মনের ঘূর্ণি থেকে
বনভোজনের আহ্লাদ
ডব্লিউ এইচ অডেন বলেছিলেন “LIFE IS A PICNIC ON A PRECIPICE.” এই শীত শেষ হয়ে গরমের আগে উঁকি দিচ্ছে যে প্রেমিক বসন্ত তার গাল ধরেই এই একত্রিত আনন্দের মধ্যে আসি। এখন মানুষ অনেক বেশি সফল এবং অনেক বেশি একা...কারণ মুহূর্তের মাধুর্যের নিয়ন্ত্রণ এখন যন্ত্রের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তবু এখনো কিছু মন এই একত্রিত হিল্লোলে মেতে উঠতে চায়।
শীতের শুরু থেকে এই বসন্ত সেই একত্রিত উদযাপনের সবচেয়ে বড় সময়। প্রকৃতিও দরাজ হয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়। ঘর থেকে বেরিয়ে জঙ্গলে, মাঠে, খোলা বাতাসে সবাই মিলে খেলা, আড্ডা মারা, খাওয়া দাওয়া এটা আসলে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উদযাপন। কারণ প্রকৃতির কাছে গেলেই মানুষ বুঝতে পারে সে কিছুই নয়—সে যে ক্ষমতা ও সাফল্যের আস্ফালন করে তাও কেবল একটা লঘু খেলা ছাড়া কিছু নয় ফলে তার উদারতা বাড়ে, মুহূর্তের মাধুর্য বাড়ে—এভাবে জীবনের চেয়েও সুন্দর হয়ে ওঠে যাপন করা।
আমাদের এই হাতে হাত ধরা সূত্রগুলো ছিন্ন হয়ে গেছে আমাদেরই কারণে তাই ভিড়ের মধ্যে থেকেও সে একা হয় ফলত ওই ভিড় থেকেই সে আরো নিভৃতির পথ খুঁজে নেয়। আমাদের আড্ডারা, আদান-প্রদানের মুহূর্তরা তাই কমে আসছে ক্রমশ। এই বনভোজনের ধারণাটি পিকনিকের থেকেই এসেছে। অষ্টাদশ ও নবম শতাব্দীর পরবর্তী সময় থেকে সাধারণ মানুষ বিভিন্ন পার্কে, ময়দানে বনভোজনের আনন্দ নিতে শুরু করে। আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে পিকনিক ছিল জমায়েত ও ভোজের বিনোদন। একটি মধ্যবর্তী টেবিলকে কেন্দ্র করে যে যার মতো করে সাধ্যমতো খাবারের পদ সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিত। এর পরবর্তী এই জমায়েতটি মূলত শুরু হলো বাড়ির বাইরে। সময়টা ১৮৬০, পিকনিক বা বনভোজন—এর প্রাথমিক রূপ উন্নীত হলো।
চতুর্দশ শতাব্দীতে মধ্যযুগীয় শিকারকে ফিস্ট হিসেবে ইংল্যান্ডে বিনোদনের মাধ্যমে সকলের মধ্যে উদযাপন করা হতো। অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী পিকনিক এরকম একটি আধুনিক সামাজিক বিনোদন যেখানে খাদ্য ও সংস্কৃতির আদানপ্রদান করা যায়। পিকনিক শব্দটি এসেছে ষোড়শ শতাব্দীতে ফরাসি শব্দ থেকে । ১৭০০ সালে ইংরেজি সাহিত্যে পিকনিকের উল্লেখ পাওয়া যায়। আমেরিকার পিকনিকে আবার খাদ্যপ্রণালীর একটা ধরনের ব্যবহার আছে যেমন উত্তর-পূর্ব আমেরিকার মানুষরা আনতেন চিজ, মাংস, সাদা কিম্বা লাল ওয়াইন আবার দক্ষিণের দিক থেকে যারা আসত ঠান্ডা বিয়ার, অ্যারোমেটিক কফি আবার মধ্য-পশ্চিমের থেকে হ্যামবার্গার, বিস্কুট, চিপস একরকমভাবে পশ্চিমের দিক থেকে চিংড়ি ইত্যাদির ভিন্ন খাদ্যাভাস এক জায়গায় একত্রিত হতো।
আরো পড়ুনঃ মুখের ভেতর সেই বরফের দেশে
সাহিত্য, সিনেমায়, গানে সর্বত্র বনভোজনের উল্লেখ পাওয়া গেছে। ১৯৫৫ সালে সিনেমা পিকনিক বিখ্যাত হয়েছিল এবং দুবার নতুনভাবে আনা হয়েছিল। লেখক ছিলেন পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত উইলিয়ান ইঙ্গ। ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পরের দিকে বিশেষ বিশেষ সুদৃশ্য জায়গা সাধারণের বনভোজনের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল। ১৮৩০-পরবর্তী পিকনিককে কেন্দ্র করে অপূর্ব সব ছবি আঁকা হয়েছে। আমেরিকান ইলাসট্রেটর থমাস কোলের ‘দ্য পিকনিক ১৮৪৬’ মানুষের আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে গেছিল এইকারণে।
ইটালিতে প্রত্যেক সোমবার পিকনিকের দিবস হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। ২০০০ সালে প্রায় ৬০০ মাইল জায়গা জুড়ে পিকনিককে উদযাপন করা হয় বিশেষদিনে। ওমর খৈয়াম বলেছিলেন প্রকৃতির শব্দে, গাছপালায়, বইয়ের সঙ্গে, সামান্য রুটি আর মদ থাকলে এই উদ্দাম প্রকৃতি এক যথেষ্ট স্বর্গের রূপের মতোই। আসলে এই বনভোজন আমদের মানবিক জীবনপ্রণালীর এক উত্তম আদান-প্রদানের বিনোদন এবং বিনোদনের চেয়েও বেশি সদ্ভাব ও শান্তি রক্ষার উপায়।