মনের ঘূর্ণি থেকে
মুখের ভেতর সেই বরফের দেশে
মুখের ভেতরে তিনি আমাদের জন্য নিজেই গলে যান, এই এত বিগলিত ভালোবাসাতে আমরা যাকে বলে অভিভূত! প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতায় তিনি পৃথিবীতে এমনি ছিলেন কিন্তু মানুষের মুখের ভেতর আসতে তার একটু সময় লেগেছে বৈকি! তো যার কথা বলছি তিনি হলেন আইসক্রিম। আইসক্রিমের আগমন পর্ব যে খুব সুষ্পষ্ট তা কিন্তু নয়। তবে বিশেষ বিশেষ ঘটনা ও তথ্যের প্রাসঙ্গিকতা থেকে একটা হালকা ধারণার জায়গায় পৌঁছোনো যায়। শোনা যায় ৫০০ খ্রিঃপূঃ সময় থেকে মানুষ মধু, প্রকৃতিতে জমে ওঠা বরফের কণা, ফল মিশিয়ে খাদ্য পরিবেশন করত। এবং এই খাদ্য খুব উন্নত শ্রেণীর নাগরিকদের হস্তগত হওয়ার সুযোগ ছিল কেবল। এও শোনা যায় হিপোক্রেটিস তার নিজের খাদ্যাভাসে বরফ খাওয়ার পর্ব রেখেছিলেন এবং এটি সেইসময় তার কারণে প্রচারিত হয়েছিল যে বরফ খেলে শরীর মন উজ্জীবিত হতে পারে।
যাকে আমরা আইসক্রিম বলি জায়গাভেদে তার নামের হেরফের রয়েছে কিছু, যেমন ফ্রোজেন কাস্টার্ড, ফ্রোজেন ইয়োগার্ট, সরবেট, জিলাটো। আজ যাকে আমরা আইসক্রিম বলি তার প্রথম নাম ছিল ‘ক্রিম আইস’। গ্রিসের পর এই তালিকায় আসে চীন এবং চীনকেই তথ্য ধরে প্রথম স্বীকৃতি দেওয়া হয় আইসক্রিমের ব্যবহারের জন্য। চীনে ২০০ খ্রিঃপূ এটির ব্যবহার শুরু হয়। চীনে কিং তাং শাংয়ের সময় ৯৪ জন পাচক ছিলেন যারা কেবল মোষের দুধ থেকে আইসক্রিম তৈরির ব্যাপারটিকে তদারকি করতেন। রোমের সম্রাট নিরোর রাজত্বকালেও এর ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়; সেইসময় পাহাড় থেকে তুষার সংগ্রহ করা ছিল একটি বিশেষ কাজ। দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশের দিকে আইসক্রিমের ব্যবহার এরও কিছু পরে প্রায় ষোড়শ শতাব্দীর সময় মুঘল রাজত্বকালে। ইতিহাসবিদদের মতে এই ষোড়শ শতাব্দী থেকেই আইসক্রিমের ব্যবহারিক প্রচার শুরু হয়।
দ্য গ্রেট আলেকজান্ডার ফুলের মধুর সঙ্গে বরফ মিশিয়ে খেতে খুব ভালোবাসতেন বলে জানা যায়। মোঘল রাজত্বকালে কুলফি ছিল আইসক্রিমের এক নতুন বিকল্প। প্রাথমিকভাবে মুঘল রাজত্বের সময় তথা সম্রাট কুবলাইখানের সময় ঘোড়সওয়ারীদের পাঠিয়ে হিন্দু কুশ পর্বত থেকে দিল্লিতে বরফ আনা হতো। ইংল্যান্ডে প্রথম চার্লসের রাজত্বের সময় তিনি আইসক্রিমের খাদ্যপ্রণালিকে গোপনভাবে অন্দরমহলে ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এটি এতই তার প্রিয় ছিল। আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগে মার্কোপোলো তাঁর দেশ পরিভ্রমণকালে চীন থেকে ইটালিতে আইসক্রিমের বিস্তার ঘটান। ইটালিয়ান ডে মেডিচি যখন দ্বিতীয় হেনরিকে বিবাহ করেন তখন ফ্রান্সের ডেজার্টদের মধ্যে এটি আবার জায়গা করে নেয়, সময়টা ১৫৫৩ সাল।
আরো পড়ুনঃ নোনতা মায়ার মুচমুচে চিপস
একইভাবে যখন ফ্রান্সের হেনরিয়েটা মারিয়া ১৬৩০ সাল নাগাদ দ্বিতীয় চার্লসকে বিবাহ করেন তখন ইংল্যান্ডেও আইসক্রিম খাওয়া শুরু হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর পর থেকে এর ব্যবহার চূড়ান্তহারে বাড়ে। ১৮০০ শতক অবধি এটি অভিজাত মানুষদের খাদ্য হিসেবেই বেশি প্রচলিত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিকদের খাদ্যের মধ্যে আইসক্রিম ছিল এনার্জি ও মনোবল বাড়ানোর বিশেষ খাদ্য। ১৭৪৪ সাল থেকে আমেরিকায় আইসক্রিমের ব্যবহার শুরু হয় সর্বসাধারণের মধ্যে তবে সীমিত অর্থে; সেই আমেরিকার বিখ্যাত ব্যতিক্রমী আইসক্রিম ফ্লেভার হলো ‘ হটডগ ফ্লেভারড আইসক্রিম’; আর সেই আমেরিকায় এখন আইসক্রিমের জনপ্রিয়তা তথা বিক্রির পরিমাণ বিশাল। বর্তমানে আইসক্রিমের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই; তার প্রকারভেদ, তার সৌন্দর্য, তার স্বাদ, তার প্রকরণ তার যে কত সম্ভার তার ইয়ত্তা নেই। বৃদ্ধ থেকে শিশু, মানুষ থেকে পোষ্য সকলের কাছে চূড়ান্ত আনন্দ উত্তেজনার খাদ্য হলো আইসক্রিম। ভলতেয়ার বলেছিলেন—“ICE CREAM IS EXQUISITE.WHAT A PITY IT ISN’T ILLEGAL.”