সাঈদ চৌধুরী: চিত্তে উড়ে জালালী কইতর

  • মুসা আল হাফিজ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

সাঈদ চৌধুরী

সাঈদ চৌধুরী

আপনি গল্পকার। প্রত্যক্ষের আড়ালে জীবনের যে জটিলতা ও রহস্যময়তা, তাকে আপনি বয়ন করেন। সেই বয়নে চরিত্রের প্রতি আপনি পক্ষপাতশূন্য, আবেগ বিষয়ে ঘোরাহত কিন্তু নির্বিকার, শিল্পী হিসেবে অঙ্গীকারাবদ্ধ কিন্তু নিরাসক্ত, পরিবেশ বিষয়ে বহুদর্শী ও সচেতন, বিচারবুদ্ধি সম্পর্কে আপনি নাছোড়, নিরাপোষ। আপনার মনোযোগ মূলত স্বরূপ সন্ধানে।

হ্যাঁ, আপনি গল্পকার। চোখ আপনার চাই। নিজের চোখ। এক জোড়া, কয়েক জোড়া, কিংবা কয়েক শত ... জ্বলজ্বলে, ড্যাবড্যাবে চোখ। রঞ্জনরশ্মি তাতে থাকবে, সব ঘষে ঘষে যাচাই করার ক্ষমতা সরবরাহ করবে সেই চোখ, শব্দে, বাক্যে, চরিত্রে, প্লটে সেই চোখের জ্যোতি জ্বলতে থাকবে। এর ভেতরে থাকবে অভিজ্ঞতা, বাইরে থাকবে শিল্পরূপায়ন।

বিজ্ঞাপন

এই যে আমরা চোখ নিয়ে কথা বলছি, উপলক্ষ তৈরি করে দিয়েছে সাঈদ চৌধুরীর একগুচ্ছ গল্প। গল্পগুলোতে আন্তরজীবনের অন্তরীণ ভাষা যতোটা বন্ধনমুক্ত হয়েছে, তার চেয়ে বেশি হয়েছে বাইরের চিত্রপট। সাঈদ চৌধুরীর দেখার চোখ ভ্রামণিকের কথা মনে করিয়ে দেয়। যার দৃষ্টি ও সৃষ্টির একপ্রান্তে সবুজ-শ্যামলে, প্রাণে ও অধ্যাত্মে পল্লবিত সিলেট, আরেক প্রান্তে টেমসের তীর, ব্রিটেন-ইউরোপ।

সাঈদ চৌধুরী মানুষের জীবন যাপনের বিচিত্র অনুষঙ্গকে দেখেছেন দুনিয়ার নানা প্রান্তে ঘুরে ঘুরে। তার প্রান্ত যেখানেই যাক, শেকড় থেকেছে বাংলায়, দেশ মৃত্তিকায় আর স্বকীয় আত্মপরিচয়ে। যে পরিচয় জন্ম নিয়েছে মুসলিম ঐতিহ্য থেকে। তার আলোকের ঝরণাধারা স্থির মূল্যবোধ থেকে উড়নচণ্ডী এই সমাজ ও সময়কে দেখার ও দেখানোর একটি প্রতিবেদন। এই দেখা ও দেখানোর মূল লক্ষ্য ও কেন্দ্র হলো আলোয় প্রত্যাবর্তনের ব্যাকুলতা।


গল্প অনেক রকম। ব্যক্তির যে নিজস্ব যাপন, সেই যাপনের পটভূমি থেকে যখন গল্প তৈরী হয় আর তার চরিত্র সমূহ বিকশিত হয়, একে আমরা লিপ্তধারার গল্প বলতে পারি। সাঈদ চৌধুরী মূলত লিপ্তধারার গল্পকার। ফলে তার চরিত্রগুলোকে তার জীবনের যাপন থেকে যেমন আলাদা মনে হয় না, তেমনি তার পরিবেশ চিত্রায়নও তার যাপনশীলতার অংশ।

আলোক ঝরণাধারা গল্পের হান্নানা থাকেন সিলেটে, যেখানে একদিকে চাষণীপীরের মাজার, অপরদিকে অসংখ্য বানরের বসবাস। যখন মাজার হাজির হলো, মনষ্কামনাও হাজির। হান্নানা আপন মনোবাসনা পুরণের আশায় মাজারে মান্নত করেন, তবে গল্পের আলাল একে পছন্দ করে না। যদিও পশুপাখির প্রতি তার অনুরাগ প্রবল।

আলালের হৃদয়ে বসবাস করে সামিয়া। ভালোবাসা দিবসে তারা বিনিময় করে ফুল। এই ফুল ক্রয়ে দোকানযাত্রায় লেখক হাজির করেন ভালোবাসা দিবসের আড়ালে বাণিজ্যের পসরাকে। গল্পের প্রধান চরিত্র পলাশ থাকেন ইংল্যান্ডে, ফিরে আসেন সিলেটে, স্ত্রী মারা গেছেন এখানেই। বিয়ে করতে চান না। কিন্তু পরিবার মনে করে, প্রয়োজন হাজির করে। গল্পের সমাপ্তি ইতিবাচকতায়। রঙধনুর রঙের ছটায় সুদর্শন পরীর মতো হানিফা জড়িয়ে ধরে তার বাবাকে।

এই একটি গল্প সাঈদ চৌধুরীর গল্পমানসকে চিহ্নিত করার জন্য চাবিগল্পের কাজ করতে পারে। এখানে তার রূপদক্ষতা চিহ্নিত, প্রকৃতিকে বয়ানের যে মনোজ্ঞ রুচিবাগীশী, সাঈদে তা প্রতিফলিত। দৃশ্য- কী লন্ডনে, কী সিলেটে; গুচ্ছ গুচ্ছ আর্ট হয়ে ধরা দিয়েছে। এই গল্পের কেন্দ্রে আছে পারিবারিক বন্ধন, শুভবোধ। যখন পরিবার ভাঙছে, মানুষ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, শিথিল হচ্ছে ভ্রাতৃবোধ। সাঈদ চৌধুরী তার গল্পে যুথবদ্ধ একটি পরিবারের পাটাতনে এই অবক্ষয় থেকে উদগতি কামনা করেছেন। যেভাবে অন্য এক গল্পে তিনি মারওয়ানের জবানে হাজির করেন বিয়ের যুক্তি ও প্রয়োজন, গল্পের নায়িকা সাবিহা যখন বিয়ের বিপক্ষে।  

কিন্তু এখানে কি স্পষ্ট কোনো প্রতিবাদ আছে? আছে, কিন্তু তা চিত্কৃত নয়, প্রচ্ছন্ন। গল্পকারের স্বার্থকতার জন্য এটি জরুরী। সাঈদ চৌধুরী যে কাব্যিক, এর সাক্ষ্য রয়েছে তার বাক্যে, স্থাপত্যে। কবির গদ্য বলে যে একটা কথা, তা বাংলা গল্পকথনে শক্তিশালী ঐতিহ্য গড়েছে। সাঈদ সে ঐতিহ্যের ফসল। এই কাব্যগন্ধ ভাষার মধ্যে একটি তন্ময়তা নিশ্চিত করে, যা গল্পের লাবণ্যে আনে বিশেষ মাত্রা।

সাঈদ চৌধুরীর অন্যসব গল্পে নজর বুলাই। সৌভাগ্যের স্বর্ণ সুড়ঙ্গ দিয়ে দেখা যায় প্রবাস, একটি পরিবার, সিলেট, সিলেটের টেকেরঘাট, প্রাকৃতিক সম্পদ, চুনাপাথর, কক্সবাজারে সমুদ্র সৈকত, মাটির তলের রত্ন, একটি গ্রামে শীতের সকাল, আনাসের বাড়ী, ভরপুর গাছপালা, বর্ষা, ফুল-ফল, শাক-সবজি, এরই মাঝে বরকত-ফারিয়ার প্রেম। গল্পের আনাস সঙ্গদোষের অনুতাপে পুড়ে। ভাগ্যের উদার অনুগ্রহ তাকে দেয় উন্নত মানবিক জীবনের সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনা সবার মধ্যেই রয়েছে এবং সাঈদ চৌধুরী চান এর যথাবাস্তবায়ন।  

কিন্তু আরবান জীবনের দু:সহ অবক্ষয়ের পাশাপাশি চিরায়ত গ্রামীন সমাজও তো ডুবে আছে ঝগড়া, প্রতারণা, স্বার্থসংঘাত ইত্যাদিতে। মানবিকতা গল্পে এর চিত্র বাংলাদেশী লোকজীবনের এক ব্যথিত প্রেক্ষাপটের জানান দেয়। গ্রামে ঢুকে পড়া গাঁজা, দেশীয় অস্ত্র, দা, ছুরি ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে। সেগুলো প্রতারণার হাতিয়ার হচ্ছে। ক্ষমতার প্রশ্রয়ে নির্দোষকে বানানো হচ্ছে দোষী।

চলমান ও জ্বলন্ত সংকট সাঈদ চৌধুরীকে বিচলিত করেছে, তার গল্পে আছে দুর্ভিক্ষের ছায়া, করোনায় বাবা হারানো ফারহানার দু:খাকুল বাস্তবতায় অসুস্থ মা আর হাসপাতাল। বিপদের চোখরাঙানি তাকে ঘিরে ধরলেও সে শুভবাদী; মানুষের হয়ে কাজ করতে উদগ্রীব ও সচেষ্ট। সে বেদনা ও জটিলতাকে জয় করে মানবপ্রেম দিয়ে। এর মধ্যে নিয়ে আসে আনন্দের আস্বাদ।

জীবন যেখানে দু:খতরঙ্গের খেলা, সেখানে আশাকেই ফারহানা একমাত্র ভেলা মনে করে না। সে ইতিবাদী প্রচেষ্টা ও শুভেচ্ছাকে ভেলা বানায়। তৈরী হয় ‘শুভ্র সাদায় আচ্ছাদিত’ বাগানের এমন দৃশ্যপট, যেখানে অসুস্থ মা সুস্থ হয়ে উঠেন এক ভোরে, যেখানে অসুস্থতার ভেতর অলৌকিক ঝরণা আর পুষ্পিত সুন্দরতায় হাটতে দেখেন আপন স্বামীকে। সেই দেখাকে উচ্চরবে তিনি ব্যক্ত করেন। যেন জীবনের নিরাশার ভেতর কথা বলছে ঐশী বিশ্বাস!

সাঈদ চৌধুরীর অতিন্দ্রীয় বিশ্বাসের যে স্বচ্ছলতা, তার চিত্রায়ন এ গল্পে স্পষ্ট। যেভাবে স্পষ্ট মানবিক দায়শীলতার অনুভব। যেভাবে জিনের অস্তিত্ব প্রমাণে তিনি যুক্তির অবতারণা করেছেন ‘বাসকিউন্স ভুত’ আর ‘ভুতের অট্টহাসি’ গল্পে। উভয় গল্পে তৈরী হয় এক গা ছমছমে পরিস্থিতি। ভূতের গল্প বলতে বলতে দৌড় দেয় ইংল্যান্ডের জন। আর বাংলার একটি গ্রামে ভূতের বাস্তবতায় উচ্চারিত হয় আয়াতুল কুরসির তেলাওয়াত।   

সাঈদ চৌধুরীর এই গল্পজার্নি আমাদের জীবন যাপনের ভাঙ্গা টুকরোগুলোকে জড়ো করে করে অগ্রসর হয়। প্রকৃত অর্থে এই টুকরাগুলো সাঈদ চৌধুরীর জীবনেরই ছিন্নভিন্ন মুখ, ছিন্নভিন্ন কিন্তু সমন্বিত। সেই সমন্বয় থেকে জন্ম নেয় তার গল্প, চরিত্র। ফলে সাঈদ চৌধুরীর আত্মপ্রকাশের প্রথম লগ্নে তার উপন্যাসের আহমদ চরিত্রকে ঠিক জায়গায় সনাক্ত করেছিলেন কবি-কথাকার আল মাহমুদ। লিখেছিলেন ছায়াপ্রিয়া  উপন্যাসের নায়ক ‘আহমদ’ চরিত্রটির আড়ালে আমি যেন সাঈদ চৌধুরীর মুখটিই দেখতে পেয়েছি। কাল্পনিক এ চরিত্রটি যেন আদর্শ হয়ে ধরা দিয়েছে, পাঠকের চেতনে। আর আহমদের ভাললাগার মানুষটির মাঝে নিজের প্রিয়তমার প্রতিচ্ছবি কেউ দেখতে পেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।‘

সাঈদ চৌধুরীর সেই উপন্যাসের ৪টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিলো বলে আল মাহমুদ নিজের আশ্বস্তি জ্ঞাপন করেন। স্বার্থক একটি সৃষ্টির বৈশিষ্ট বোধ হয় এমনই হয়। তার উদ্দেশ্যে আল মাহমুদ বলেছিলেন, পেশাগত শত ব্যস্ততার ভেতরে সাহিত্যচর্চা অব্যাহত রাখতে। তখন তাকে যথাযথ মূল্যায়ণ করতে সুবিধা হবে বৈকি।

এই যে শত ব্যবস্থতার কথা বললেন আল মাহমুদ, তা সাঈদ চৌধুরীর জীবনের প্রধান এক দিক। ব্রিটেন প্রবাসী এই লেখক ও এক্টিভিস্ট পেশাগতভাবে ব্যবসায়ী, এয়ারলাইন ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন, বিমান কোম্পানির ছিলেন একজন ডাইরেক্টর। ‘ব্রিটিশ-বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এন্ড কলেজ’ এর প্রতিষ্ঠায় ছিলেন যুক্ত, সম্পাদনা করেছেন সাপ্তাহিক ইউরো বাংলা। করেছেন রিসোর্ট ব্যবসা। আবার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আল মাহমুদ ফাউন্ডেশনের, নেতৃত্বে আছেন সংলাপ সাহিত্য-সংস্কৃতি ফ্রন্ট সহ বহু সংগঠনের।

 ইতোমধ্যে লিখেছেন নানা গ্রন্থ। উপন্যাস ছায়াপ্রিয়া, প্রবন্ধ গ্রন্থ সুনিকেত, সাক্ষাৎকার কালজয়ী কবিতার স্রষ্টা আল মাহমুদ, কবিতাগ্রন্থ আত্মার অলিন্দে, আরব জাহান নিয়ে স্মৃতিময় লেখা ধুসর মরু বুকে, বিলেত নিয়ে লেখা লন্ডনে যাপিত জীবন, সাহিত্য আলোচনা সমকালীন সাহিত্য ভুবন ইত্যাদি।

সাঈদ চৌধুরীর কলাম, প্রতিবেদন, ফিচার ও সাহিত্য আলোচনাও দৃষ্টিতে পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে এক ধরণের সাংবাদিকসূলভ বর্ণনা ও মনস্বীতা। তার এ চরিত্রের রচনায় রয়েছে এক ধরণের স্বাদু ব্যাপার। কয়েকটি রচনা শিরোনামের সাথে পরিচিত হওয়া যাক। (লিংক সংযুক্ত)

এভাবে লেখালেখি ও টেলিভিশন আলোচনায়ও তার চারুউচ্চারণ শোনা যায়। সাংগঠনিকতায় নিজেকে রেখেছেন সক্রিয়। এতো সব মাত্রার মধ্য দিয়ে সাঈদ চৌধুরী সচল থাকছেন। নিজের ও নিজের দেখা জীবনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে প্রতিবেদনদেহ সাজানোর কাজ করছেন। যেন হৃদয়গ্রাহী সুন্দরের হাসির পাশে তার রক্তাক্ত শরীর ও রোদনের ধ্বনি আমাদের দৃষ্টি ও কান না এড়ায়। এরই মধ্যে লড়াই করে অগ্রগতি নিশ্চিত করাই তো মানবপ্রগতির ইতিহাস।

একটা সময়ে পৃথিবীটা মানুষের কাছে আতঙ্কই ছিল। প্রাকৃতিক পরিবেশ, হিংস্র জন্তু-জানোয়ার আর দুর্গমতার কারণে। মানুষের কাছে একটা গোষ্ঠীর বিচরণ ভূমিই সমগ্র পৃথিবী বলে পরিগণিত হয়েছে। মানুষ একে একে পৃথিবীটাকে জয় করতে পেরেছে তার উদ্যম অদম্য স্পৃহা আর সীমাহীন দৃঢ় মনোবলের কারণে। মানুষ বদলাতে পেরেছে প্রকৃতির খেয়াল, আয়ত্তে আনতে পেরেছে বৈরী পরিবেশের, জন্তু-জানোয়ার অধীন হয়েছে মানুষের আর দুর্গম আর দুর্গম নেই, মানুষের পদচারণায় মুখর হয়েছে অজানা-অচেনা পৃথিবী। এখন প্রকৃতি কেবল প্রকৃতি নয়, মানবিক প্রকৃতি।

এই যে জয়, সেখানেও আছে প্রখর শুন্যতা। কারণ প্রকৃতি জয়ে মানুষ অগ্রগতি অর্জন করলেও মানুষ কি জয় করতে পেরেছে নিজেকে? মানুষকে? নিজের মধ্যকার পিশাচকে জয় করতে পারেনি বলেই তাদের লোভের থাবা ও হিংস্রতা শুধু প্রকৃতিকে বিপন্ন করছে না, মানুষের ভবিষ্যতকেও হুমকিগ্রস্থ করছে। ফলে মানুষের ভেতরের অমানুষের সাথে যে লড়াই, সেটা অতীতে যেমন গুরুতর বিষয় ছিলো, আজকে আরো বেশি। এ লড়াই জারি থেকেছে সেই কাল থেকে এই কালে এবং আগামী সব দিনে-রাতে। নানা তত্ত্ব, নানা চেষ্টা, নানা সংগ্রাম কেবল বেঁচে থাকবার পরিসরকে বড় করার লড়াই জারি রাখে। সেই লড়াইয়ে একজন কবি, একজন গাল্পিক, একজন শব্দশিল্পী মনের ও হৃদয়ের আলোকমালাকে ব্রক্ষাস্ত্র বানিয়ে লড়েন। চিরায়ত সুন্দরের অন্বেষা তাদের করে তৃপ্তিহীন। সেই লড়াই ও অতৃপ্ত যাত্রা তাদেরকে বহুমুখি সৃষ্টিশীলতায় সক্রিয় রাখে।

সাঈদ চৌধুরীও আপন সৃজনক্ষেত্রে নানা মাত্রিক। কবিতা হচ্ছে তার আত্মপ্রকাশের অন্যতম এক প্রকরণ। কবিতায় সাঈদ চৌধুরী সরল, সাবলীল। একদম ঠোঁটের ভাষায় রচিত তার কবিতা। প্রকরণের প্রতি মনোযোগের চেয়ে বিষয় ও বক্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা এক ধরণের কবিতায় প্রকাশ পায়। সেগুলো মূলত বক্তব্যপ্রধান কাব্য। এমন কাব্যে সাঈদ প্রগলভ। 

সাঈদ চৌধুরীর গল্পে  মজলিসি মেজাজ রয়েছে, কবিতায়ও প্রাধান্য পেয়েছে কথকতা। এরই মধ্যে ভেসে উঠে  একটি ভাবনাবিহবল, স্বাপ্নিক চৈতন্যের মুখ। প্রকৃতি ও জীবনভাবনায় যার অঙ্গীকার। স্মৃতিকাতরতা ও নষ্টালজিয়া সেখানে উচ্চকিত :

নিসর্গের সবুজ শ্যামলিমায়/ মাইজগাঁও থেকে সারকারখানা/ সমান্তরালে ছুটে চলে গাড়ি ও ট্রেন/ ফেঞ্চুগঞ্জ কলেজ মোড়ে আইসক্রিম/ লেহন করে তৃষনার্ত যুবতি/ দ্যুতিময় হাতে কৌণ আইসক্রিম/ স্পন্দিত নদীর মতো ঝরায় বসন্ত/ গলতে থাকে রৌদ্র জ্যোৎস্নায়। 

সাঈদ চৌধুরী বিশ্বাসে সমর্পিত, ঈমানে উদ্দীপ্ত তার উচ্চারণ। তার কবিতায় আমরা শুনি   জীবনমুখিতার মধ্যেও ভাববাদী উচ্চারণ এবং বস্তসর্বস্ব দুনিয়ার করুণ চিত্র :

১.  নিরবে সন্ধ্যা ছড়িয়ে পড়ে/ দিগন্তের ঐ ধূসর আলোয়/ ঝলমলে গোধুলী বেলায়।/ সান্ধ্যরাতের কফির কাপে/ হারিয়ে যাওয়া মুখগুলি সব/ ভেসে ওঠে আলো-ছায়ায়।/ অবাক করা এক গুঞ্জনধ্বনি/ চুলগুলো সব পাতলা হচ্ছে/ কে যেন আজ জানতে চায়।

২. অনুভূতিশূন্য আবেশ ছিল মনুষ্য হৃদয়ে/ মুক্তকেশে ঝড়ের মেঘের কোলে/ এখন বিপর্যয়ের বাতাস বইছে/ দুর্ভাবনায় ভুগছে মহাবিশ্ব/ প্রযুক্তির অর্থহীন দৃশ্যে/ খোলা চোখে ঘুমাচ্ছে/ ডুবে যাওয়া মুখ।

৩. দিন চলেছে আশায় আশায়/ রাত জাগে নির্ঘুম দুর্ভাবনায়/ এই প্রীতি অবেলার অভিলাষ/ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সময় করছ বিনাশ।/ অতিক্রান্ত জীবন ক্লান্ত অধীর/ তুমি কি তবে অন্ধ এবং বধির?/ বৈশাখী মেঘেরা ঘিরেছে আকাশ/ হচ্ছে কেবল হৃদপিন্ডের সর্বনাশ। 

সাঈদ চৌধুরীর একটি কবিতার নাম অপার্থিব, অলীক-অসার। এতে তিনি  লিখেছেন, নীলাভ আকাশ জুড়ে জালালী কেইতর উড়ে/ রোদেলা বিকেলে ঝিলমিল সোনালি আভায়/ ভালোবাসা পেয়েছি আমি বিত্ত নয় চিত্তে/ দিনের  সূর্যালোকে আর রাতের পূর্ণিমায়।  

এই পঙক্তিমালায় সাঈদ চৌধুরী সম্ভবত নিজেকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে প্রকাশ করে দিয়েছেন। তার জীবনবোধের  আকাশটা প্রসারিত এবং নীল। সেখানে বিশ্বাস ও ঐতিহ্য তৈরী করে সোনালি আভা। যার মধ্যে ডানা মেলেছে জালালি কইতর!  

লেখক: কবি, গবেষক প্রাবন্ধিক