযোগের জন্য প্রথমদিকে অনেক অর্থ ব্যয় করেছিল। কারণ জলপথের পরেই রেলপথ বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য প্রসারের জন্য একটা বিকল্প হিসেবে অধিকতর ভালো মাধ্যম। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যে অর্থনীতিতে অগ্রসরমান দেশগুলো রেল পথ নির্মাণের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারা এটা করছে শুধু প্রতিযোগীতামূলক বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো রেলপথ উন্নয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। কিন্তু অতি সম্প্রতি অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা এই অঞ্চল এখন আঞ্চলিক রেল যোগাযোগের প্রতি মনোযোগ দিচ্ছে। মূলত আঞ্চলিক বাণিজ্য প্রসারের জন্য দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা রেলপথগুলো নতুন করে খুলে দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে নতুন নতুন রেল রুট উদ্ভাবন করা হচ্ছে।
দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল এর মধ্যে রেল যোগাযোগ পুনঃস্থাপন এবং নতুন রেল রুটের জন্য বৃহৎ পরিসরে দেশগুলোর মধ্যে ট্রানজিট চুক্তি হচ্ছে। এছাড়াও অনেক আগে স্বাক্ষরিত ট্রানজিট চুক্তিগুলো ইদানিং সম্পাদন করা হচ্ছে। বাংলদেশের অভ্যন্তরে বিগত দশ বছরে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা ৬টি রেল রুট চালু করা হয়েছে। আরও অনেক রুট চালু করার বিষয়ে কথাবার্তা চলছে। একটা ভালো সংবাদ যে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে অনেক রেল পথ পুনরায় চালু করা হয়েছে। চালু হওয়া এই রেল পথগুলো যুগ যুগ অব্যহৃত ছিল। বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে যে ৬টি রেল পথ আছে তার মধ্যে ৪টি ব্রডগেজ রেলপথ এখন চলমান।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০১৭ সালের ভারত সফরের মধ্যে দিয়ে রাধিকাপুর-বিরল রেল সংযোগটি খুলে দেওয়া হয়। এটা ছাড়াও বাকি দুইটা রেল পথের কাজ চলছে। সপ্তম নতুন রেলপথ আগরতলা-আখাউড়া ভারতের অর্থায়নে করা হচ্ছে। এ সিদ্ধান্ত আমাদের উদীয়মান অর্থনীতির জন্য একটা ইতিবাচক দিক। ঢাকা-কলকাতার মধ্যে প্রথম মৈত্রী এক্সপ্রেস এবং খুলনা কলকাতার মধ্যে দ্বিতীয় মৈত্রী এক্সপ্রেস চলাচল শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর ২০১৭ সালের ভারত সফরকে কেন্দ্র করে। প্রতিবেশী দু’দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্য এই উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এই উদ্যোগ নেওয়ার জন্য আমি দু’দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
যাত্রীবাহী ট্রেন চালু করার বিষয়ে ঢাকা-নয়াদিল্লীর মধ্যে প্রথম আলোচনা হয়। এ আলোচনার প্রেক্ষিতে যাত্রীবাহী ট্রেন ‘মৈত্রী এক্সপ্রেস’ ২০০৮ সালের ১৪ এপ্রিলে জমকালো আয়োজনের মধ্যে দিয়ে উদ্ধোধন করা হয়। মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঢাকা-কলকাতার মধ্যে এখনো চলাচল অব্যাহত আছে। এরপর ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’ নামের আরেকটি যাত্রীবাহী ট্রেন চালু করা হয় ২০১৭ সালের ৯ নভেম্বর কলকাতা থেকে এবং ১৬ নভেম্বর খুলনা থেকে। প্রকৃতপক্ষে, দু’দেশের মধ্যে যোগাযোগ সহজতর করার জন্য এই রুট চালু করা হয়েছে। বন্ধন এক্সপ্রেস ট্রেনটি বেনাপোল হয়ে খুলনা-কলকাতার মধ্যে চলাচল করে। যাত্রীবাহী ট্রেনের পাশাপাশি এ দু’দেশের মধ্যে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করছে অনেক বছর ধরে। বিশেষ করে চলচলকারী এসব পণ্যবাহী ট্রেনের মাধ্যমে পাথর পরিবহন করা হয়। রহনপুর-সিঙ্গাবাদ, বেনাপোল-পেট্রাপোল, দর্শনা-গেদে এবং বিরল-রাধিকাপুর সীমান্ত দিয়ে পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল করে থাকে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে কিছুদিন আগে পণ্যবাহী ট্রেনে নিত্যপণ্য পেঁয়াজ পরিবহন করা হয়। এতে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয়। পণ্যবাহী ট্রেনের মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানিকে কেন্দ্র করে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও জোরদার হয়।
বাংলাদেশ এবং নেপালের মধ্যে ট্রানজিট চুক্তি হয় ১৯৭৬ সালে। এ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ এবং নেপালের মধ্যে ৬টি পোর্ট অফ কলের মাধ্যমে পণ্য আনা-নেওয়া করা যাবে। অনুমোদিত এই ৬টি বন্দর হলো- মংলা বন্দর, চট্রগ্রাম বন্দর, বিরাল (পশ্চিমবঙ্গ ভারত), বাংলাবান্ধা, চিলাহাটি এবং বেনাপোল। বর্তমান সময়ের চাহিদার প্রেক্ষিতে এই প্রটোকল চুক্তি সংশোধন করা হয়। সংশোধিত এই প্রটোকলের মাধ্যমে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে ৬টি বর্হিগমন এবং নির্গমন পথ নির্ধারণ করা হয়। এই ৬টি রুটের মাধ্যমে নেপালের পণ্যবাহী যানবাহন বাংলাদেশে প্রবেশ এবং বাংলাদেশে থেকে বের হতে পারবে। উল্লেখ্য যে আরও দুটি রেলপথ চালু করার বিষয়ে প্রস্তাবনা আছে।
প্রথম রেল রুট রোহনপুর-জিরোপয়েন্ট- সিঙ্গাবাদ (পশ্চিমবঙ্গ)-জগবানি (বিহার)-ভিরাটনগর (নেপাল)। এ রেল পথের দূরত্ব হলো ২১৭ কিলোমিটার। দীর্ঘ ৫১৭ কিলোমিটার দূরত্বের দ্বিতীয় রেল রুট রোহনপুর- জিরো পয়েন্ট-বিরাল (পশ্চিমবঙ্গ)- রাধিকাপুর (পশ্চিমবঙ্গ)- রক্সল (বিহার)- বিরগুঞ্জ (নেপাল)। ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ-ভারতের রোহনপুর এবং সিঙ্গাবাদ ব্রডগেজ রেল সংযোগ ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নেপাল অনুমতি দেয়। এরপর ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ এবং নেপালকে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ত্বরানিত করার লক্ষ্যে ভারত নতুন এই রেল রুট ব্যবহারের অনুমতি দেয়। পর্যায়ক্রমে, ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে অতিরিক্ত ট্রানজিট রুট হিসেবে পাওয়ার জন্য পাহাড়-পর্বত অধ্যুষিত দেশ নেপাল একচেঞ্জ লেটার পাঠায়। অপরপক্ষে, নয়াদিল্লি এবং কাঠমুন্ডুর মধ্যে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিঙ্গাবাদ রেল রুট ব্যবহারের জন্য একটা সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশের সাথে নেপালের বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য বিগত কয়েক দশক ধরে এ দু’দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। এছাড়াও, এ দু’দেশের মধ্যে খুব শিগগিরই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হতে যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরে নেপাল আমাদের সৈয়দপুর বিমান বন্দর ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ করে যাচ্ছে। এ প্রস্তাবে বাংলাদেশ এখনো লিখিতভাবে কোনো উত্তর দেইনি। ইতিমধ্যে, নেপালের বিদেশ মন্ত্রী গেইওলি বাংলাদেশের কাছে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা দিয়েছে। আমার মতে সৈয়দপুর বিমান বন্দর ব্যবহারের জন্য যদি নেপালকে অনুমতি দেওয়া হয় তাহলে আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে।
২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে বাংলাদেশ ৩৮.৫ মিলিয়ন ইউএস ডলারের পণ্য নেপালে রফতানি করে। অপরপক্ষে, নেপাল থেকে ১৮.৩ মিলিয়ন ইউএস ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়। এছাড়াও, ২০১৮ সালে নেপালে ২৬ হাজার ২৫৫ জন বাংলাদেশি নাগরিক ভ্রমণ করতে যায়। যার মাধ্যমে ইতিবাচক সম্পর্ক প্রকাশ পায়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ৩৬১ মিলিয়ন ইউএস ডলারের পণ্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানি করা হয়। সেখানে ২০১৮ সালের প্রথম ছয় মাসে ৮৭৩ মিলিয়ন ইউএস ডলারের পণ্য ভারতে রফতানি করা হয়। এ তথ্যর আলোকে বলা যায় যে, প্রতিবেশী এ দু’দেশের মধ্যে দিনে দিনে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। সম্প্রতি স্বাক্ষরিত চুক্তি ‘কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট (সিইপিএ)’ এবং ‘ট্রানশিপমেন্ট’ চুক্তির মাধ্যমে ভারত-বাংলাদেশের ভেতর সামনের দিনে বাণিজ্য আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশা রাখছি।
দক্ষিণ এশিয়ার মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল হিসেবে (সাফটা) স্বল্পোন্নত দেশের জন্য নেপাল ৯৯৮টা পণ্যের সুবিধা দিচ্ছে। অ-স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ১ হাজার ৩৬ টা পণ্যের সুবিধা দিচ্ছে। বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য ৯৮৭ পণ্যের এবং অ-স্বল্পোন্নত দেশের জন্য ৯৯৩ পণ্যের ওপর সুবিধা দিচ্ছে। আমি যদি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের কথা স্মরণ করি তাহলে বলবো ভারত এবং নেপাল এ দু’দেশই বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য মোটেই দেরি করে নাই। দক্ষিণ এশিয়ার ভেতর ভারত হলো বাংদেশের সবচেয়ে বড় ট্রেডিং পার্টনার। এ দুশের মধ্যে সড়কপথে পণ্য আনা নেওয়া খুবই ব্যয়বহুল। সড়কপথে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে যানজট এবং আরও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এতে পণ্য নিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে যায়। এসব সমস্যার কথা চিন্তা করে আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে রেল ট্রানজিট ব্যবহারের বিকল্প নেই। ভারতের ভেতর ২০০৪ সালে বিরাটনগর থেকে সিনগাবাদ পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ উদ্ধোধন করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ অংশে ২০১৫ সালে ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণ করা হয়।
যদি বাংলাদেশ-ভারত-নেপালের মধ্যে বহুল আকাঙ্ক্ষিত ‘মটর ভিকল’ চুক্তি কার্যকর করা হয় তাহলে আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যাবে। এ চুক্তিটি বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক প্লাটফর্মগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। মটর ভিকল চুক্তির আওতায় বাংলাদেশের ঢাকা হয়ে কলকাতা –আগরতলা এবং ভারতের কলকাতা হয়ে ঢাকা নয়াদিল্লীর মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ২০১৬ সালে পণ্যবাহী ট্রাক চলাচল করেছিল। এখন যাতে বাংলাদেশি পণ্যবাহী ট্রাক, ট্রেন সরাসরি যদি ভারতে প্রবেশের অনুমতি পায় সে বিষয়ে দু’দেশের ইতিবাচক চিন্তা করতে হবে। এর পাশাপাশি ২৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মায়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর যদি খুব শিগগিরই বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে অর্থনৈতিকভাবে আমরা অনেক দূরে এগিয়ে যেতে পারবো। আসুন আমরা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অনেক বছর ধরে ঝুলে থাকা চুক্তিগুলো বাস্তবায়ন করি যা আকাঙ্ক্ষিত বিদেশি বিনিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগীতা করবে।
লেখক: ব্যাংকার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক