আমরা কখনো হারিয়ে যাব না বিলয়ের বিস্মরণে
প্রপঞ্চ
উজান আকাশ থেকে ভাটির আকাশে চোখ রাখি
রাস্তায় গাড়ির শব্দ ক্রমাগত মুছে যেতে থাকে
মুমূর্ষু হৃদয় জাগে না অজানা অন্তর্গত ডাকে
জানি না কতটা ফুরিয়েছে পথ কতটুকু বাকি
পকেটে খুচরো নক্ষত্র নিয়ে নিঃসঙ্গ হাঁটতে থাকি
নুড়িপাথরের প্রান্তে জল ছুটে যায় নয়া বাঁকে
ছবির ভেতরে ছবি ধরে রাখে ভুল ছবিটাকে
আমি তবু রংতুলি দিয়ে যৌগিক যন্ত্রণা আঁকি
শেষ ট্রেন ছেড়ে-যাওয়া স্টেশনের নাম দীর্ঘশ্বাস
অসুখ সারে না আর ষড়ঋতু ঝাপটায় ডানা
বাতাস উড়িয়ে আনে বেপাড়ার বিমর্ষ ঠিকানা
ছেঁড়া শহরের কেন্দ্রে ও কিনারে শরীরী উল্লাস
পূর্ণতা প্রপঞ্চ মাত্র যাবতীয় জাগতিক ভোজে
ভবঘুরে মুহূর্তরা অপূর্ণতার সংজ্ঞার্থ খোঁজে
আগুন
বেশি কিছু চাইনি কখনো
কিন্তু স্পর্শের বিশ্বাসটুকু চেয়েছিলাম পূর্বাপর
তাও যখন ইন্দ্রিয়ের তাড়নায় মিথ্যে হয়ে যায়
তখন আর বকের পালকে লিখতে পারি না
কোনো নাম
নামহীনতার দীনতা নিয়ে ওড়া তো দূরের কথা
দুকদম হাঁটতে গেলেও দম ফুরোয়
তুমি তবু কোন শক্তিবলে সাঁতরে বেড়াও সরোবরে সকালসন্ধে
কেউ কি আমাকে সদরে অন্দরে খুঁজে পাবে না
জীবন এমনই এক আগুন
পোড়াবার পর যা আর কিছুই অবশিষ্ট রাখে না
ব্যর্থতা
জল্পনা থেকে কল্পনা শক্তিশালী
লালিত স্বপ্ন গৃহেই পালিত পোষ্য
বুকে খঞ্জর পঞ্জরভেদী নিত্য
বাজারে লভ্য লেহ্য চর্ব চোষ্য
চেষ্টা অশেষ তেষ্টা মেটাতে ব্যর্থ
রাতের শরীরে হাতের বেহাল নৃত্য
ক্ষণিকের লোভে অনিকেত জয়যাত্রা
আসলে মিথ্যে চিত্তে প্রসূত কৃত্য
অবরুদ্ধের যুদ্ধে নাছোড় ভেলকি
অকৃতিরা মাগে প্রকৃতির ঔদার্য
মর্তে আমরা মেতেছি আমড়াগাছিতে
সড়কে মড়কে নরকের কারুকার্য
রাতশ্মশান
এখানে ছিল নদী—এখন দাগ
শীর্ণ স্মৃতি জীর্ণতার ধুলো
একক মনে দ্বৈত অনুরাগ
ভাবনারাশি হারায় চালচুলো
এখানে ছিল মাঠ—এখন বাস
দিগন্ত উধাও দিগ্বিদিক
লুটেরারাজ সওয়ার বারো মাস
কালের গতি অহ্নে বার্ষিক
এখানে ছিল জীব—এখন জড়
গাড়ির চাকা বাঁকায় আঁকা পথ
জগদ্দল আজ দেবতা বড়ো
উদোম জলে বেদম পর্বত
এখানে ছিল প্রেম—এখন ঘৃণা
অঙ্কে শুধু ফলাফলের ভুল
রাতশ্মশানে মাটি আদরহীনা
চোখের মণি বিষনয়নে শূল
শুভ জন্মদিন
করোনা উপদ্রুত এই উৎকণ্ঠিত উপকূলে
এক অকল্পনীয় অবরোধের অম্বুদে অবগুণ্ঠিত করুণ অরুণ
যে অরণ্যের অমল অনিলে বনফুলের সৌগন্ধের সঙ্গে
লীলামত্ত ছিল মৃগনাভি কস্তুরীর সৌরভ
সেখানে এখন জ্বলছে অপ্রশম্য
মৃত্যুর কালো চিতাবাঘের ক্রূর কটাক্ষের কালাগ্নি
চারদিকে ধ্বসে পড়ছে অসহায় মানবিক গেরস্থালি
জনারণ্য জনপদ জনপথ বিরাণ
বাতাসে মরণকণা
সংঘে সান্নিধ্যে সোহাগে স্পর্শে মৃত্যুর উদ্যত ফণা
এ কালবেলায় পুরো পৃথিবী এক ক্লেশিত কুরুক্ষেত্র
এক করুণ কারবালা
অদৃশ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে
স্বপ্নসুন্দর দৃশ্যাবলী ক্রমাগত মুছে যাচ্ছে ধরিত্রীর ক্যানভাস থেকে
ছবি থেকে খসে পড়ছে রং
প্রদীপ থেকে নিভে যাচ্ছে শিখা
কণ্ঠ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে গান
শরীর থেকে ঝরে পড়ছে প্রাণ
পুষ্পপল্লবশূন্য হয়ে পড়ছে ব্রহ্মাণ্ডের বুকের বাগান
না, আমরা তবু হার মানব না বিরূপ বিষম বিগ্রহে
না, আমরা কখনো হারিয়ে যাব না বিলয়ের বিস্মরণে
না, আমরা হাল ছাড়ব না দুর্যোগের দুরন্ত দিগন্তে
না, আমরা চোখ বুজব না বিস্তৃত বিষবাষ্পে
অমার রন্ধ্রে আমরা জ্বালাব মৃত্যুঞ্জয়ী মশাল
মানুষের ছন্দে আমরা বাঁধব মরণভেদী রণসঙ্গীত
প্রাণপণ প্রতিজ্ঞায় আমরা বাঁচাব প্রাণ
প্রতিটি সূর্যোদয় হবে মানবের শুভ জন্মদিন
শারীরিক
কৃষ্ণপক্ষের কমলা রঙের চাঁদ ডিঙি নৌকো হয়ে
ঝুলে থাকে পশ্চিম আকাশে
আকাশ নাকি সমুদ্র
দ্বিধাদ্বন্দ্বের প্রহর আর ফুরোতে চায় না
কুয়াশাচ্ছন্ন নদীপথে আমাদের যাত্রা
আদিগন্ত গহন অরণ্য ঢেকে রাখে অপার্থিব চরাচর
আনন্দ অথবা গ্লানি
প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তি তুচ্ছ হয়ে যায়
বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমোয় ভালোবাসা
আমাদের কোনো অঙ্গীকার নেই
আমাদের কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নেই
আমরা কেবল ভেসে যাই বন্ধনবিহীন
কখনো এপারে
কখনো ওপারে
জীবন বস্তুত শারীরিক
অভিনয়
বাতাসে ঢেউ আঁকে না কেউ আর
নিথর গাঙে নায়ে কাতর পাল
পবিত্রতা ভাঙে অঙ্গীকার
মানুষ বুঝি হাড়ের কঙ্কাল
বিষাদে চাঁদ হয়েছে ঘন নীল
পাখির ছায়া প্রাঙ্গনে অচল
শিরিষ গাছে শব্দের মিছিল
ঘরের কোণে ভূত সদলবল
পূর্ণ থালা উলটে পড়ে রয়
অবিশ্বাসে পথিক গান গায়
নিরর্থক শূন্য অভিনয়
বেঁচে থেকেও মানুষ মরে যায়
কষ্টের রংধনু
কষ্টরা আসমানি
বুকে নষ্ট অনুভূতির
স্পষ্ট কানাকানি
কষ্টগুলো সবুজ
অবোধ পাতালে ডোবে বোধ
সর্বনাশা অবুঝ
কষ্টগুলো হলুদ
জলের ভেতর শীতল অনল
স্বপ্ননেশায় বুঁদ
কষ্টরা বেগুনি
না-বলা তোর সকল কথা
মনের মধ্যে শুনি
কষ্টগুলো নীল
দূর আকাশে আরো দূরের
অধরা ঝিলমিল
কষ্টরা কমলা
হৃদয় চিরে ঝলসে ওঠে
হঠাৎ বিজলিফলা
কষ্টগুলো লাল
দুধারী এক তরবারি
কাটছে সমকাল
সওয়াল-জবাব
— কতটুকু তুমি তাকে দিতে পারো
— যতটুকু দেয়া যায় তার চেয়ে বেশি আরো
— কতদূর তুমি তার সাথে যাবে
— যতদূর গিয়ে মন ঠিকানা হারাবে
— কতদিন তুমি কাটাবে কেবল তার নামে
— যতদিন চিঠি আসবে অপার্থিব খামে
— কতরাত তুমি করতে পারবে মৃত্যুকে অবহেলা
— যত রাতভর ঈশ্বরী পাঠাবেন এত্তেলা
— কতটা কষ্ট সইতে পারবে বলো
— যার থই পায়নি এখনো তিনভাগ জলও
— এত ভালোবাস তুমি তাকে
— এ প্রশ্ন কোরো না আমাকে
অনুভব করতে দাও অলৌকিক বেদনাকে
ভাব
ছায়াহীন প্রান্তর ঘুমোয়
ছায়াঢাকা বন বিপরীতে
অশালীন অধ্যায় ফুরোয়
মুখরাখা পার্বণের শীতে
তুমি যাকে সত্যি বলে জানো
সে তোমার অস্তিত্বের অরি
ঘটনাকে ভেবো না বানানো
বেশুমার চক্রাকার ঘড়ি
আজ তবে এটুকুই হোক
অতঃপর নিম্নগামী বোধ
অনুভবে কাহিনী ফুরোক
অনুর্বর সব অবরোধ
বেহালার গৎ ভুলে যাই
আবেশেই আরাগ্য আসলে
বিসমিল্লাহর বাজুক সানাই
অভাবেই ভাব কথা বলে